চিত্তবাবুর বয়েস যে বিরাশি হয়েছে, না বলে দিলে কেউ বুঝবে না, অনায়াসে বছর দশেক কমিয়ে বলা যায়।
এখনো রোজ নিয়ম করে তিন কিমি হাঁটেন, রীতিমতো দরাদরি করে মাছ সবজি কেনেন, বছর দশ পনেরো ছোটোদের সাথে চায়ের দোকানে আড্ডা দেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় উচ্চপদস্থ কর্মচারীটির কোনোকালেই কিছু নেশা ছিলো না, বই পড়া ছাড়া। নাতনির চাপে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, সেখানে নিয়মিত পোস্টও করেন,
নিজের অতীত অভিজ্ঞতা আর বর্তমান ভারতবর্ষের নানান পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা। তার মধ্যে বেশ কয়েকটা ভাইরাল, হোয়াটসঅ্যাপে ‘যযাতি’ এক পরিচিত নাম।
যযাতি। এই নামটাই চিত্তবাবু কেন বাছলেন নিজের ছদ্মনাম হিসেবে, বলা মুশকিল। বোধহয় সেই পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষ রাজাটির মতো বার্ধক্যেও তাঁর যুবকের মতো ছুটে বেড়ানোর জন্য। অথবা হয়তো বছর বিশেক আগে হাসিমুখ ফটো হয়ে যাওয়া গিন্নি শর্মিষ্ঠার সাথে মেলাতে গিয়ে। এও হতে পারে যৌবনে কোনো দেবযানীর প্রতি তাঁর একটু ইয়ে ছিলো, তবে ফেসবুকে তেমন তিনি লেখেননি, অমন বয়স্ক একটা মানুষের সুদূর অতীত নিয়ে টানাটানি করা ঠিক হবে না।
চিত্তবাবুর দোতলা বাড়ির একতলাটা তিনটে পরিবারকে ভাড়া দেওয়া, পেনশনের সাথে যোগ হয়ে এখনো মাসিক রোজগার মন্দ না। দোতলার একদিকে তাঁর ছেলে পৌরবের সংসার, বৌমা শ্রী আর নাতনি রুষার সাথে। ওই দেখুন,
পৌরবের ডাকনাম পুরু, যযাতিরও ছোটো ছেলের নাম তাই ছিলো, এটাও কিন্তু ছদ্মনামের কারণ হতে পারে।
পৌরব কিন্তু আসলে একটি মাকাল ফল। দেখতে শুনতে ভালো, ভদ্র , নেশাটেশাও করে না, কিন্তু আজ অবধি তাকে কেউ কোনোদিন কিছু রোজগারের কাজ কারতে দেখেনি, না চাকরি, না ব্যবসা। ব্যাপারটা শর্মিষ্ঠাদেবীর ‘লাড-পেয়ারে’ ছোটোবেলায় বিগড়ে যাওয়ার ফল, নাকি কোনো সোসিওফোবিয়া, সেটা গবেষণাসাপেক্ষ। পৌরব ছবি আঁকে না, কবিতা লেখে না, খেলা সিনেমায় আগ্রহী নয়,কোনো বাউন্ডুলেপনাতেও সে নেই। একটা শিক্ষিত ছেলে সারাদিন কিচ্ছু না করে যে কিভাবে জীবন কাটিয়ে যেতে পারে, সেটা সত্যিই এক রহস্য।
পৌরবের ঠিক বিপরীত স্থিতি শ্রী-এর। সিরিয়ালের অভিনেত্রী হিসেবে তার যথেষ্ট নাম আছে, তবে সবই পার্শ্বচরিত্রে, নায়িকা হতে গেলে যে ভয়ানক শ্রম আর রুটিনের সাথে সমঝোতা দরকার,দিন-রাত্তির এক করে যেভাবে পেশায় পড়ে থাকা প্রয়োজন, সেটা তার মেয়ে-বর-শ্বশুর সামলে করা সম্ভব নয়। তবু, তার রোজগারেই রুষার স্কুল, টিউশনি, মাঝে মাঝে বাইরের খাবার বা বাড়িতে স্যুইগি, সব কিছুতে কি আর শ্বশুরের কাছে হাত পাতা যায়?
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো, হঠাৎই বিনামেঘে বজ্রপাতের মতন একদিন চিত্তবাবুর দুই পা ফুলতে শুরু করলো। হালকা প্রেশারের ওষুধ ছাড়া তিনি কিছুই খান না, প্রথমে সেই ওষুধটাকে বা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাকে দোষারোপ করে কিছুদিন গেলো, তারপর যখন সমস্যাটার মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া হলো । প্রথম রিপোর্টেই ইউরিয়া ২৫৬, ক্রিয়েটিনিন ৫.২, ইউ এস জি-তে দুটো কিডনি বিকল। তক্ষুনি প্রথমে টেম্পোরারি ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা, তারপরে দুতিনজন নেফ্রোলজিস্ট-দর্শন, সকলেরই বক্তব্য এক, ‘হিমোডায়ালিসিস।’
হিমোডায়ালিসিস করতে গেলে প্রথমে হাতে শিরা ও ধমনী যোগ করার একটা ভজঘট অপারেশন করতে হয়। তারপর সেই এ ভি ফিস্টুলা দিয়ে সপ্তাহে দুই বা তিনবার হিমোডায়ালিসিস, হাসপাতালে গিয়ে। চোখের সামনে চিত্তবাবু শুকিয়ে যাচ্ছেন ক্রমে ক্রমে।
একদিন পুরু ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো ‘ম্যাডাম, শুনেছি কিডনি বদল করা যায় এসব কেসে?’
ডাঃ আরতি মুর্মু মাথা নেড়ে বললেন, ‘উঁহু, বিরাশি বছরে সেটা কে করবে! এতেই তো চলে যাবে বছর দুই থেকে পাঁচ’
‘কিন্তু, করা কি যায়?’
‘সত্যি যদি বলেন, সেটাই আসল চিকিৎসা। তবে ডোনার পাওয়া চাই তো!’
‘আমি দেবো ম্যাডাম! ম্যাচ হবে আশা করি।’
‘আপনি! জীবন এখনো অনেকটা পড়ে আছে আপনার। রিস্ক বেনিফিট ভাবলে আপনার বাবার লাভ, আপনার কিন্তু অনেকটা ক্ষতি। একটা কিডনিতে বাকি জীবনটা টানতে হবে। বাবার রোগটি আপনারও তো হতে পারে!’
‘সে হলে হোক। আমি চাই আমার বাবা সুস্থ হয়ে বাঁচুন আরো বহুদিন’
বরের এই গোঁ দেখে শ্রী স্তম্ভিত হয়ে গেলো। বোঝানোর হাজার চেষ্টা করেও উত্তর বদলালো না পুরুর।
চিত্তবাবু ডেকে বোঝালেন। বয়েস হয়েছে, যেতে তো হবেই অমোঘ নিয়মে। পুরু অনড়।
গোটা পাড়া জুড়ে অবশ্য ধন্য ধন্য পড়ে গেলো। পৌরবকে নিয়ে বেশ কিছু চ্যানেল স্টোরিও করে ফেললো।
শেষ অবধি নির্বিঘ্নে সার্জারি সেরে বাড়ি ফিরলো বাপ ব্যাটা। চিত্তবাবু একেবারে আগের মতো না হলেও, সচল সবুজ জীবন অনেকটাই ফিরে পেলেন।
কোনো এক নিশুতি আদরঘন মূহুর্তের শেষে, আশ্লেষমাখা গলায় শ্রী ফিসফিস করে বললো ‘বাবাকে তুমি এত ভালোবাসো, কখনো বুঝিনি’।
নিশ্চিন্ত ঘুমের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে পুরু বলে উঠলো ‘অন্তত মেয়ের টুয়েলভ পাশ পর্যন্ত বাবার পেনশনটা দরকার, শ্রী।’