পশ্চিমবঙ্গ উর্দু একাডেমি গত সোমবার একটি মুশাইরার (Poetry symposium) আয়োজন করেছিলেন যার শিরোনাম ছিল ‘হিন্দি সিনেমায় উর্দু’। তাতে প্রধান অতিথি হওয়ার কথা ছিল প্রখ্যাত কবি ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার মহাশয়ের। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন অনিবার্য পরিস্থিতির কারণে। কর্তৃপক্ষ কারণ না জানালেও সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা যাচ্ছে মুসলিম কিছু সংগঠন যেমন জামিয়াত উলেমা-ই-হিন্দ, ওয়াহইয়ান ফাউন্ডেশন ইত্যাদি জাভেদ আখতারকে অতিথি করার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানায় কারণ বহুক্ষেত্রেই তার বক্তব্য নাকি মুসলিম ধর্মীয় ভাবাবেগে তীব্র আঘাত করে। স্বাভাবিকভাবেই ২৬-এর ভোটের সাত আট মাস আগে তৃণমূল পরিচালিত সরকার চায় না কোনোভাবেই তাদের মুসলমান ভোট ব্যাংককে বিরক্ত করতে, ফলে অনুষ্ঠান আপাতত বাতিল।
‘বেঙ্গল ফাইল’ সিনেমার মুক্তি নিয়ে তৃণমূল প্রবল বিরোধিতা করেছে একই কারণে। স্বাভাবিকভাবে বিরোধীদল বিজেপি ‘বেঙ্গল ফাইল’ সিনেমার পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছে এই বলে যে এই ছবি মুক্তিতে বাধা দেওয়া সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, শিল্পী ও তার সৃষ্টির কণ্ঠরোধের অপচেষ্টা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও এ বিষয়ে সহমত। যদিও শুনেছি এই সিনেমায় নাকি ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, মূলত এটি একটি প্রোপাগান্ডা ছবি। হিন্দু ধর্মের উগ্র প্রচার করে বিজেপি আরএসএসের সুবিধে করে দেওয়াই নাকি এর উদ্দেশ্য। ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে বিজেপির সাফাই, ওটা পরিচালকের স্বাধীনতা। ইতিহাস আর ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস যেমন এক নয়, এও ঠিক তেমনি।
সে যাই হোক আমি শিল্প সাহিত্যকে নিষিদ্ধ করার নীতিগতভাবেই বিরোধী। তাই ‘বেঙ্গল ফাইল’ ছবি মুক্তিকে আটকে দেওয়ার আমি বিরোধী। ঠিক একইভাবে মৌলবাদের কাছে নত হয়ে জাভেদ আখতারের কলকাতায় আসা আটকানোর প্রতিবাদ করছি। ঠিক যেমন বাম আমলে তসলিমার বই নিষিদ্ধ করা ও তাঁকে তাড়ানোর তৎকালীন সরকারের প্রয়াসেরও তীব্র বিরোধিতা করেছিলাম।
এখন কথা হচ্ছে বেঙ্গল ফাইল ছবির মুক্তি আটকানোর তৃণমূলীয় চেষ্টা নিয়ে যে বিজেপি হল্লা করছে, প্রতিবাদ করছে তারা জাভেদ আখতারকে নিয়ে চুপ কেন? সেখানে তো আপত্তি করছে মুসলিম মৌলবাদ, তাদেরকে প্যাঁচে ফেলার এটাও তো একটা সুযোগ, তাহলে?
আসলে জাভেদ আখতার মুক্তচিন্তক। (রবি ঠাকুরের কবিতায় আছে না, ‘নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর, ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর’)। জাভেদ মননে ধর্মান্ধ নন বলেই যে কোনো মৌলবাদেরই তিনি বিরোধিতা করতে পারেন। ফলে মুসলমান মৌলবাদের বিরোধিতা করলে যেমন হিন্দু মৌলবাদ তাকে মাথায় তুলে নাচবে না উল্টোটাও তেমনই সত্যি। সকল মৌলবাদই আসলে তাঁকে আটকাতে চাইবে। কারণ মুক্তচিন্তার প্রসার হলে মানব মনের গভীরে আলো জ্বলে ওঠে। ধর্মগুরু বা রাজনৈতিক দলনেতারা যা বলছে তাকেই অকাট্য বলে না মেনে সে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে শেখে। মানবিক মন নিয়ে দেখে সবকিছু। সে পরমত সহিষ্ণু হতে শেখে, তাকে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে ধর্মে ধর্মে ঘৃণায় আর বিভক্ত করে রাখা যায় না, ধর্মের আবেগ ব্যবহার করে ভোট আদায় করা যায় না। ফলে মুক্ত চিন্তকরাই আজ মৌলবাদীদের কাছে সবচেয়ে বড় থ্রেট। এ বিষয়ে এক প্রশ্নোত্তরে টাইমস অব ইন্ডিয়া কাগজকে জাভেদ আখতার গতকাল বলেছেন, “It is very interesting that I keep receiving hate mails and comments from both Hindu and Muslim organisations. Some Hindu outfits call me jihadi and tell me to go to Pakistan. Some Muslim organisations call me kafir and tell me to change my name. As far as I am receiving such resentment from both the sides, I think I’m saying and doing something right.”
হাতে গোনা দু একজন ব্যাতিক্রমী ছাড়া কলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী মহল সাধারণত বিতর্ক এড়িয়ে শাসকের নিরাপদ আশ্রয়েই থাকেন। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যদিও এরকম একটা সাহিত্য আলোচনা মৌলবাদীদের তুষ্ট করতে স্থগিত করে দেওয়া নিয়ে সর্বাগ্রে তাঁদেরই কণ্ঠ তোলা উচিত ছিল কিন্তু দেখুন সবাই কেমন চুপ! মিডিয়ারও কোনো হেলদোল নেই। এই নীরব মূক ও বধির কলকাতা আমার প্রাণের শহর নয়। কলকাতার হয়ে আমি তাই প্রতিবাদ করছি আর বলছি এ শহরে কোনো কবি আসবেন কি আসবেন না সেটা কোনো মৌলবাদ ঠিক করে দেবে না! আরো কেউ কেউ হয়ত– না হয়ত কেন, নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের সঙ্গে আমার ক্ষীণ কণ্ঠটুকুও মিলিত হোক।
এখন প্রশ্ন হল আপনি কোন পক্ষে!









