পূর্বপ্রকাশিতের পর
শুরুর দিনগুলো
যাইহোক ডা. দুরেজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে আমি মানিকতলা ইএসআই-তে পেইন নিয়ে কাজ শুরু করার চেষ্টা করি। দুর্গাপুর ইএসআই থেকে মানিকতলায় আমার পোস্টিং হয়েছিল ২০০৭-এ, একজন এনেস্থেসিয়ার চিকিৎসক হিসেবে।
এনেস্থেটিস্ট হিসেবে সেই সময় নিজের চোখে অনেকগুলো স্পাইন সার্জারি ও তার ফল প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সত্যি বলতে কি তখনকার স্পাইন সার্জারি বা তার যে ফলাফল, সেটা আমার পছন্দ ছিল না। আমি জানতাম, পেইন চিকিৎসায় এর থেকে অনেক ভালো ফল হতে পারে, মানে সেই মানুষটি অনেকটাই সুস্থ জীবন পেতে পারেন। আমি এনেস্থেটিস্ট হিসেবে কাজ চালাচ্ছিলাম, কিন্তু কাজের মাঝে নিরন্তর খুঁজে চলতাম দূরেজার ইনস্টিটিউট থেকে যেটুকু বিদ্যা শিখে এসেছি তা কিভাবে, কোথায় প্রয়োগ করা যায়! সুযোগও এলো।
তখন মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালের ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হত কোমরের যন্ত্রণায় ট্র্যাকশন নিতে। আগেই বলেছি, তখনো পর্যন্ত আমাদের জানার মধ্যে ব্যথার জন্য ওটাই সবচেয়ে কার্জকরী চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল। এমনই একজন রোগীকে খুঁজে পেলাম। সুব্রত রায় নামের এক ভদ্রলোক স্লিপড ডিস্ক নিয়ে প্রথমে প্রায় এক মাস যাবৎ কল্যাণীতে, তারপর মানিকতলায় আমাদের হাসপাতালে প্রায় দেড় মাস শয্যাশায়ী হয়ে ভর্তি ছিলেন। এনেস্থেশিয়া চেকআপ করতে গিয়ে প্রথমেই বুঝতে পারি ওনার স্লিপড ডিস্ক হয়েছে।
আমি চাইছিলাম সুব্রতবাবুর ওপর আমার শেখা বিদ্যা প্রয়োগ করতে- প্রায় নিশ্চিত ছিলাম উনি তাতে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু বিষয়টি সহজ ছিল না। সুব্রত বাবু যে ডাক্তারের অধীনে ভর্তি ছিলেন তাঁকে গিয়ে ওই রোগীকে দেখার অনুমতি চাইলাম! বললাম স্লিপড ডিস্কের চিকিৎসায় ওজোন প্রয়োগ পদ্ধতি শিখে এসেছি, আপনার এই রোগীর ওপর তা প্রয়োগ করতে চাই। উনি আপত্তি করলেন না বটে, কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ করলেন আদৌ এই পদ্ধতিতে কোন কাজ হবে কিনা! আমি একপ্রকার নাছোড় হয়ে ওনাকে বললাম “দেখি না করে কি হয়”!!! পেশেন্টের ডাক্তার রাজি হওয়ার পর রোগীও রাজি হয়ে গেলেন। পরের শনিবারে মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে ওজোন ইঞ্জেকশান দিলাম। দেখা গেল দুদিন পর থেকেই রোগী হাঁটতে শুরু করেছেন। আমি তৈরীই ছিলাম- পেশেন্টের হাঁটার আগের এবং পরের ছবিগুলো নিয়ে সুপারের কাছে দৌড়ালাম। এটা দেখে সুপারও দারুণ খুশি হয়েছিলেন। তিনি বলেন শয্যাসায়ী রোগী যখন হাঁটছে তার মানে এটা বেশ ভালো ব্যাপার। আমার সামনে, হাসপাতালের স্টাফেদের সামনে বা সুপারের সামনে ঘটনাটা ঘটা একরকম – কিন্তু বাইরের লোকেরা বিষয়টা মানবে কেন? তখন সুপার বলে দিলেন সমস্ত ঘটনা যদি রোগী নিজেই লিখে দিতে পারেন, তবে বিষয়টা মান্যতা পেতে সুবিধা হয়। দুদিন আগে যে রোগী শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি আবার হাঁটতে পারছেন- স্বাভাবিকভাবেই রোগীর লিখিত বয়ান দিতে কোন আপত্তি ছিল না। এর পর থেকে হাসপাতাল জুড়ে একটা সাড়া পড়ে যায়। এই ঘটনা আমারও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল, আমি চিকিৎসা করার জন্য এই ধরনের রোগী খুঁজতে থাকি।
কিন্তু এনেস্থেটিস্টের কাছে রোগী কোথায়? তখন ইএসআই হাসপাতালের ফিজিকাল মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে ছিলেন ডাক্তার আশীষ কুন্ডু, যিনি নিয়মিত রোগী দেখতেন, রোগীদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন, ওঁর এক একটা আউটডোরে প্রায় দু’শোর মত রোগী হতো। রোগীর চাপে নাজেহাল অবস্থা আর কি!! এতো রোগী ওঁকে একাই দেখতে হতো। আমি ওঁকে রোগী দেখতে সাহায্য করার কথা বলায় তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। জানতাম ওঁর ওখান থেকে প্রচুর ব্যথার, বিশেষ করে স্লিপড ডিস্কের রোগী পাব। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল ওই রোগীদের ওখান থেকে নিয়ে এসে ওজোন প্রয়োগ করে চিকিৎসা করা।
এই পর্যন্ত কাজ গোছানো গেলেও অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ তখনও বাকি ছিল। এনেস্থেটিস্ট হিসেবে ইএসআই-এ পোস্টিং ছিল। তাই সুপার অনুমতি না দিলে আমি আউটডোরে বসতে পারবো না, অন্যদিকে ডিপার্টমেন্ট কখনোই আমাকে ছাড়বে না। সুপারকে বললাম, তিনি বললেন এটা তো ভালো প্রস্তাব। তুমি আউটডোরে রোগী দেখতেই পারো। কিন্তু আউটডোরে বসলেও তোমায় তোমার ডিপার্টমেন্টের কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতেই হবে। তাই হল। ফার্স্ট হাফে অপারেশনে এনাস্থেসিয়া দিতাম। এরপর নিচে নেমে আশীষদার সঙ্গে রোগী দেখতে বসে যেতাম। রোগী দেখতাম এবং যে রোগীর যেখানে প্রয়োজন- যেমন সোল্ডার জয়েন্টে বা কোমরে বিভিন্ন জায়গায় ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা করা হতো। এগুলো প্রায় সবই আমাকে আউটডোরেই করতে হত। কিছু রোগীকে ওটি-তে সিআর্ম যন্ত্রের সাহায্যে ইনজেকশন দেওয়ার দরকার পড়ত, কিন্তু মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালে সহজে ওটি পাওয়া যেত না।
মঙ্গলবারগুলোতে প্রতিদিনের কাজ সেরে সেকেন্ড হাফের দুপুর দুটো থেকে ওটি করতাম। কোনোদিন পাঁচ-ছ’জন রোগী আসত। তাদের সমস্ত তথ্য বিস্তারিতভাবে খাতায় নোট করতাম। তখন মানিকতলার ওটিতে একটাই সি-আর্ম মেশিন ছিল। সেটা কাজে লাগাতাম। কিন্তু সমস্যা হল OT Boy-দের সেকেন্ড হাফে কাজ শেষ হয়ে যেত, তাদের বাড়ি যাওয়ার তাড়া থাকত। ওরা কেন ওই সময় থাকবে? আমি ওই OT Boy-দের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলি। ওদেরকে বোঝাই রোগীরা ব্যথার চোটে এত কষ্ট পাচ্ছে, আপনারা একটু যদি বাড়তি সময় দেন আমরা ওনাদের ব্যথা কমাতে পারি, আর একসঙ্গে কাজ করার সময়, একটা মজাদার পিকনিকও জমাতে পারি। এই কথায় কাজ দেয়। হৈ হৈ করে কাজ শুরু হয়ে যায়। কাজের শেষে লাড্ডু, সিঙ্গারা এসব এনে পিকনিক করতাম আমরা। সবাই খুশি। ওরা বলতো ডা. গোস্বামী খুব ভালো লোক। আমার উপলব্ধি, টেকনিশিয়ান বা OT Boy-দের মত কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রেখে চিকিৎসা করলে আখেরে সব কাজটাই ভালো হয়। এমন বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে রোগীরাও তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে থাকে।
কিন্তু এবার বিপত্তি হল অন্য জায়গায়। আগেই বলেছি হাসপাতালে একটাই সি-আর্ম মেশিন ছিল, গোল বাঁধলো সেটা নিয়েই। আমাদের এসব কর্মকাণ্ড অর্থোপেডিক্সের ডাক্তারদের কানে গিয়েছিল। তাঁরা এসে সুপারের কাছে আপত্তি জানান। ওনাদের ভয় “ডাক্তার গোস্বামী কি সব করছে- মেশিনটা না বিগড়ে যায়!” অর্থোপেডিক্সের একটাই সি আর্ম মেশিন ইএসআই মানিকতলাতে, যদি খারাপ হয় তাহলে অর্থোপেডিক্সের অপারেশন বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁদের যতই বোঝানো হয় যে নষ্ট কেন হবে? নিয়মিত কাজ করা হচ্ছে!! কিন্তু তাঁরা শুনতে চাননি।
আমি ডান হাতে শুধু গ্লাভস পড়তাম আর বাম হাতে ফ্লুরোস্কোপের সি-আর্মটাকে ঘোরাতাম, একই সঙ্গে পা দিয়ে মেশিনের সুইচ অন অফ করতাম। সব কাজটা আমাকে একাই করতে হতো, অদ্ভুত ব্যাপার হলো হাসপাতালে তখন কোনো ফ্লুরোস্কোপ চালানোর লোক ছিল না, নতুন করে কেউ রাজি নয় ওই কাজ করতে। এই করতে করতেই একাধিক বার অর্থোপেডিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে সুপারের কাছে অভিযোগ জমা হতে লাগলো,–“এবার মেশিনটা খারাপ হয়ে যাবে”। কেউ কেউ বলল “OT-র দিনে করো এসব”। ভীষণ বিরক্ত লাগত, ভাবতাম এভাবে কাজ করা যায়! এমন চলতে চলতেই সত্যিই হঠাৎ এক শনিবার দেখি মেশিনটা আর চলছে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই দোষটা আমার উপর এলো। আমি সুপারকে বুঝিয়ে বললাম, “এটা আমার হাতে হয়নি”, তখনো আমার কাজ তেমনভাবে শুরুই হয়নি। সুপার হয়তো ঘটনাটা বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু হাসপাতালের পরিস্থিতি সামলানোর জন্য উনি সি-আর্ম নিয়ে আমাকে আর কাজ করতে দেননি।
উনি নিজে থেকে প্রস্তাব দেন একজন সি-আর্ম অপারেটর লাগবে, কিন্তু এমন কম সময়ে সি-আর্ম অপারেটর কোথায় পাবো? খোঁজ শুরু হলো, বহু খোঁজার পর সতীশবাবুর খোঁজ পাওয়া গেল, যিনি তখন সদ্য চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, থাকেন বাগুইআটিতে। আমাদের তখন হাতে চাঁদ পাওয়ার মত অবস্থা, একজন পরিচিত ডাক্তারের মাধ্যমে ওর ফোন নাম্বার জোগাড় করে সতীশবাবুকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি কাজ করবেন, কিন্তু কেস প্রতি তাঁকে পারিশ্রমিক দিতে হবে, এই শর্তেই তিনি রাজি হয়েছিলেন। সেটা আমার পকেট থেকেই গিয়েছিল। যাই হোক খুব খুশি হয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। সতীশবাবুকে সঙ্গে নিয়ে দিনে একসঙ্গে প্রায় ৬-৭ টা করে কেস মেটানো যেত। এতে আমি তো খুশি ছিলামই, রোগীরাও খুশি এবং সুপারও আপত্তি তুলতেন না। বেশ এগোচ্ছিল কিন্তু আবার বিপত্তি। ফের মেশিন বিগড়ালো, কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও কেন খারাপ হল সেটা জানা গেল না। আবার সবার আপত্তি ওঠে। পেইন-ম্যানেজমেন্টের কাজ করতে করতেই বারবার মেশিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে– এবার এটা বন্ধ হোক বলে দাবী তোলেন ওঁরা। ফলস্বরূপ মানিকতলা ইএসআই-তে পেইনের যা কাজ হচ্ছিল, তা সবটা বন্ধ হয়ে যায়। আমি খুব আশা নিয়ে পেইন-ম্যানেজমেন্টের চিকিৎসা শুরু করেছিলাম। কাজটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার জেদ চেপে গেছিল– সোজা চলে যাই ইএসআইয়-এর ডিরেক্টরের কাছে। গিয়ে বলি, “স্যার, আপনি তো বলেছিলেন কাজগুলো এখানে করতে! কিন্তু এখানে বোধহয় হবে না। আমাকে অন্য কোথাও এই কাজ করার ব্যবস্থা করে দিন।“ শিয়ালদা ইএসআই হাসপাতালে তখন শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত অর্থোপেডিক্সে ছিলেন। তিনি আমাকে সাজেশন দিলেন- “তুই শিয়ালদা চলে আয়, আর ওখানেই এপ্লাই কর”। পরে শান্তিবাবু নিজেই ডিরেক্টর সাহেবের কাছে আবেদন করেন, আমাকে যেন পেইনের কাজ করতে দেওয়ার জন্য শিয়ালদা ইএসআই-তে ট্রান্সফার করা হয়।
চলবে…
অনুলিখন: শুক্লা সরকার ও পিয়ালী দে বিশ্বাস