প্রথমেই করজোড়ে স্বীকার করছি, প্রয়াত কেকে এবং জনমানসে তাঁর প্রভাব নিয়ে আমার খুব একটা ধারণা ছিল না। এখন দেখছি বিভিন্ন সময়ে খুব ভালোলাগা কিছু গান আসলে ওঁরই গাওয়া – যেমন ‘তড়প তড়প’, ‘আঁখো মে তেরি’, ‘তু যো মিলা’ ইত্যাদি। এখন আফশোস হচ্ছে। অনুগ্রহ করে উন্নাসিকতা ভাববেন না। বাস্তবে আমার শোনা-জানা-দেখার পরিধিটি খুব ছোট, এ তারই প্রকাশ। সেজন্য আমি লজ্জিত। ওঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করি – যদিও জানিনা এখন তার মূল্য কতটুকু।
কদিন ধরেই ওঁর আকস্মিক মৃত্যু নিয়ে নানারকম চাপান-উতোর শুনছি, দেখছি, পড়ছি। তার উপরে একজন বাঙালী গায়কের অবিমৃষ্যকারী বিবৃতি জল আরও ঘোলা করে তুলেছে। দোষী খোঁজার পালা চলছে, সি বি আই এর দাবিও উঠে গেল। এ পোড়া দেশে সবকিছুতেই রাজনীতি নাক গলায়, এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। সেসব চলুক – ওঁর পরিবার নিশ্চয় এসব থেকে দূরে এই অপূরণীয় ক্ষতির সাথে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
আমার এ অকিঞ্চিৎকর লেখাটি একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে। চরম দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু সম্ভবত এড়ানো যেত, এমন ঘটনাটির একটি নির্মোহ বিশ্লেষণের প্রয়াস। বলার চেষ্টা করব, কোনও দুর্ঘটনার আগে কিভাবে অনেকগুলি বিপজ্জনক অভ্যাস বা পরিস্থিতি (risk behaviour or risk factor) একত্র হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা যন্ত্র এগুলির চিহ্নিতকরণে বা প্রতিকারে ব্যর্থ (failure) হয়, তার থেকে আসে বিপদ (hazard) এবং পরিণামে একটি চূড়ান্ত ক্ষতি (damage or loss)। এগুলি Risk Management এর গোড়ার ধারণা বা Concept । পাশ্চাত্যে ডাক্তারি ছাত্রদেরও এটি অবশ্যপাঠ্য, এদেশে কোথাও পড়ানো হয় কিনা আমার জানা নেই।
নিচের ছবিটি (diagram) একটু দেখুন। Risk Management বিজ্ঞানে এটিকে বলা হয় Swiss Cheese Model। সুইটজারল্যান্ডের ঘরে তৈরী চিজে এরকম অজস্র ছিদ্র থাকে। আমাদের ছোটবেলায় পাঁউরুটিতেও এ ধরণের ফুটো থাকত, এখন দেখা যায় না। মজার বিষয় হল, চিজের বড় খণ্ডটিকে যদি স্লাইস করা হয়, প্রতিটি স্লাইসের ছিদ্রগুলি সচরাচর এক সরলরেখায় থাকে না, মানে কোনও কাঠি বা তির সবকটি ছিদ্রের ভিতর দিয়ে সোজাসুজি যেতে পারে না। কিন্তু কোনও বিরল দিনে যদি একসারি ছিদ্র কোনওভাবে একই লাইনে চলে আসে, তাহলে কিন্তু একটি তির বা কাঠি সবকটি স্লাইস ভেদ করে যেতে পারে অনায়াসে।
এবারে এই ধারণাটিকে ‘আপদ নিয়ন্ত্রণ’ বা Risk Management এ প্রয়োগ করা যাক। এই ছবিটিতে বোঝানো হচ্ছে যেকোন বড় কাজ সম্পাদনের সময় উচ্চতম থেকে নিম্নতম প্রত্যেক স্তরে সম্ভাব্য ছিদ্র (ভুল বা গাফিলতি) থাকতে পারে। কিন্তু সম্ভাব্যতার সূত্র মেনেই প্রতিটি স্তরে একইদিনে একইসাথে ভুল বা গাফিলতি হল – সৌভাগ্যবশত এ জিনিস সচরাচর হয় না। আরও সহজভাবে বললে, একজনের ভুল অন্য কারুর চোখে ঠিক ধরা পড়ে যায় এবং সেটি সংশোধন হয় – এভাবে বড় বিপদ বা ক্ষতি এড়ানো যায়। উল্টোদিকে, কোনও কাললগ্নে যদি একসাথে সমস্ত স্তরের সকল নজরদারিতে ঢিলা পড়ে, অর্থাৎ সুইস চিজের সমস্ত ছিদ্র একই সারিতে চলে আসে, কালান্তক বিপদের তির সে পথে ঢোকে – এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে চলে যায়।
আশাকরি বোঝাতে পারলাম।
এবারে দেখা যাক, সেদিন নজরুল মঞ্চ এবং ওবেরয় গ্রান্ডে কি কি বিপজ্জনক পরিস্থিতি বা কাজ হয়েছিল, তাদের সম্ভাব্য কারণগুলি কি ছিল এবং সেগুলি প্রতিরোধে কি কি করা যেতে পারত।
(১) একটি বদ্ধ স্টেডিয়ামে আড়াই হাজারের জায়গায় সাত হাজার লোক। এর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণ আমাদের সকলের জানা। আজকের বাংলায় এই জিনিস প্রতিরোধের উপায় আমার জানা নেই, কেউ বলে দিলে বাধিত হব। ছবি অনুসারে এটিকে বলা চলে অবাঞ্ছিত Organisational influences।
(২) শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বিকল হয়ে পড়া এবং/বা বন্ধ করে দেওয়া। এটি প্রথম কারণের সাক্ষাৎ ফলাফল। তার ফলে বদ্ধ জায়গায় অসহনীয় গরম, আর্দ্রতা এবং অক্সিজেন এর অভাব। মধ্য পঞ্চাশের একজন শিল্পী যিনি ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ওই চড়া আলোর নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টানা দেহ সঞ্চালন করে গান করছেন বা তাঁকে করে যেতে হচ্ছে, তাঁর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। যেকোন সম্পূর্ণ সুস্থ যুবক অসুস্থ বোধ করবেন। এসি চালানো নিয়ে নিশ্চিত কোথাও মারাত্মক গোলমাল হয়েছিল – সেটা রেষারেষি বা টেকনিক্যাল কারণে যাই হোক। সদিচ্ছা ও সততা থাকলে তা নিশ্চয় জানা সম্ভব। এটি অবশ্যই unsafe supervision এর একটি নমুনা।
(৩) প্রয়াত শিল্পী কেকের বয়স তিপান্ন। মধ্য চল্লিশ থেকে মধ্য পঞ্চাশের হার্ট অ্যাটাক সাধারণত কালান্তক যম, যদি না অতি দ্রুত সঠিক চিকিৎসা শুরু করা যায়। তার উপরে এরকম একটি পেশা – অক্লান্ত পরিশ্রম, অনিয়ম, অনিদ্রা, উদ্বেগ, প্রতিযোগিতা যেখানে নিত্যসঙ্গী। আজ বিখ্যাত স্বর্গত গায়কের এহেন মৃত্যুতে আসমুদ্রহিমাচলে আলোড়ন উঠেছে। জেনে রাখা ভাল, কর্পোরেট সেক্টরে, ডাক্তারি পেশায় এই বয়সে এরকম হার্ট অ্যাটাক এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যু অহরহ ঘটে। হতে পারে, প্রয়াত গায়কের শরীর আগে থেকেই সিগন্যাল দিয়েছিল – হার্টটি ঠিক ছন্দে নেই। হয়তো সে বার্তা তিনি ধরতে পারেননি, বা পেশার চাপে নিজের প্রতি সময় দিয়ে উঠতে পারেন নি। হার্টটি compromised হয়েই ছিল – সেদিনের ওই অসহনীয় পরিস্থিতিতে ওইরকম ধকল আর সে সহ্য করতে পারেনি।
(৪) হয়তো কেকে নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন শুধু গরম বা আর্দ্রতা নয়, শরীরে অন্য কোনও ঘোরতর সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এও জানতেন অসুস্থতার কারণে এত বড় অনুষ্ঠান মাঝপথে বন্ধ করলে এদেশের রীতিমাফিক স্টেডিয়ামে আগুন জ্বলবে, হয়তো সদলবলে নিগৃহীত হবেন। অনুষ্ঠান বন্ধ ত অনেক পরের কথা, শুধু ভাবুন তো, উনি যদি বলতেন – ‘আজ দাঁড়িয়ে নয়, একটা চেয়ার নিয়ে বসে গান করি’ – ওই শ্রোতাকুল তাঁকে ছেড়ে দিত? সুতরাং ওঁকে টেনে যেতে হয়েছে ওই নারকীয় অবস্থার মধ্যেও। উপরের সম্ভাব্য কারণদুটি বলা যেতে পারে preconditions to unsafe act বা actual unsafe act।
(৫) যেখানে কয়েক হাজার লোকের সমাবেশ, কোনও অ্যাম্বুল্যান্স ছিল? যদি স্টেজেই উনি বুকে হাত দিয়ে বসে পরতেন? বা অন্য কেউ অসুস্থ হতেন? তখন গাড়ির খোঁজ পড়ত! এ এক অকল্পনীয় গাফিলতি। তাছাড়া এই মাপের অনুষ্ঠানে ফায়ার এঞ্জিনও থাকার কথা। ছিল? ছিল জানলে আশ্বস্ত হব। এ বিষয়ে কড়া সরকারি নির্দেশ থাকার কথা। কিন্তু হয়নি। আর থাকলেই বা এ রাজ্যে কে মানে! এটি ত অবশ্যই unsafe supervision।
(৬) অসুস্থ মানুষটিকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে একটি বড় হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে আনা হল কমপক্ষে আধঘন্টার দূরের হোটেলে। শোনা যাচ্ছে গাড়িতে উনি আক্ষরিক অর্থে ছটফট করছিলেন। হোটেল লবিতেও অনেকটা হেঁটে তবে লিফট। হইলচেয়ার পর্যন্ত ব্যবহার হয়নি। কার সিদ্ধান্ত? কেকে র নিজের? ভক্তদের কাছে অসুস্থ প্রমাণিত হওয়ার লজ্জা? শরীরের কষ্টকে লঘু বলে অস্বীকার? তাঁর ম্যানেজারদের সিদ্ধান্ত? তাঁরা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারেন নি? যে কারণই হোক, এই শেষ ছিদ্রটি একেবারে শেষ পেরেক হয়ে গেঁথেছে, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। গ্রান্ডে পৌঁছানোর অনেক আগে ঢাকুরিয়া আমরি পৌঁছে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে হয়ত….. resuscitation, thrombolysis, defibrillator, pacemaker, primary angioplasty… হয়ত তাতেও মৃত্যু হত, তবে বিনা চিকিৎসায় এভাবে বেঘোরে মারা পড়তেন না। অবশ্য সেখানে মৃত্যু হলে সে হাসপাতাল আর তাঁর ডাক্তারবাবুদের কি অবস্থা হত, সেকথা ভাবতেও শিউরে উঠি। যাইহোক, এই শেষ পর্যায়টি হল active failure বা actual unsafe act।
আশাকরি বোঝাতে পারলাম, যখন এরকম কোনও মারাত্মক দুর্ঘটনা (serious incidence) ঘটে, কেবলমাত্র একটি বা কোনও নির্দিষ্ট একজনের ভুলে (omission) বা গাফিলতিতে (commission) এ জিনিস হয়না। চেইন রিঅ্যাকশনের মতো একের পর এক ভুল ঘটতে থাকে, অর্থাৎ সুইস চিজ মডেল অনুযায়ী সমস্ত ছিদ্রগুলি এক সরলরেখায় চলে আসে – বিপদের মারণ বাণ বিনা বাধায় একের পরে এক ছিদ্র পার হয়ে চরম ক্ষতিটি করে দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমরা কিছুই না বুঝে, কিছুই না খোঁজার চেষ্টা করে – কেউ বলি নিয়তি, কেউ বলি নসিব, কেউ destiny।
আর যেসব সমাজ একটু আধটু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে, তাঁদের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটলে নিয়মিত প্রথামাফিক বিশ্লেষণ (root cause analysis) করেন। ঝুঁকির চিহ্নিতকরণ ও মূল্যায়ণ (risk identification and evaluation) করা হয়। সেই অনুসারে সম্ভাব্য ও ঘটে যাওয়া বিপজ্জনক অভ্যাস বা পরিস্থিতিগুলির দূরীকরণ বা নিয়ন্ত্রণ (risk elimination and risk containment) করা হয়। তবে সেসব ভেবে আর লাভ কি! আমরা ত গালিগালাজ করছি!
পুনশ্চঃ এ লেখার উদ্দেশ্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা (blaming approach) নয়। কিভাবে একটি serious incidence কে ব্যাখ্যা করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা প্রতিরোধে চিন্তাভাবনা করা (failure mode and effect analysis বা FMEA) উচিৎ, সেদিকে আলোকপাত করা। অর্থাৎ যাকে বলে learning from mistake। নিজেদের শরীরের দিকেও নজর রাখুন, শরীরের নূন্যতম সংকেতেও একবার যাচাই করে নিন – সত্যিই all is well আছে কিনা। আপনার জন্য দেওয়া গান স্যালুট অন্যরা উপভোগ করতে পারে, আপনি কখনওই নন।