বাঙালি পুরুষ যে কারণে বহুদিন আগেই ধুতি ছেড়ে প্যান্ট শার্ট ধরেছে, একই কারণে বাঙালি মেয়েও বাধ্য হয়ে শাড়ি ছেড়ে অন্য পোষাকে গেছে। আমার ছাত্রাবস্থায় দু চার জনকে সালোয়ার কামিজে দেখতাম। এখন ওই রকমের কম বয়সী মেয়েদের দু চারজনকে শাড়ি পরতে দেখি।
আমার বাল্যের মুর্শিদাবাদ-বেলায় ঢেঁকিতে পাড় দিত যে মেয়েরা, পরে বুঝেছি কেন তারা দৃষ্টিনন্দন ভাবে না পরে উঁচু করে শাড়ি পরত। কেন ওরা সবাই, ওই যারা মীন ধরে মাতলা রায়মঙ্গলের কিনারায় পাড়ে পাড়ে, যারা এক হাঁটু কাদায় পা গেঁথে বীজতলা থেকে তুলে আনা ধানচারা পোঁতে, মদেশিয়া যে মেয়েরা দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তোলে চা বাগানে, ভাঙা রাস্তায় গলিত পিচ ছেটায় সবাই কেন দৃষ্টিনন্দন ভাবে শোভিত না হয়ে উঁচু করে শাড়ি পরে…
অনেকে বলেন, অন্য পোষাক পরবার জন্য নাকি ফিগার ভালো হতে হয়। সব ফিগারে, বিশেষ করে পৃথুলাদের নাকি শাড়ি ছাড়া অন্য পোষাকে…। একটা পুরোনো গল্প বলি। কলকাতায় প্রথম এসে যেখানে চিনে খাবারের ‘হাতে খড়ি’ থুড়ি ‘মুখে চাউ’ হয়েছিল তার নাম ছিল ‘মাম্মিস’। আহা, সেই দেবভোগ্য পর্ক চাউমিন যেন এখনও জিভে লেগে আছে। কোন সাইনবোর্ড ছিল না। সেই সাধনপীঠের কিচেন আর তৎসংলগ্ন ডাইনিং স্পেস মিলিয়ে সাইজ ছিল আন্দাজ দশ ফুট বাই বারো ফুট। তার একধারে বসে প্রবল প্রতাপময়ী ও করুণাময়ী সেই মা ঝড়ের বেগে ওপাশ ফিরে ছাঁকছেন, ভাজছেন, কুটছেন, ধুচ্ছেন। আবার চকিতে এপাশে ফিরে বুভুক্ষা সামলাচ্ছেন। সস ছিটিয়ে দিচ্ছেন প্লেটে। মাম্মিসএর সেই মা, আয়তনে এখন আমি যা তার চারগুণ। ওই ছোট্ট জায়গায়, শাড়ি পরে কিছুতেই ওই দক্ষযজ্ঞ সামলানো সম্ভব হত না। সেই মহীয়সী প্যান্ট শার্টই পরতেন। কই দেখতে খারাপ লাগতো না তো!
পুরুষেরা অনেকেই, ইনক্লুডিং মাইসেল্ফ, একধরণের
মিনমিনে দর্শকামী। তারা চিরকাল ন্যাকার মত খোঁজে রাইকিশোরী। বৃষভানুর সেই কন্যাটি শাড়ি আদৌ পরত কিনা সেটা ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু রাইকিশোরীর জন্য একধরণের চিরকালীন হাহাকার পুরুষদের। বাঙালি বলে নয়। যুগে যুগে৷ দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে। বিয়েটিয়ে করেছেন এমন মহাপুরুষও নাকি স্ত্রী হিসেবে…
যাক গে যাক। হচ্ছিল তো শাড়ির কথা। এই রাইকিশোরী আসক্তিই বাঙালি পুরুষকে দিয়ে একদা লিখিয়েছে, চলে নীল শাড়ি নিঙারি নিঙারি…
তার চোখে শাড়িতেই রাইকিশোরীর সৌন্দর্যের চূড়ান্ত বিকাশ। ন্যাকামি। বিশুদ্ধ ন্যাকামি। নইলে শাড়ি-ম্যানিয়ার মানসিক রোগ।
কেন রে বাপু?
ওই মেয়েটা রোজ তেপ্পান্ন কিলোমিটার দূরের ভার্সিটিতে পড়তে যায় বা পড়াতে যায়, আপিস কাছারিতে যায়, হাসপাতালে যায় ডাক্তারি আর সিস্টারি করতে। যায়, অন্যদের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই সমান তালে, গুঁতোগুঁতি করে, বাসে ট্রেনে কুস্তি করতে করতে, শুনতে খারাপ লাগলেও কনুইবাজি সহ্য করতে করতে, অন্যথায় ধেয়ে আসবে সেই উপদেশ,- অত অসুবিধে হলে নেমে ট্যাক্সিতে… যেন ওই বদমায়েশিটা গণতান্ত্রিক অধিকার।
এত সব সামলে মেজাজ সামলে শাড়ি সামলানো? না যায় না। সত্যিই যায় না। তার চাইতে ব্যাকপ্যাকটা আত্মরক্ষার্থে সামনে ঝুলিয়ে ভিড়ের যাত্রায় জিনস টপের ওই যে বিজয়িনী, তার মত সুন্দরী কে?
এই ভিড়ের কথা বললে একটা ব্যবহারিক দিকের কথা বলতেই হয়। পাটভাঙা শাড়ি প্রতিদিনের এই যুদ্ধশেষে পাটভাঙা থাকে না। এর মধ্যেই একটা হতক্লান্ত দিনের পরে এসে পড়ে আর একটা লড়াইয়ের দিন। সেই শাড়ি ধোয়া, তাকে মাড় দিয়ে অথবা না দিয়ে ইস্ত্রি করে সজুত করা প্রায় অসাধ্য এক ব্যাপার। ছোটোবেলায় মাকে দেখেছি গলদঘর্ম হতে। পরে গিন্নিকেও। অন্য পোষাক ঠিক রাখা অনেক সোজা। অবিন্যস্ত দলামোচা পোষাকের চেয়ে বিন্যস্ত পোষাক অনেক বেশি আকর্ষণীয়। অন্তত যার ঘটে কিছু বুদ্ধি আছে তার কাছে।
ব্যবহারিক অন্য আর একটা দিকের কথা বলি। একটু অস্বস্তিকর যদিও। বাঙালি মেয়েদের নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাসের ব্যাপারটা খুব প্রাচীন সম্ভবত নয়। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি অবধি সেমিজ নামের একটা হাঁসজারু গোছের বস্তু পরতেন দিদিমা ঠাকুরমারা। তার পর এলো শায়া, যার ভালো নাম পেটিকোট। এখনকার মেয়েদের অন্তর্বাস অন্যরকম। এবং নানা ব্যবহারিক কারণেই সেটি বেশি উপযোগী। সে কথা থাক। কথা হল যে মেয়ে জোগাড়েটি কড়াই ভর্তি আধা তরল কংক্রিটের মশলা নিয়ে তরতর করে উঠছে বাঁশের সিঁড়িটা বেয়ে, তার কাছে কিন্তু ওই শাড়ি না পরে নতুন অন্তর্বাসের ওপর অন্য পোষাক পরা বেশি সুবিধার আর বেশি শ্লীলও।
শ্লীলতা অশ্লীলতার প্রশ্ন যখন উঠলই, তবে বলি, শ্লীল আর অশ্লীল, দুটোই, শাড়ি, গাউন, ফ্রক, বিকিনি, সব কিছুতেই সম্ভব। আজ্ঞে হ্যাঁ, শাড়িতেও।
নান্দনিকতার কথা যদি ওঠে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই মেয়ে। তাদের মধ্যে কজন শাড়ি পরে? তার জন্য কি সারা পৃথিবী অনান্দনিক হয়ে গেছে নাকি? পুরোটাই চোখের দেখার আর অভ্যেসের ব্যাপার। স্রেফ পুরুষ চাইছে বলে শাড়ি, হিজাব, বোরখা, পা ছোটো রাখার লোহার জুতো, গলা লম্বা করার জন্য গলায় ধাতুর বেড়ি?
না, কিছুতেই না। নিজের যেটি ভালো লাগে সুবিধে হয় সেটিই। যদি শাড়ি পরে শান্তি লাগে…শাড়ি। যদি অন্য পোশাকে সুবিধে হয় সেটিই। সব পোষাকেই সে বিজয়িনী।
এই লেখাটা লিখছি, এমন সময়ে গিন্নি এসে খোঁচাল। চেপে যেতে চাইছিলাম। মেয়েদের সাজপোশাকের ইনট্রিকেট ব্যাপার বলে কথা। কিন্তু কোনও দিনই যা পারিনি, আজও পারলাম না। ফাঁস করতেই হল সাম্প্রতিক ফেসবোকামির কথাটা।
শুনেই বাঁকা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলল,- তা হলে নিজের মেয়ের দিকেই খুব চেপে লিখছো তো, হ্যাঁ গো?
গিন্নি নিজে আজ অবধি ওই শাড়িই। অন্য পোষাক মোটে নেই তা নয়। গত বছরও তার নিজের ভাইকে টুপি দিয়ে খান কতক সেট্ কেনা করিয়েছে। নিজেও কিনেছে কয়েকখানা। কিন্তু পরেনি। লজ্জায়। অনভ্যাসের ফোঁটায় কপাল চড়চড় করবে ভেবেই হয় তো। তা সেই দোষ কি আমাদের বাপ বেটির?
না, আমি তাকে মনে করিয়ে দিইনি। এই সেদিন অবধিও সরকারি হাসপাতালে সিস্টারদের পোষাক ছিল হয় ইউরোপীয় কায়দায় সাদা খাটো গাউন আর লম্বা সাদা মোজা, নইলে সাদা শাড়ি। সরকারি হাসপাতালে অনেক রোগীই মেঝেতে থাকে। ওই পোষাকে আক্ষরিক অর্থেই মেঝের রোগীকে সেবা দেওয়া বেশ অস্বস্তিকর। তো সেই সিস্টারদের জন্য সাদা সালোয়ার কামিজ যখন মেনে নিল প্রশাসন, আমার সঙ্গে আমার গিন্নিও উল্লসিত হয়েছিল সে দিন।
অন্য জন্মে আমার মেয়েরই লেখা, পোষাক নিয়ে ঠিক নয়, রোজ দিনে তার যুদ্ধ নিয়ে লেখা…। সেই অনামিকার একটা লেখা, পড়বেন বাবু বিবিরা?
★
তোমার সঙ্গে দেখাই হয় না সচারচর ।
যুদ্ধে গেছি, এখন আমার মুখে আঁচড়,
সর্ব অঙ্গে কালশিটে আর রক্তদাগে…
ভাবছো বোধ হয়, দেখতে আমায় কেমন লাগে!
তুমিও খুব লড়াই করছো, খবর রাখি,
ফিজিক্স ল্যাবে-এর রণক্ষেত্রে ঝড়ের পাখি !
তার মধ্যেই যখন দহন ব্যক্তিগত…
সংযতবাক হাসছো মেয়ে, ঢাকছো ক্ষত…
আমার ক্ষত ওই রকম না, অন্য রকম !
মার খাচ্ছি প্রকাশ্যে আর হচ্ছি জখম ।
ফুটপাথে শুই, কান্না জমাই, ভিক্ষাপাত্রে।
স্মাগলিংএ যাই, সীমান্ত পার, গভীর রাত্রে।
রঙ মেখে হই, রেড লাইটের কুজ্ঝ্বটিকা ।
সিকিউরিটির দাপট সইছি, সেলস -বালিকা।
ভোর রাত্রে রওনা হলাম, সামনে সকাল…
সল্টলেকে যাই, কাজের মেয়ে, ক্যানিং লোকাল।
ভোট রয়েছে তালাক রোখার নেই অধিকার,
আমিই সকল দাঙ্গাতে হই নগ্ন শিকার!
পণ না পেলে, আগুন আসেন বদ্ধ ঘরে…
তবুও বাঁচি, মরতে আমার ঘেন্না করে!
শুধোও যদি, রোজ কেন বা জন্মেছিলাম?
ঠিক জানিনা। বাঁচছি । বাঁচার হিসেব দিলাম!
খুব লড়েছি-জয় আসেনি-হয়নি হারও…
তোমার যমজ বোনটাকে কি চিনতে পারো?”
নমস্কার ডাক্তারবাবু। খুব ভালো লাগলো। বলতে খারাপ লাগলেও কথাটা সত্যি যে পুরুষ মানুষ ‘বাবা’ না হলে মহিলাদের সমস্যা বুঝতে পারেনা। আরো বিরক্তিকর ব্যাপার টা হলো মহিলাদের পোশাক নিয়ে মহিলারাই বেশী সমালোচনা করেন!
কিছু বলতে গিয়ে ভাষা হারালাম। নারী পুরুষের পোশাকের বিবর্তন কিন্তু প্রয়োজনের স্বার্থেই হয়েছে।