দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ২৭
দু’ দিনের জ্বর আর সারা গায়ে ব্যথা। ডাক্তারবাবু রোগীর গায়ে হাতও দেবেন না, জিজ্ঞেস করেও দেখবেন না সাথে আর কী কী রোগলক্ষণ বা উপসর্গ আছে। আউটডোর পেশেন্ট হলে লিখে দেবেন Augmentin বা cefixime এর মতো অ্যান্টিবায়োটিক। আর হাসপাতালে ভর্তি করতে হ’লে খসখস করে লিখবেন Injection Ceftriaxone- দু’ গ্রাম করে দিনে দু’বার। ডাক্তারবাবুর নামের পাশে এম ডি মেডিসিন। ডাক্তারি করছেন তা হয়ে গেল তিরিশ বছর। ডাক্তারবাবু আরও উৎসাহী হ’লে বা ডাক্তারিটা ‘আরও ভালো’ জানলে রোগীর মাত্র একখানা অ্যান্টিবায়োটিকে মুক্তি নেই। Amoxicillin+Clavulanic acid, কোনও একটা থার্ড জেনারেশান Cephalosporin, আবার একখানা Fluoroquinolone দিয়ে দিতে পারেন একসাথে। বা ওয়ার্ডের রোগীকে কোনও কারণ ছাড়াই একসাথে দিয়ে দেবেন Ceftriaxone আর Amikacin ইঞ্জেকশন।
তারপর দু’দিন বাদে রক্ত পরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়বে না। তাইই স্বাভাবিক। কারণ ‘বড়’ ডাক্তারবাবু রোগীকে একটু জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারতেন রোগীর স্বাভাবিক সর্দিজ্বর হয়েছে। যা আবার নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই ভাইরাসের জন্য হয়। নিজের নিয়মেই নির্দিষ্ট সময় পরে সেরে যায়। বা হয়ত দেখা যাবে ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া রোগীটির ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। তাও আরও দু’দিন ধরে চলবে ‘ভালো’ অ্যান্টিবায়োটিক।
আর এদিকে প্রতিদিন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর আসবে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের। ছোট্ট করে জানিয়ে রাখি, সম্প্রতি colistin resistant ই.কোলাই ব্যাকটিরিয়ার খোঁজ পাওয়া গেছে। এবং অ-ডাক্তারদের জন্য জানিয়ে রাখি, colistin হ’ল ব্যাকটিরিয়াদের বিরুদ্ধে আমাদের শেষতম হাতিয়ার। তাছাড়াও, একদিনের সামান্য পাতলা পায়খানায় ‘বড়’ ডাক্তারবাবুদের বদান্যতায় আর সাধারণ মানুষের সীমাহীন মূর্খামির কারণে দু’দিন O2 (Ofloxacin+ Ornidazole; একটি সার্থক irrational combination) গিলে গিলে এমন অবস্থা হয়েছে যে আজ প্রায়ই আর দু’টি ওষুধ আলাদাভাবে দিলে কাজ করে না।
সবে ডাক্তারি পাশ করে উঠে আমাদের ইচ্ছে থাকে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের পাশে থেকে চিকিৎসা শেখার, তারপর তাকে সফলভাবে প্রয়োগ করার। তার জায়গায় এইসব ‘বড়’ ডাক্তারদের দেখলে মুখের ওপর বলতে ইচ্ছে করে- আপনাদের এই সীমাহীন অজ্ঞতা এবং লোভ এবং কেয়ারলেসনেসকে সময় কোনওদিন ক্ষমা করবে না। আর হ্যাঁ, যদি কোনোরকম যৌক্তিকতা ছাড়াই রোগীকে দু’খানা করে অ্যান্টিবায়োটিক গেলাবেন ঠিক করে থাকেন তাহলে তার জন্য এত কষ্ট করে পাঁচ বছর পড়াশুনো করে, গুচ্ছের পরীক্ষা দিয়ে, রাতের পর রাত জেগে ডাক্তারিটা পড়লেন কেন? ব্র্যান্ড নেমে দু’টো অ্যান্টিবায়োটিক আর একটা pan 40 আর একটা প্যারাসিটামল লেখার জন্য কি এতকিছু করতে হয়? যদি শুধুমাত্র টাকার দরকার হয় তাহলে বলুন, কিছু একটা গণফান্ড তৈরি করে দেওয়া যাবে। কিন্তু মানুষের এই ক্ষতিটা করবেন না দয়া করে। এটা শুধুমাত্র নির্লজ্জতা বা মূর্খামিই নয়, এটা অপরাধ।
পুনশ্চঃ অনেক নার্সিংহোম আর ‘বড়’ ডাক্তারের পার্সোনাল চেম্বারের চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি চাপ থাকলেও আমি কিন্তু আজ পর্যন্ত আমার কোলকাতা মেডিকেল কলেজই হোক বা অন্যান্য সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল- কোথাও অ্যান্টিবায়োটিকের এরকম যথেচ্ছ ও অযৌক্তিক ব্যবহার কক্ষনও দেখিনি।
আর অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার তো দূরের কথা, উপরন্তু একটি ওষুধেরও অযৌক্তিক ব্যবহার না করার ডাক্তারি শিখেছি যে জায়গা থেকে, যাঁর কাছ থেকে, সেই মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র আর পুণ্যদা’র কথা নতুন করে আর নাই বা বললাম।
এইসব ‘বড়’ ডাক্তারদের অন্তত একবার চেঙ্গাইলে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে…