নীতি আয়োগ তাদের রিপোর্টে স্বাস্থ্য সূচক অনুসারে কেরলকে সবচেয়ে উপরে আর উত্তরপ্রদেশ সবচেয়ে নীচে রেখেছে। এর মধ্যে বিস্ময়কর কিছু নেই। যে রাজ্য যত বেশি সাক্ষর ও শিক্ষিত সেই রাজ্য তত বেশি সূচকে উপরে উঠে আসবে। সম্প্রতি প্রকাশিত পপুলেশন সার্ভেতে ও একই রকম প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। কেরল সহ দক্ষিণের রাজ্য (তেলেঙ্গানা ও গুজরাট ছাড়া), মণিপুরসহ উত্তরপূর্ব, পশ্চিমবঙ্গ ও ঊড়িষ্যা দারুণ কাজ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে টোটাল ফার্টিলিটি রেট 1.5। সারা দেশের গড় টি এফ আর 2.2। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের হাল সবচেয়ে খারাপ।
জনসংখ্যার এই প্রবণতা বজায় রাখতে পারলে লাভ ও ক্ষতি দুটির তুল্যমূল্য বিচার করা প্রয়োজন। পশ্চিমী দেশগুলিতে ও জাপানে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমছে ও বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। টোটাল ফার্টিলিটি রেট কমার প্রবণতা যদি বজায় থাকে আগামী তিন দশকে দেশের যুবা জনসংখ্যা কমবে, যা মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করে ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যবস্থা জরুরি। কেরালা, তামিলনাড়ু, ওড়িষা ও বাংলার নেট রিপ্রডাকশান রেট সামনের দশকে এক বা তার কম হবে। এর ফলে বয়স্ক মানুষের সামাজিক সুরক্ষা, তাদের দেখভাল করা ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দীর্ঘ্যস্থায়ী পরিকল্পনা জরুরি হয়ে পড়বে।
কোভিড সঙ্কটে ইতালিসহ ইউরোপ ও আমেরিকার তথ্য বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি জিনিস সামনে আসে
বার্ধক্য ও বার্ধক্য জনিত অসুখ কোভিড মৃত্যুর বড় কারণ।
সমাজে
অর্ণব মজুমদার ও অনিতা মেহতা কলকাতা শহরে কিছু হট স্পট নিয়ে কাজ করে বলেছেন যে সামাজিক অসাম্য যত বেশি সংক্রমণ সম্ভাবনা তত বেশি। তাঁরা আরো খেয়াল করেছেন যে, সব মানুষের একই রকম সংক্রমণ সম্ভবনা ও এর সাথে সামাজিক অবস্থানের সম্পর্ক নেই।
ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশ ও ভিয়েতনাম যে খুব সাফল্যের সাথে মহামারি ঠেকাতে পেরেছে তার কারণ তাদের দেশে সামাজিক বৈষম্য কমানোর জন্য সরকার কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে।
কেরালা প্রথম ঢেউ সামলেছে খুব সাফল্যের সাথে। নতুন যে ঢেউ শুরু হয়েছে তার নিবারণ ও তারা করতে পারবে, কারণ কেন্দ্রীয় সরকার যখন “অস্বীকার করার মানসিকতা” নিয়ে চলছেন তখন তারা সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে চূড়ান্ত বৈজ্ঞানিক মানসিকতার পরিচয় দিয়ে সব তথ্য একদিকে মানুষের সামনে তুলে ধরছেন অন্যদিকে সমস্যা স্বীকার করে তার প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন।
দেশে এক মিলিয়ন কেস হয়েছে অথচ কেউ সরাসরি স্বীকার করছেন না যে, সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। কেরল মনে করে ত্রিবান্দ্রাম সহ কয়েকটি বড় শহরে সামাজিক সংক্রমণ ছড়িয়েছে।
অস্বীকার করার মানসিকতা যে ক্ষতি করছে তার বড় উদাহরণ হল উত্তর আমেরিকা ও ব্রাজিল। দুই প্রেসিডেন্ট এখনো চান অর্থনৈতিক কাজ শুরু হোক। স্কুল, কলেজ খুলে যাক। এক ধাপ এগিয়ে ন্যাশনাল ইকোনমিক চেয়ারম্যান ও টেক্সাসের রিপাবলিকান ডন প্যাট্রিক দুজনেই বলে দিলেনঃ দেশের স্বার্থে বুড়োদের মরে যাওয়াই উচিত।
চূড়ান্ত অসংবেদনশীলতার নজির এই দেশে দেখা গেছে। প্রায় তিন ডজন আইন সংশোধন করে গরিব মানুষের অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। 13কোটি মানুষ সরাসরি কাজ হারিয়েছেন ও দেশের 41 কোটি মানুষের অপুষ্টি ও অনাহারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আটশো প্রবাসী শ্রমিক বাড়ী ফিরতে মারা গেছেন। ঋণ ভিত্তিক প্যাকেজ যে গরিব মানুষের কাজে লাগছে না তা বলা বাহুল্য। এ দেশের ব্যাঙ্ক গুলি গরীব মানুষদের ঋণ দেয় না। যাদের দেয় তারা ফেরত না দিয়ে পালিয়ে যায়। এ বছর ও 1.23 লক্ষ কোটি অনাদায়ী ঋণ সরকার হিসাব থেকে মুছে দিয়েছে ও তার ফলে বড় পুঁজিপতিদের সুবিধা হয়েছে। বলা বাহুল্য, দেশের সরকার এগুলো সমস্যা বলে মানে না। বরং সমাজের নীচে তলার মানুষের রুটিরুজি বন্ধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। চর্ম শিল্পের দৈন্যদশা ও তার ফলে বিদেশি মুদ্রা আয় বন্ধ হওয়া এমনই একটি সমস্যা যা অনেক মানুষকে নতুন করে দরিদ্র করেছে।
ফলে, সার্বিক স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন এত সহজ নয়। সব চেয়ে বড় সমস্যা হল, সব রাজনৈতিক দল কোন ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারে না। স্বাস্থ্যের মত বুনিয়াদি বিষয়ে ও দলগুলি একমত নয়। স্বাস্থ্য ও তার সাথে জড়িত জীবনধারণের যে ন্যূনতম বিষয়গুলো জড়িত সেগুলি নিয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত হলে একদিকে যেমন নতুন করে দরিদ্র হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমবে, তেমনি মানুষের নিরাপত্তা বোধ বাড়বে। সমাজের অনেক ছোটখাট সমস্যা শুরু হয় নিরাপত্তাহীনতা থেকে। এখন মহামারির সময় স্বাস্থ্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির যে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে এ কি ক্ষণস্থায়ী না তা সমাজ পরিবর্তন ও রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠবে কিনা তার উপর নির্ভর করছে দেশ কওন দিকে যাচ্ছে।