সেই ২০১৯ থেকে বিশ্ববাসী ঘর করছে অতিমারি কোভিড সঙ্গে নিয়ে। সঙ্গী হয়েছে মাস্ক, স্যানিটাইজার। দূরত্ব বিধির পরোয়ানা জারিতে মুছে গেছে জমাটি আড্ডার স্মৃতি।শিক্ষা থেকে সেবা, সবই হয়েছে ভারচুয়াল। লকডাউন সংকীর্ণ করেছে বহু মানুষের আয় উপার্জনের রাস্তা। প্রশস্ত হয়েছে বেকার মানুষের সারি। মৃত্যুমিছিল আরও লম্বা হয়েছে, খাটো হয়েছে বহু মানুষের আয়ু। অনেক পরিবারে ক্ষত এখনও দগদগে। স্মৃতি মিলিয়ে যায়নি, অথচ করোনা এখনও স্বমহিমায় বিরাজমান। আজ এই নাম তো কাল সেই নামে সে আসে রোজ। কবে শেষ হবে এই অতিমারি? পৃথিবীর অসুখ সারবে? আবার শান্ত হবে বিশ্ব?
অতিমারি শেষ হবে, কোভিড নয়…
প্রকৃতির নিয়ম মেনেই মহামারি আসে। কোনও মহামারিই আজীবন থেকে যায় না। যখনই পৃথিবীতে কোনও মহামারি এসেছে, তখনই একটা সময় পর তার মারণ ক্ষমতা কমেছে। ক্রমে সে সাধারণ একটা অসুখে পরিণত হয়েছে। করোনা অতিমারিও শেষ হবে। তবে কোভিড বা করোনা ভাইরাস কোথাও চলে যাবে না। সে আমাদের সঙ্গেই সহাবস্থান করবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যখন পৃথিবীতে প্রথম ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এসেছিল, তখন কোভিডের মতোই বহু মানুষ তাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এখনও ফ্লু জ্বরে গুটিকয়েক মানুষ মারা যান প্রতি বছর। আর ইনফ্লুয়েঞ্জাও যথেষ্ট সংক্রামক। করোনাও পরবর্তীতে সাধারণ ফ্লু জ্বরের মতোই থেকে যাবে। তবে এখন যেমন মানুষ ফ্লু জ্বরকে আর ভয় পান না, তেমন কোভিডকেও পাবেন না। সাধারণ অসুখ বিসুখ হয়েই কোভিড থেকে যাবে।
২০২২ এ-ই ধার কমছে কোভিডের!
আগের বছর মানুষের মনে করোনাকে ঘিরে যে ভয় ছিল, এখন তা অনেকাংশেই নেই। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউতে যে ক্ষয়-ক্ষতি মানুষ দেখেছে, তৃতীয় তরঙ্গে তার সিকিভাগও নেই বললেই চলে। কারণ ধীরে ধীরে কোভিড ভাইরাসের সঙ্গে আমাদের শরীর যুঝে নিচ্ছে। ধার কমছে ভাইরাসেরও। সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে এই মারণ ভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়ছে। গোটা বিশ্বের ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি, তৃতীয় বা চতুর্থ তরঙ্গে প্রচুর মানুষ করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন, কিন্তু সেই নিরিখে মৃত্যুহার কমই। ২০২২-এর পর করোনার ভয়ঙ্কর রূপ আর প্রকট হবে না বলেই আমার ধারণা। আমাদের দেশেই আমরা দেখছি, রোজ রোজ বাড়ছে করোনার পজিটিভিটি রেট। ঘরে ঘরে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু সেই তুলনায় খুব কম মানুষই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কারো কারো সামান্য উপসর্গ থাকছে, কেউ কেউ উপসর্গহীন। খুবই কম সংখ্যক মানুষকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ছে। এখন করোনার সঙ্গে সাধারণ ঠান্ডা লাগার পার্থক্য বুঝতে পারছেন না অনেকে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, করোনা ধীরে ধীরে মানুষের গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। মানুষ আর করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হচ্ছেন না। ২০২২ এর পরবর্তী পর্যায়ে যখন তৃতীয় তরঙ্গ শেষ হয়ে যাবে, তখন মানুষের সঙ্গে করোনার সহাবস্থান আরও সাধারণ বিষয়ে পর্যবসিত হবে।
ভ্যাকসিন-মাস্কে সংক্রমণ কমবে, কিন্তু করোনা কমবে না…
দেশ তথা বিশ্ববাসী এখন কোভিড ভ্যাক্সিনেটেড। বুস্টার ডোজও চালু হয়ে গেছে। মাস্ক পরেও আমরা কোভিড সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করছি। এতে হয়তো করোনায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। করোনা পজিটিভ কেস কম হবে, কিন্তু করোনা ভাইরাস নিঃশেষিত হয়ে যাবে না। করোনা থাকবেই। এক সময়ে সবারই করোনা হবে, তৈরি হবে হার্ড ইমিউনিটি। যার জোরে করোনা আর অতিমারি থাকবে না। আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া রোগ প্রতিরোধ শক্তিই লড়ে নেবে করোনার বিরুদ্ধে।
কোভিড যেন আমাদের আয়না!
করোনা শুধুমাত্র একটা অসুখ নয়। করোনা এল বলে, আমাদের শরীর, তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেন একটা আয়নার মুখোমুখি দাঁড়াল। এই জন্যই করোনাকালে ‘কো-মর্বিডিটি’ শব্দটা এত বেশি প্রাধান্য পেল। করোনা এসে যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, কার শরীর কত ফিট বা দুর্বল। অন্য কোনও অসুখ যেমন ওবেসিটি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, সিওপিডি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে করোনার উপস্থিতিতে। তাই জন্য যে মানুষ অন্যান্য অসুখে আক্রান্ত, তিনি আরও সেই অসুখেই বেশি করে কাবু হয়ে পড়েছেন কোভিডকালে। করোনা আসলে আমাদের প্রত্যেককে আমাদের শরীরের সঙ্গে, তার অসুখ বিসুখের সঙ্গে আরও একবার পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেল। অসুখ, বিসুখ থাকবেই। শুধু সঠিক সময়ে যাতে সেই অসুখের চিকিৎসা করা যায়, আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে আরোগ্য দেওয়া যায়, তার জন্য পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে প্রতিটা দেশ তথা বিশ্বকে। আমাদের ধরে নিতে হবে, ১০০ জন মানুষ কোভিড আক্রান্ত হলে তাঁদের মধ্যে ১০ জনকে হয়তো ভবিষ্যতে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে, সেই ১০ জনই যাতে বেড পান, সুচিকিৎসা পান, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে আমাদের সেইমতো চিকিৎসা পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে।
বুলেট ট্রেন, দামি হোটেল নয়, চাই আরও বেড, আরও হাসপাতাল…
করোনা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমরা এখনও কতটা পিছিয়ে, এখনও কতটা অসহায় সাধারণ মানুষ! আমাদের দেশে চিকিৎসা খাতে আরও অনেক বেশি অর্থব্যয়ের প্রয়োজন আছে। পর্যটন শিল্প, রাস্তাঘাটে উন্নয়ন সবকিছু ছাপিয়ে এখন আমাদের দরকার সকলের সুস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করা। বুলেট ট্রেন, ফাইভ স্টার হোটেল, ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাটে দেশের গ্ল্যামার বাড়বে, কিন্তু প্রকট হয়ে উঠবে চিকিৎসা ক্ষেত্রের হাড়ে হা -ভাতে রূপ। তাই প্রতিটা রাজ্য, দেশ, বিশ্বের সবার আগে উচিত হাসপাতাল, চিকিৎসা পরিষেবায় প্রথমেই দৃষ্টি দেওয়া। লকডাউনের সময় দেশের প্রচুর বেসরকারি নার্সিংহোমে তালা পড়ে গেছে। সেগুলোকে আবার খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। যে কোনও উপায়ে যাতে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নত হয়, সে দিকে নজর দিতে হবে।
যত দ্রুত সম্ভব জনজীবন স্বাভাবিক করা প্রয়োজন
বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, মানসিক অবসাদের মৃত্যুর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। করোনাকালে বহু মানুষ তাঁদের জীবন জীবিকা হারিয়েছেন। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের দিনগুলোয় আরও বেশি একা, বিষণ্ণ হয়ে পড়েছেন। কত মানুষ এই দুর্বিষহ যন্ত্রণার দিনগুলো সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিস্টেনসিংয়ের কারণে মানুষে মানুষে যোগাযোগ কমেছে, এতে বহু মানুষ বেঁচে থাকার রসদটাই হারিয়ে ফেলছেন। অবসাদ বেড়েছে। ফলে ঝুঁকি বেড়েই চলছে অসুস্থতার। যে মানুষ মানসিকভাবে যত বিষন্ন, তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ততই কম। পৃথিবীকে ব্যাধিমুক্ত করতে তাই যত দ্রুত সম্ভব আবার জনজীবন স্বাভাবিক করতে হবে। কাজে ফেরাতে হবে মানুষকে।
ছোটরাও ফিরুক জীবনের স্রোতে…
স্কুল খুলতে হবে। বাচ্চারা যাতে সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। দীর্ঘকাল ধরে ঘরবন্দি হয়ে থাকার ফলে ওরা আস্তে আস্তে জীবনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ওদের স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে না। মনের বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। ঘরে থেকে থেকে ওদের মানসিক অসুস্থতা বাড়ছে। ওরা খেলতে যেতে পারে না। এতে বাড়ছে স্থূলতাও। ওদের খেলতে দিতে হবে, সংখ্যা বাড়াতে হবে পার্কের। ওরা যাতে স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে উঠতে পারে, এবার সেটাই নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত, ১৭/১/২০২২
সাক্ষাৎকার: সায়ন্তী ব্যানার্জি