একটা গল্প বলি শুনুন। শুনতে যদিও ভালো লাগবে না। তাও শোনানো আমার কর্তব্য মনে করি।
১. আর জি কর হাসপাতালের চেস্ট ওয়ার্ডের সেমিনার রুমে ডা. মৌমিতা দেবনাথ অন কল ডিউটিতে ছিলেন। রাত তিনটে অব্দি ওনার জুনিয়র এ.বি.জি. রিপোর্ট দেখিয়ে মতামত নিয়ে যায় ওনার থেকে। তারপর সকালে পাওয়া যায় ওঁর মৃতদেহ- রক্তাক্ত, অর্ধনগ্ন।
২. অথরিটির প্রথম প্রতিক্রিয়া, এটা আত্মহত্যা। মেয়েটির হয়তো মানসিক সমস্যা ছিল। রাতে সে সেমিনার রুমে গেছেই কেন একা একা!! এসব প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন আরজিকরের অধ্যক্ষ শ্রীমান সন্দীপ ঘোষ। ডাক্তার বললাম না, কারণ ডাক্তারি পরিক্ষায় পাশ করলেই ‘ডাক্তার’ হওয়া যায়না- মানুষ হওয়াটাও জরুরি। সীমাহীন দুর্নীতি, ছাত্রছাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার ইত্যাদি অভিযোগে বারবার বদলি হয়েছেন- কিন্তু ততোধিক ক্ষমতা নিয়ে ফিরে এসেছেন। হসপিটালে নিজের অনুগত ক্যাডার তৈরি করেছেন। ওনাকে আরজিকরের রামরহিম/ আসারাম নিশ্চিন্তে বলা যায়। যাকগে সেকথায় পরে আসি।
৩. মেয়েটির অভিভাবকেরা আসেন, তাঁদের শবদেহ দেখতে দেওয়া হয়না অনেকক্ষণ। ডাক্তারদের পক্ষ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট ইনকোয়েস্টের দাবি হয়। ময়নাতদন্ত হয়, তাতে শারীরিক অত্যাচার ও ধর্ষণের চিহ্ন পাওয়া যায়। সেই দেহ আটকে রাখার চেষ্টা হয়, কিন্তু পুলিশ সেই দেহ তড়িঘড়ি হাসপাতালের বাইরে নিয়ে যায়। কীসের এত তাড়াহুড়ো বোঝা যায়না।
৪. চারিদিকে আন্দোলনের চাপে সঞ্জয় নামক এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। কখনো বলা হয় সে হোমগার্ড, কখনো বলে সে কলেজের কেউ নয়, কিন্তু ‘তার যাতায়াত ছিল’। যদিও চেস্ট বিভাগের রেসিডেন্টরা তাকে জীবনে দেখেনি। তো এই মহামানব চারটে নাগাদ নাকি ঘরে ঢোকে, সাড়ে চারটে নাগাদ বেরিয়ে যায়। এই আধ ঘন্টায় সে নাকি মেয়েটাকে শ্বাসরোধ করে, ধর্ষণ করে, খুনও করে। এরকম করিৎকর্মা ব্যক্তি তো দেশের সম্পদ!!
তো এভাবেই রিসেন্টলি ‘মহারাজা’ দেখে ওঠা পুলিশ অফিসারেরা আরেকজন ধনঞ্জয়কে আবিষ্কার করে ফেলে…
৫. ২৪ ঘন্টা কেটে যায়। ২০১১-র আগে পান থেকে চুন খসলে যে মহিয়সী সাঙ্গপাঙ্গসহ পৌঁছে যেতেন এবং সেখানেই বিরিয়ানি সহযোগে অনশনে বসতেন, সেই পিসিমণি মুখ খুললেন। তিনিও নাকি বিচার চান, সিবিআই কে ডাকা হলেও তিনি রাজি আছেন, কারণ তাঁর “কিছু লুকানোর নেই”। এই কথায় আদপে প্রমাণ হয়, ২০১৯-এ পরিবহর মাথা ফাটানোর কারিগরদের লুকানো হয়েছিল, এবার হয়তো সেরকম কাউকে লুকানোর নেই। যাইহোক ২৪ ঘন্টা পরে হলেও আগের বারের ভুলটা করেননি মুখ্যমন্ত্রী। ‘বহিরাগত’, ‘মাওবাদী’ না বলে বরং বলেছেন এই আন্দোলনকে তিনিও জাস্টিফাই করেন।
৬. সব কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীরা আরজিকরের অভিমুখে যাত্রা করেন, “পাশে আছি” এই বার্তা নিয়ে, ন্যায়ের দাবিতে। ভেবেছিলাম যাবোনা, ৫ বছর আগে অনেক হেঁটেছি, আসলে ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি’ এবং আমি যথেষ্ট ‘ক্লান্ত প্রাণ এক’, বীতশ্রদ্ধও বটে। কিন্তু কিছু জুনিয়র খুবই আশাবাদী তাই যেতে হলো। গিয়ে দেখলাম আসল মজা।
আরজিকরে এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যেন সেই আগ্রাসন নেই ন্যায়ের দাবিতে। কিছু প্রাক্তনী অনেক দাবিদাওয়া তুললেও এখনকার লোকেরা হয় সন্দীপবাবুর ভয়ে কাবু, নয়তো তাঁর স্নেহধন্য।
আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই আপনাদের এই শাসকদলের দাক্ষিণ্যে ডাক্তারি আজ বেনো জলে ভাসছে। এরা কেউ ফেস্টের টাকায় বড়লোক হচ্ছে, কেউ টুকে/ খালি খাতা জমা দিয়েও পাশ করছে- এরকম বিভিন্ন ওরাংওটাং এখন ডাক্তার হচ্ছে। আগামী দিনে এই তৃণমূলী ওরাংওটাং ডাক্তারেরাই আপনাদের সেবার্থে থাকবেন, সুতরাং আপনারাও কোমর বেঁধে নিন ভালো করে।
৭. বিভিন্ন কলেজ থেকে মানুষজন আরজিকরে পৌঁছালে এই ওরাংওটাংরা প্রচ্ছন্ন বিরোধ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সময় তর্কাতর্কি সৃষ্টি করে আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে চায়। এমনকি এসএসকেএম হাসপাতালের একজন সার্জারি রেসিডেন্টকে মারধর করা হয়। সরকারি গুণ্ডাবাহিনী অর্থাৎ পুলিশ এতে মদতও দেয়। যদিও পরে আন্দোলনের চাপে সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হয়। যদিও আজকের আরজিকরের ছবি ২০১৯-র এনআরএসের মতো একদমই ছিল না। কিছু আন্দোলনের লোক, ততোধিক প্রিন্সিপালের চর, ততোধিক তৃণমূলী গুণ্ডা, ততোধিক সরকারি হার্মাদবাহিনী অর্থাৎ পুলিশ- যারা ধর্ষক/খুনি ধরতে পারেনা, কিন্তু একজন সাধারণ সার্জারি রেসিডেন্টের জামা টেনে ছিঁড়ে দেয়।
৮. এত ডামাডোলের মধ্যে ঠিক হয় সব কলেজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা জেনারেল বডি তৈরি হবে এবং তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্মসূচি গৃহীত হবে। সেই মিটিং-এ সব কলেজ থেকে বিভিন্ন দাবি তোলা হয়। কিন্তু যখনই সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে আরজিকরের অধ্যক্ষ, সুপার এবং আধিকারিকদের ঘটনার দায় নিয়ে ইস্তফা দিতে হবে- সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদলে যায় সব কিছুর। ওরাংওটাং ডাক্তারেরা চড়াও হয়, বলে সব নকশাল বহিরাগত লোকেরা আরজিকরে মিটিং করতে এসেছে। থিয়েটার হলের কারেন্ট লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়, আসে পুলিশের দল।ভিতরে তখন প্রায় দু’শতাধিক ছেলেমেয়ে রয়েছে। এভাবেই ভেস্তে দেওয়া হয় জিবি মিটিং…
মুখ্যমন্ত্রী যে কথাগুলো বলতেন, এখন তাঁকে আর বলতে হয়না-তাঁর অনুচর ওরাংওটাং বাহিনী এখন সেই কাজটা করে…
আপনি কোথায় যাবেন? কার কাছে ন্যায়ের দাবি জানাবেন? কেউ একজন খুন ও ধর্ষণ করেছে। আমরা জানিনা সে কে। কিন্তু এই প্রত্যেক স্তরের দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেরা, এমনকি এই ডাক্তারেরও কোনো ধর্ষকের চেয়ে কম নয়। কাকে বাঁচানোর লড়াইতে নেমেছে আরজিকরের আধিকারিকরা, এই সত্য সামনে আসবে কিনা আমরা জানিনা।
তবে আমি এটুকু জানি, এই লড়াই অসম লড়াই। কতিপয় ডাক্তার আন্দোলনে নেমেছেন। বেশির ভাগ নিজেদের জীবন নির্বাহে ব্যস্ত, নয়তো তারা তৃণমূলী স্নেহধন্য। আপামর জনগণের থেকে সেরকম সাড়া নেই। বুদ্ধিজীবী সমাজ কিছু বলবেনা আমি জানি। কিছু মানুষ তো ইতিমধ্যে প্রকাশ্য বিরোধিতাও করছেন। সুতরাং এই লড়াইয়ের কোনো ফেট নেই- আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত। পরিবহর মাথা ফাটিয়েও লোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মৌমিতার ধর্ষকেরাও ঘুরবে।
কিন্তু এর দায় কিন্তু সবার। এই ধর্ষণের দায়ও সবার, যারা আজ চুপ করে আছে তাদেরও। ভগবান না করুক, ‘মহারাজা’র অনুরাগ কাশ্যপের মতো অজান্তেই আমরা কাল নিজের বাড়ির মেয়েটারও সর্বনাশ করে বসি…