(১৫)
১৯৮৩ সাল। মধ্য রাতের কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠল কয়েকশো তরুণ চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা কর্মীদের স্লোগানে স্লোগানে। শুভব্রতও হাঁটছে এ মিছিলে। মাঝ রাতে রাজ্যপাল ভবনের সামনে অবস্থান করতে চলেছে তারা। ক’দিন পরেই দূর্গা পুজো শুরু। কলেজ স্কোয়ারে প্যান্ডেলের বাঁশের কাঠামোটা ল্যাম্পোস্টের আলোয় কেমন যেন ভূতুড়ে লাগে। শুভ-রা এগোতে থাকে। সিনিয়ররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে মিছিলকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ওদের স্লোগান রাতের নিস্তব্ধতা চিরে গম গম করে উঠছে। রাস্তায় পড়ে থাকে মাতালের গোঙানির আওয়াজ, দু চারটে কুকুরের সমবেত চিৎকার, এসব চাপা পরে গেল এই সময়ের শব্দ তলায়। গত মার্চ মাস থেকে ক্ষেপে ক্ষেপে দাবীপত্র পেশ করা থেকে কর্ম বিরতি সব রকম চেষ্টাতেও সরকারের কোনও হেলদোল নেই। উপরন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি, রুগীদের স্বার্থে জীবনদায়ী ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ, সমস্ত রকম পরীক্ষার ব্যবস্থা করা, হাউস স্টাফ আর ইন্টার্নদের ভাতা বাড়ানো, অমানবিক ডিউটি কমানো এ সব দাবী নিয়ে যত বার ওরা সোচ্চার হয়েছে ততবার সরকারের তরফ থেকে নেমে এসেছে আঘাত। এমন কি শান্তিপূর্ণ ঘেরাও করা ডাক্তারদের লাঠি পেটা করতে দ্বিধা করে নি পুলিশ। গতকাল এস এস কে এম আর এন আর এস-এ এই সব জুনিয়র ডাক্তারদের ওপর পুলিশের হামলা তারই নিদর্শন।
রাষ্ট্রের এই দমননীতি দেশকালের ভেদ বোঝে না, শ্রমিক কৃষক বুদ্ধিজীবী মানে না। দল্লী- রাজহরার ঘটনার খবর শুভব্রত-র কানে এসে পৌঁছেছে। সেখানে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী আর আন্দোলনের ওপর কিভাবে হামলা চলেছে সে খবরও সে পেয়েছে সিনিয়র দাদা দিদিদের কাছ থেকে। আর সে এও খুব ভাল করে জানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কি অব্যবস্থা আর দুর্নীতি দানা বেঁধে আছে। কলেজে ঢুকেই প্রথম বছর নিজে দৌড়াদৌড়ি করে এই রকম অনেক তথ্য জোগাড় করেছিল সে। হসপিটাল মুভমেন্ট সে সময় মুখ থুবড়ে পড়েছিল ঠিকই কিন্তু আজকের এই আন্দোলন যেন সেই হারিয়ে যাওয়া আন্দোলনের নতুন মুখ। শুভ এ বছর আগস্ট মাস থেকে ইন্টার্ন হিসাবে কাজ করতে শুরু করেছে। আজ অক্টোবরের পাঁচ তারিখ। মার্চ মাসের তেইশ তারিখ এবিজেডিএফ এর কনভেনশন হয়। তার পর তাদের দাবী গুলো সরকারের কাছে পেশ করা হয়। এমন কি সরকারি হাসপাতালের সুপার, প্রিন্সিপাল সবার কাছে স্মারকলিপি দেয় এবিজেডিএফ। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই সরকার বা কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। ঠান্ডা বরফের মতো শীতল আর নির্বিকার থেকেছে তারা। এপ্রিল মাসের বাইশ তারিখে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হলে আশ্বাস আসে সাতদিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। কিন্তু সেই আশ্বাস মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তারপর বারবার আউটডোর বয়কট করেছে তারা কোনও ফল হয় নি। উল্টে শাসক গোষ্ঠীর বিভিন্ন গণ সংগঠনগুলো ডাক্তারদের বিরুদ্ধে হসপিটালের গেটে গেটে প্রচার চালাতে লাগল। পনেরই জুন আউটডোর, ইনডোর, ইমার্জেন্সী সব বয়কট করে হাসপাতালগুলোকে অচল করে দেয় আন্দোলনরত ডাক্তাররা। ওরা আলাদা করে ইমার্জেন্সী ওয়ার্ড চালু করে রুগীদের চিকিৎসা করতে থাকে। ব্যপক চাপ সৃষ্টি হয় প্রশাসনের ওপর। এস এস কে এমে সরকারী ডাক্তারদের সংগঠন হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদক ডঃ অরুণ ব্যানার্জীকে রীতিমত আক্রমণ ও অপদস্ত করা হল। তাঁর অপরাধ তিনি জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমন কি জুনিয়র ডাক্তারদের ওপর ডি ওয়াই এফ হামলা চালাল পুলিশের চোখের সামনে। এর দু’দিন পরে দাবী দাওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের আলোচনা হল। পরের মাসের সাত তারিখে অর্থাৎ জুলাইয়ের সাত তারিখে সরকার জুনিয়র ডাক্তারদের ভাতা বৃদ্ধি ঘোষণা করল। কিন্তু জনতার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দাবী দাওয়া নিয়ে উচ্চবাচ্য করল না। তাই পরের দিন জুনিয়র ডাক্তারদের মিছিলে সরকারি ঘুষের প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রীর কুশ পুত্তলিকা দাহ করা হোল। এর পর জুলাইয়ের নয় তারিখ থেকে তেরো তারিখ পর্যন্ত আউটডোর বন্ধ করে প্যারালাল আউটডোর চালালো জুনিয়র ডাক্তাররা। কিন্তু সরকারের হজম হচ্ছে না। ওদের এই দুঃসাহসিক আন্দোলন মেনে নিতে পারছে না সরকার।
এই তো সেদিন মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী সাংবাদিকদের কাছে বলে বসলেন সরকারি হাসপাতালে সমান্তরাল চিকিৎসা ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া আসলে বিদ্রোহের নামান্তর। কংগ্রেস নেতৃত্বও এখন ভাল সাজবার চেষ্টা করছে। তাদের ছাত্র পরিষদের নেতা বক্তব্য পেশ করেছে যে তারা এমন অরাজকতাকে সমর্থন করে না। এ সবের মূলে নকশালপন্থী ছাত্র সংগঠনই দায়ী। বাঙলায় একটা প্রবাদ চালু আছে যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। এই এত আন্দোলন, জন স্বাস্থ্যের দাবী যাদের জন্য সেই আম জনতা কি ওদের সমর্থন করছে? নানা ছুটে আসা মন্তব্য শুনে তো মনে হয় না করছে বলে। সি পি এম চালিত গণ সংগঠনগুলো প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জনতার মনে ওদের বিরুদ্ধে বিষ ঢেলে দেওয়ার। ওরা হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পৌঁছে গেছে রাজ ভবনের সামনে। এখানেই অবস্থান করার কথা ওদের। শুভ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। যে পথে সে হাঁটতে শুরু করেছে সে পথ দীর্ঘ। সেই চলার পথে ক্লান্তির অবসর নেই। এই আন্দোলন এক দিন থেমে যাবে কিন্তু এমন অনেক অনেক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সে মনস্থির করে নিয়েছে, প্রথাগত ডাক্তার নয় সে অন্য রকম ডাক্তার হবে। প্যান প্যানে রবীন্দ্র সঙ্গীত নয় তার জীবন হবে গণ সঙ্গীতের মতো জোরালো, আবেদনময়। কিন্তু………
স্মৃতি দুলতে থাকে মাথার মধ্যে, চোখের সামনে সিনেমার পর্দায় ভেসে ওঠা ছায়া ছবির অংশ। তবে কি সেদিনই শুভ’র বুঝতে ভুল হয়েছিল? ‘মেডিক্যাল কলেজে পড়তে এসে ক্লাসে কে যায়?’ ও চমকে উঠল শুভ-র কথা শুনে।
— “মানে? তোর ভয় হয় না? অবিশ্বাস ওর চোখে।
শুভ এক মনে খাতায় হিজিবিজি কাটছে। কলমের আঁচড়ে মনের ঝড় ফুটে উঠছে খাতার পাতায়। এখন বেলা একটা বাজে। লাইব্রেরীর কোণের দিকের একটা কিউবিকিলসের ঘেরাটোপে বসে আছে ওরা। বড়ো মেঘ করে আছে। কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার করে আছে ভর দুপুর বেলায়। বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। কাঁচের জানলার ওপারে এখন জলের আলপনা। ভয়? এখন শুভ-র যেটা হচ্ছে তাকে কি ঠিক ভয় বলে? নিজের হৃৎপিন্ডের লাবডুব যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছে। সেটা ক্লাস কামাই করার জন্য হচ্ছে? কেন হচ্ছে সেটা কি ওই মেয়েটা টের পাচ্ছে না? ওকে যে শুভ এখানে আসতে বলল ও ক্লাস কামাই করে এল কেন?
“হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়
এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।“
“তুই কি নিজেকে বিরাট নেতা ভাবছিস? চোখ খুলে দেখ যে দাদাদের নির্দেশে তুই অন্ধের মতো ছুটছিস তারা আর দু’দিন গেলে ডাক্তার হয়ে যাবে। আমি বলছি না আন্দোলন করিস না কিন্তু তাই বলে পড়াশোনাটাও করতে হবে। না হলে ফেল করবি।“ শুভ যে কথাগুলো বলবে ভেবেছিল সেগুলো গিলে নিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। চেয়ার ঠেলে উঠে পড়েছিল। ‘কোথায় চললি?’ ওর কথার উত্তর না দিয়েই লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে পড়েছিল সেদিন। সময়ের কাঁটা টিক টিক করে চলতে থাকে। চলতেই থাকে। কথারা মূর্ত না হলেও বিমূর্ত অনুভূতি বাঁধ মানে কই? তাই একদিন যৌথ পথ চলা শুরু হয়ে যায়। যৌথ স্বপ্ন, যৌথ যাপন ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করে এক অজানা পথ ধরে এগিয়ে পড়ে। দুটো মানুষ অলিখিত এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। তাতে কোনও প্রথাগত সিলমোহর পড়ে না শুধু সময়ের তরঙ্গে একটা স্পন্দন সৃষ্টি করে মাত্র। বুদবুদ যেমন উৎপন্ন হয়, মিলিয়ে যায়, আবার উৎপন্ন হয়। তেমনই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে দলে দলে ছাত্র-ছাত্রীরা আসে, রাজনীতি, প্রেম, বন্ধুত্ব, শপথ, অঙ্গীকার, বিচ্ছেদ, সংঘর্ষ, নির্মাণ, সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রবাহ বইতে থাকে। কিন্তু—- এই একটা ‘কিন্তু’ শুভ-র জীবনে বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে ঝুলে থাকে। যাকে পাশে পাবে ভেবেছিল সে যেন ক্রমশঃই ওর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। জীবনের ব্যালান্স সিট অংক কষে মেলানো বড় কঠিন। যদি তুমি ভুল করো সে ভুল শুধরে নিলেও সব সময়ে অংক মেলে না। পড়ে থাকে কিছু মূহূর্ত। ভীষণ ভীষণ প্রিয় কিছু মুহূর্ত। বাচ্চারা বড় হলে উড়ে যায়, মা পাখিও বাসা বদলায়। পড়ে থাকে শুকনো খড়কুটো দিয়ে যত্নে গড়া বাসাখানা। হয়তো তেমনই। মুহূর্তগুলো বুকের মধ্যে চাপ সৃষ্টি করে। কতদিন কথা হয় না। কান্নার মেঘ বুকের ভেতর গর্জন তোলে। কিন্তু চোখের জল হয়ে ঝরতে পারে না। পুরুষদের যে কাঁদা বারণ।
ভালো লাগলো। সুন্দর।
এরপরই পশ্চিমবঙ্গের সরকারি চিকিৎসকদের একমাত্র সংগঠন কে ভেঙ্গে তৎকালীন সরকারের প্রধান দলটির অধীনস্থ আর একটি পাল্টা সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন তৈরি করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী বলেন এটা না করে কোন উপায় ছিল না, হাসপাতালের ডাক্তাররা রোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। সরকারি হাসপাতালের অভাব অব্যবস্থা কে জনগণের সামনে আনলে কোন শাসকই সেটা সহ্য করতে পারে না। সেদিনও ছিল আজও আছে তবে আরও নগ্ন আরও অশ্লীল ভাবে।