শংকর গুহ নিয়োগীর মৃত্যুর পর কেটে গেছে তিন বছর। শুভ এখন বিবাহিত। অলকানন্দার সাথে তার যৌথ জীবনের পথ চলা শুরু হয়েছে। অলকানন্দা হাওড়ার এক স্কুলে ভূগোল দিদিমণি। সে মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় আসে দল্লি রাজহরায়। শুভ-র ডাল ভাতের জীবনে একটু মাছ মাংসের ছোঁয়া লাগে। কিন্তু শুভ বুঝতে পারে এই তিন বছরে সংঘর্ষ আর নির্মাণের রাজনীতি রূপায়ণে এবং শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থার আঁতুর ঘর হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছিল যে শহীদ হাসপাতালকে সেই শহীদ হাসপাতাল পিছু হাঁটছে। শুভ ধাক্কা খেল। যে গুরু দায়িত্ব শংকর তাদের কাঁধে তুলে দিয়ে গেছে সে দায়িত্ব পালনে অনুপোযোগী তারা! সংগঠনের নেতৃত্বে যারা আছে তাদের একটা অংশ সংগঠনকে শ্রেণী সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। সদস্যদের একটা বড় অংশ এর বিরোধিতা করছে বলে সংগঠনে গণতান্ত্রিক পরিসর ক্রমশ: ছোট হয়ে আসছে। শুভ প্রতিবাদ করতে থাকে বলে দিন দিন এই সব নেতাদের চক্ষুশূল হতে থাকে। সিনিয়ার-জুনিয়ার নির্বিশেষে কর্মীদের সবার ও ডাক্তারদের সবার ভাতা এক থাকবে এবং দুইয়ের মধ্যে ফারাক কম থাকবে এমনটাই রীতি। কিন্তু সে সব নিয়ম শিকেয় তুলে ডাক্তারদের কর্মকুশলতার দোহাই দিয়ে ভাতা বাড়ানো হল। এই ইস্যুতে কর্মীরা ধর্মঘট করল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিকূলে বয়ে চলা এই স্রোতে কিছুতেই নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারছে না শুভ। শ্রেণীসংগ্রামের পথ থেকে শ্রেণী সমঝোতার পথে হাঁটতে থাকা নেতারা কিছুতেই শংকর গুহনিয়োগীর যোগ্য উত্তরসূরী হতে পারে না। যে লোকটা নিরন্তর আপোসহীন লড়াই করে গেছে এমনকি মৃত্যু অবশম্ভাবী জেনেও আপোস করে নি সেই লোকটার স্বপ্ন সফল করতে গেলে আদর্শবান হতে হবে। শুভ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় মনে মনে। এর শেষ দেখে ছাড়বে সে।
এই বছর একটা বড় ঘটনা ঘটে গেল। মেশিনীকরণের পক্ষে নেতাদের এক অংশ সমঝোতায় যেতে চাইল। স্বভাবতই শুভ প্রতিবাদ জানাল। কিন্তু তার ফল হল ভয়ানক। সে গল্পের শুরু আরও বছরখানেক আগে। নিয়োগীজির রেকর্ড করে যাওয়া বয়ান অনুযায়ী যে কমিটি গঠন করা হয় তার মধ্যে তিন জন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী। তিন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দু’জন ডাক্তার আর একজন সমাজ কর্মী। ডাক্তারদের মধ্যে শুভ একজন। স্বভাবত:ই ডাক্তারদের যেহেতু হাসপাতালের ব্যস্ততা প্রচুর তাই তাদের পক্ষে ইউনিয়ন রুমে শ্রমিকদের সঙ্গে সময় কাটানোর অবসর কম। শ্রমিকদের শ্রেণী সংগ্রাম ও নিয়োগীজির ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সম্বন্ধে সচেতন করার বদলে চলল এক উলোট পুরাণ। যেহেতু দুই জন ডাক্তারই বাঙালি তাই শ্রমিক নেতাদের বোঝানো হতে লাগল যে বাঙালিরা নেতাগিরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সময়টা ভারতের রাজনীতিতেও এক আমূল পরিবর্তনের সময়। মুক্ত অর্থনীতির ঝোড়ো হাওয়ায় নাকি আন্দোলনের দীপ জ্বেলে রাখা যাবে না, তাই এখন আন্দোলনের প্রকৃষ্ট সময় নয়–এমনটা বলতে লাগল নেতৃত্বে সংগ্রাম বিরোধীরা। শুভ প্রতিবাদ করতে লাগল। তার মধ্যেই ডাক দেওয়া হয়েছিল ভিলাইয়ের মিল মালিকদের বিরুদ্ধে মহা সংগ্রামের। শুভ বুঝতে পারছিল শংকরের আদর্শ ও নীতির থেকে বিচ্যুত হচ্ছে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার আন্দোলন। শ্রমিকদের বোঝানো হচ্ছে আন্দোলন নয় মালিক পক্ষের সঙ্গে রফা করে কাজে ফিরতে হবে। শুভ ভিলাইতে শুরু করল ক্লিনিক। সেখানে কাজের অবসরে চলল শ্রমিকদের শ্রেণী সংগ্রামের আদর্শ সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ। মাঝে মাঝে আসা দল্লি রাজহরায়। কিন্তু শুভ তার বিরুদ্ধে চক্রান্তের আভাস পাচ্ছিল। সংগঠনের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিসর কমছিল। তার অনুপস্থিতিতেই অবশেষে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল সংগঠনের বিরুদ্ধে যাওয়ার। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেল না সে। তাকে প্রথমে সাসপেন্ড ও পরে বহিষ্কার করা হল।
কিছু শ্রমিক যারা শুভ-র বহিষ্কার মেনে নিতে পারে নি তারা ভিলাইতে শুভ-র সঙ্গে যোগ দিল। নতুন নিয়োগী পন্থী ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরে শুভ বুঝল সংগঠন চালানোর দক্ষতা এই মূহূর্তে তার নেই। ছত্তিশগড়ে কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। ভাল লাগছে না এখানে। ওদিকে পশ্চিমবঙ্গে কানোরিয়া জুট মিলের শ্রমিক আন্দোলনের খবর পাচ্ছে সে। অলকানন্দাও যাতায়াত করছে ওখানে। কানোরিয়া জুট শ্রমিকদের দাবী সামান্যই। পাট শিল্পের শ্রমিকদের সাথে একটি মানসম্মত চুক্তি ছিল এবং সেই চুক্তি অনুযায়ী তাদের কিছু অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু শ্রমিকরা তাদের সেইসব চুক্তি ভিত্তিক অধিকার পাচ্ছেন না। তারা বাড়ি ভাড়ার ভাতা পাচ্ছেন না এমনকি মালিকরা বাড়ানো মহার্ঘভাতা (ডিএ) দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন। শ্রমিকদের বঞ্চিত সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই ছিল কানোরিয়া মিল শ্রমিকদের প্রধান দাবি।
কানোরিয়া জুট মিলের তিন হাজারের বেশি শ্রমিকদের অধিকাংশই মিলের আশেপাশের গ্রাম (সিজবেড়িয়া এবং আশেপাশের) বাস করত। বহিরাগতরা কমই ছিল যারা কোয়ার্টারে বসবাস করত। স্থানীয় শ্রমিকদের অধিকাংশই এলাকার ভূমিহীন বা প্রান্তিক কৃষক পরিবারের মানুষ। নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল অল্প। মিল শ্রমিকদের প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল স্থায়ী, বাকিরা ছিল চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক। শ্রমিকদের এই আন্দোলনে পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ, ছত্তিশগড়ে বাসের শেষদিককার তিক্ত অভিজ্ঞতা, সব মিলিয়ে শুভ-র যাত্রাপথের ট্রাজেক্টরিটাই বদলে গেল। কলকাতায় ফিরে এল সে। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে, জুনিয়র আর সিনিয়রদের সাথে দেখা হল। বিনোদ এম ডি করে ঝাঁ চকচকে হাসপাতালে যোগ দিয়েছে। আনন্দ কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস শুরু করেছে। এদের মধ্যেই কয়েকজনের সঙ্গে অনেক আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে শংকর গুহ নিয়োগীর আদর্শের বাস্তব রূপায়ণের উদ্দেশ্যে জন্ম নিল আর একটা ক্লিনিক। সে কথা লিখতে গেলে আরও একটা উপন্যাস লিখতে হয়।
জগতে কিছু মানুষ জন্মায় যারা আজীবন আপোষহীন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে অন্যের জীবন আলোকিত করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। অন্ধকার কুটিরে দীপ জ্বেলে যাওয়াই তাদের কাজ। সাধারণের চোখে যা হয়তো বা অকাজ। এইসব মানুষগুলো নিজেদের আখের গুছানোর বদলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোয় বিশ্বাসী। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অসীমের সম্ভাবনা, সংঘর্ষের মধ্যেই নির্মাণ তাদের জীবনের বীজ মন্ত্র।
এই উপন্যাস কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি মানুষের সাফল্য বা ব্যর্থতার আখ্যান নয়। এ শুধু এক খন্ড সময়কে ধরে রাখার কাঁচা হাতের প্রচেষ্টা। ভুল ত্রুটি যে আছে সে কথা অনস্বীকার্য। তবু রবি ঠাকুরের লেখন অনুসরণে বলতে হয় সাহিত্য জগতে তো আমি রাখি নাই মোর প্রতিভার ইতিহাস। তবু, লিখেছিনু এই মোর উল্লাস।
খুব ভালো শুধু নয়, খুব সৎ লেখা। তবে গুহনিয়োগীকে একটি আইকনিক এবং কাল্ট ফিগার হিসেবে অনিবার্যভাবেই তৈরি করতে হয়েছে। ইতিহাসের নিয়মে এটা পরিহার করতে পারলে ভালো। গুহনিয়োগী ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের এক মাইলফলক।
স্যার, আপনার এই মন্তব্য আমার কাছে সব থেকে বড় পুরস্কার।আমার প্রণাম নেবেন।