সংগ্রামী জুনিয়ার ডাক্তার সন্তানরা আমার —
সাবাশ।
কুর্নিশ তোমাদের।
প্রশাসন ও পুলিশের হামলা, লুম্পেনদের হুমকি, প্যাথলজিক্যাল মিথ্যাবাদীদের বিভ্রান্তিমূলক প্রচার …
সবকিছুকেই যে অগ্রাহ্য করা যায়;
শাসকের চোখে চোখ রেখে, মাথা উঁচু করে কথা বলা যায়;
লুম্পেন রাজত্বেও প্রতিরোধের ঢেউ তোলা যায়;
উদ্ধত শাসকদেরও বারবার মাথা নোয়ানো যায়;
সচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত জন-আন্দোলনই বাঁচার রাস্তা,
সর্বস্তরের লক্ষলক্ষ সংঘবদ্ধ মানুষই আসল শক্তি –
এই সবকিছুই তোমরা বাস্তবে প্রমাণ করে দিচ্ছো সমাজের সামনে।
“আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা” – কবিগুরুর এই ডাক তোমরা পৌঁছে দিয়েছো ঘরে ঘরে।
ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষের বুকে তোমরা স্পর্ধা যুগিয়ে চলেছো।
নরপিশাচদের প্রকৃত বিরোধিতার পরিবর্তে তাদের বাঁচানোই যে প্রশাসনের আসল লক্ষ্য – এই সত্যকে তোমরা উলঙ্গ করে দিয়েছো।
এক ঐতিহাসিক সামাজিক ভূমিকা তোমরা পালন করেই চলেছো।
ব্যাপক জনগণের মতামতকে মর্যাদা দিতেও তোমরা সজাগ।
পূর্ণ কর্মবিরতি থেকে মহা মিছিল; মহামিছিল থেকে আমরণ অনশন; সেখান থেকে ‘দ্রোহের কার্নিভাল’; ‘দ্রোহের গ্যালারি’ থেকে ‘জনতার চার্জশিট’; – সবই তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
সামাজিক ব্যাধির চিকিৎসক – বাংলার সন্তানরা –
আমার শ্রদ্ধাবনত কুর্নিশ জানাই তোমাদের।
‘মানুষ’ আন্দোলন গড়ে তোলে। কিন্তু আন্দোলনও যে ‘মানুষ’ গড়ে তোলে, এমন ঘটনা চোখের সামনে দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে এখন। তোমাদের আন্দোলনের দৌলতে। কোনও নির্দিষ্ট ‘দল’ কিম্বা ‘ঝাণ্ডা’ নিয়ে না। পুরোপুরি ‘সামাজিক মানুষ’ হিসাবে।
সার্বিক অবক্ষয় দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সবদিক থেকেই। সমাজে কোনোকিছু ভালো এবং সুন্দর যে থাকতে পারে, সেই বিশ্বাসটুকুও মানুষের চলে যেতে বসেছিলো! সকলেই যেনো শুধু নিজেদের ধান্দা নিয়েই ব্যস্ত! খুন, ধর্ষণ, চুরি, জালিয়াতি, তোলাবাজি, কুকথা, – সমাজ-জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠছিলো প্রতিদিন! সমাজজীবনে মিথ্যা, অসততা, হুমকিবাজী, গুণ্ডাগিরি, এইসব অপগুণের বাড়বাড়ন্ত চারদিকে! এখানে একটা “⁸নির্বাচিত সরকার” ক্ষমতায় রয়েছে। তার জবরদস্ত্ পুলিশ-প্রশাসন-আমলাবাহিনী সবই মজুত আছে। আইন-আদালত-বিচারব্যবস্থা, কোনোকিছুরই অভাব নেই। সবই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তৈরি এবং পোষিত। অথচ, প্রত্যেকটি মানুষই এক দমবন্ধ করা পরিবেশে, ভয়ে জবুথবু হয়ে থাকছিলেন।
তোমাদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রভাবে সেই ভয়ের পরিবেশ এবার ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
গত ৯ অগাস্ট ২০২৪ থেকে, পশ্চিমবাংলায় এক অভূতপূর্ব সামাজিক জাগরণের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছো তোমরা। ঐতিহাসিকদের কারও কারও মতে, সারা ব্রিটিশ আমলেও কোনও আন্দোলনে লক্ষলক্ষ মানুষের এতো ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অংশগ্রহণ দেখা যায় নি। কিন্তু, উদ্ধত শাসকপক্ষের কোনও হেলদোল দেখা যাচ্ছে না তাতেও! শুধুই মিথ্যা, গুণ্ডামি, হুমকি, বিভ্রান্তি ইত্যাদি নোংরামির পথেই তারা তোমাদের “তিলোত্তমার বিচার চাই” আন্দোলনকে বানচাল করতে চাইছে! আন্দোলনে ন্যায্য, মানবিক ও সামাজিক দাবিগুলোকে সামনে রেখে, তোমরা ১৭-দিন যাবৎ “তিলোত্তমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই” ঘোষণা সহ নিজেদের জীবন বাজি রেখে ‘আমরণ অনশন’-ও চালিয়ে গেছো। কিন্তু সেই বিষয়গুলোকে হয় অগ্রাহ্য করছে, নয় ব্যাঙ্গ করছে, কিংবা ধমকাচ্ছে, অথবা পাশ কাটিয়ে যাবার অপচেষ্টা চালাচ্ছে ‘নির্বাচিত’ প্রশাসন। কখনও পুলিশের সাহায্যে, কখনও ‘আলোচনা’র নামে নাটক করে, কখনও আদালতে মিথ্যা যুক্তি হাজির করে, কখনও স্তাবকদের নির্লজ্জ গলাবাজি শুনিয়ে, আবার কখনও সরাসরি লুম্পেনবাহিনীর গুণ্ডামি দিয়ে।
তোমাদের মতো জীবন বাজি রেখে আমরণ অনশনরত সন্তানদেরও সরকারপক্ষ কখনও বলেছে “ধান্দাবাজ”, কখনও বলেছে “গদিলোভী”, কখনও হয়তো “স্বার্থান্বেষী”, এমনকি বলেছে “অসৎ”-ও। আর যেসব লুম্পেন, গুণ্ডা, লম্পট, চুরির দায়ে জেলখাটা আসামী, জালিয়াত, মোদোমাতাল, কু-শিক্ষিত মানুষজন সরকারের রক্ষীবাহিনী হয়ে উঠেছে, তাদের বোঝাতে চাইছে – “বাংলার আশা”!
২০১১ সালে যখন ‘বামফ্রন্ট’-এর পরিবর্তে তৃণমূল সরকার গদীতে বসে, তখন থেকেই এই নীতি-আদর্শহীন সরকারকে উদ্বাহু সমর্থনের এক বিপজ্জনক ধারা গড়ে উঠেছে। আজও তার অনেকটাই বহাল আছে। তাই, কিছু কথা সোজাসুজি বলা আজ খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।
(এক)
‘মনুষ্যত্ব’ ব্যাপারটা যদি কখনও শাসক-নির্ভর হয়ে ওঠে, তখনই বিপদ! সব সংসদবাদী দলগুলো নিজস্ব অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী ‘মনুষ্যত্ব’-র সংজ্ঞা ঠিক করে। শাসনক্ষমতা দখল এবং সেই ক্ষমতা বজায় রাখাই যাদের একমাত্র সিলেবাস। মানবিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে যার কোনো সম্পর্কই নেই। ‘আমাদের’ আমলে শোষণ হলে তা সহনীয়, ‘ওদের’ আমলের শোষণ অসহ্য – এটাই গদি লোভী দলগুলোর মূল দর্শন। ‘আমরা’ মারলে প্রগতিশীল, ‘ওরা’ মারলে প্রতিক্রিয়াশীল – এটাই তাদের ব্যাকারণ! ‘আমাদের’ শাসনে ধর্ষণ লঘুপাপ, ‘ওদের’ শাসনে ধর্ষণ মহাপাপ – এটাই সংসদীয় রাজনীতির বিচার!
জনগণের স্বার্থের সঙ্গে বিবেকের টিঁকি যদি শক্তভাবে বাঁধা থাকে, তাহলে বাঁচোয়া। কিন্তু কোনও সংসদীয় ‘দল’ বা ‘নেতৃত্ব’ অথবা ‘সরকার’ কিংবা ‘রাষ্ট্রশক্তি’-র সঙ্গে সেই টিঁকি বেঁধে রাখলেই সাড়ে সর্বনাশ! তখন ঘোরতর পাপীকেও পূণ্যবান; মহামূর্খকে মহাপণ্ডিত; ডাহা মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদী; ঘৃণিত চোরকে মহান; বেহায়া ধান্দাবাজকে আদর্শবান; জালিয়াতকেও চরিত্রবান বলে প্রচার করতে হবে। তাদের হয়ে গলা ফাটাতে হবে। এটাই সংসদীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা। চোরকে প্রকাশ্যে ‘চোর’ বলা যাবে না; “দলের মধ্যে” বলতে হবে! মিথ্যেবাদী, অসৎ, চোর জালিয়াত, ধান্দাবাজ … কাউকেই জনগণের সামনে তিরস্কার করা যাবে না। ‘দল’ নাকি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে – “ভুল বার্তা যাবে”!
সাধারণ জনগণ ‘তত্ত্ব’ জানেন না। ‘সাংগঠনিক’ প্যাঁচপয়জার বোঝেন না। ‘মানবিক মূল্যবোধ’ তারা বই পড়ে কিম্বা কোনও বাচাল নেতা-নেত্রীর কাছ থেকে, কোনও প্যাথলজিক্যাল মিথ্যাবাদীর কাছ থেকে শেখেন না। জনগণের চেতনায় একধরণের মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ – অর্থাৎ মনুষ্যত্বের অনুভূতি – সবসময়েই কাজ করে। তাঁরা সেই মূল্যবোধ শেখেন পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে। পরম্পরাগত অলিখিত ‘সামাজিক নিয়ম’ অনুযায়ী। আম জনতা জন্মসূত্রে চিরকালই সৎ। সর্বত্র। ব্যতিক্রমহীন। দূষিত পরিবেশ-পরিস্থিতি, বাইরে থেকে তাঁদের মধ্যে অসততার বীজ বপন করে। নিজেদের জনবিরোধী ধান্দা নিয়ে উৎসাহী ‘রাজনৈতিক’ নেতৃত্ব সেই বীজে জল-হাওয়া-সার যুগিয়ে চলে। তারপর একসময়ে যখন আশকারা পাওয়া লুম্পেনের দল ‘ধরাকে সরা’ ভেবে নিজেদের দাপট কায়েম করে চতুর্দিকে, তখন শাসকচক্র নিজেরাই চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করে।
শাসকদের স্তাবক বাহিনী মুখে সবসময়েই “জনগণের স্বার্থ” নিয়ে মুখর। রুগী, বাড়ির লোক, ডাক্তার, নার্স ইত্যাদি সকলের জন্যেই নাকি এদের প্রাণ কেঁদে মরে! কিন্তু শাসকের যেসব কীর্তিকলাপ জনগণের সর্বনাশ ঘটাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে এরা বোবা! অন্যান্য শাসকের ‘অপরাধ’ সম্পর্কে এরা যতখানি সোচ্চার, নিজেদের পছন্দসই শাসকের দুষ্কর্ম নিয়ে ঠিক ততখানি-ই নীরব! আসলে, মনুষ্যত্ব অটুট রাখতে গেলে পক্ষ বেছে নিতে হবে – শোষক কিংবা শোষিত; অত্যাচারী বা অত্যাচারিত; ক্রিমিনাল কিংবা সৎ; ধর্ষক অথবা ধর্ষিতা; – তিনি কোন পক্ষে? “আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দুটো দল, আর মাঝামাঝি নেই তো কিছুই।” ভাষার জাদুকরী দিয়ে সাদাকে কালো কিংবা কালোকে সাদা প্রমাণ করা যাবে না।
সারা বিশ্বের যাবতীয় অমানুষতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যারা নাকি খুবই ‘সচেতন’ ও সোচ্চার, পছন্দসই শাসকদের সকল কদর্যতা নিয়ে সেই স্তাবকবাহিনী কিন্তু নির্বিকল্প সমাধিস্থ হয়েই থাকে! এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে! রাজনৈতিক মতপার্থক্য তো হতেই পারে; থাকেও। কিন্তু তাই বলে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে হবে? ‘পুলিশ-বিরোধী’ অবস্থান থেকে পাল্টি খেয়ে পুলিশ-পন্থী হয়ে যেতে হবে? ‘শোষকের-ত্রাস’ থেকে ১৮০° ঘুরে গিয়ে শোষকের-রক্ষাকর্তা হয়ে উঠতে হবে? ‘লুম্পেন-বিরোধী’ থেকে লুম্পেন-সহযোগী ভূমিকা নিতে হবে? ‘সংগ্রামী’ থেকে সংগ্রাম-দমনকারী হয়ে উঠতে হবে?
এই সমস্যা নিয়ে নানাজনে নানাসময়ে বিভিন্ন রকম কেতাবি ব্যাখ্যা হাজির করেন। ‘শ্রেণী’, ‘জাতি’, ‘জাত’, ‘বর্ণ’, ‘ধর্ম’ ইত্যাদি নানা কারণেই নাকি সমাজে এই “মনুষ্যত্বের অবক্ষয়” ঘটে। কিন্তু কোনও নারী ধর্ষিতা হলে শাসকদের তরফ থেকে “এরকম তো কতোই হয়”, অথবা “এটা সাজানো ঘটনা”, কিংবা “ছোট্ট ঘটনা”, বা “এসব বিরোধীদের চক্রান্ত”, … – এধরনের ঘৃণ্য, কুৎসিত ও কদর্য উক্তির সঙ্গে শ্রেণী-জাতি-জাত-বর্ণ-ধর্ম – কিসের সম্পর্ক আছে? একমাত্র ‘ক্ষমতা’-র লোভই এরকমের পৈশাচিক দম্ভোক্তি করতে ইন্ধন যোগায়। শাসক তখন স্বাভাবিক মনুষ্যত্বটুকুও হারিয়ে ফেলে। তারা তখন আর ‘মানুষ’ থাকে না, শুধুই ‘শাসক’। ক্ষমতার মদমত্ততায় তারা হিতাহিতজ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়ে।
শ্রেণীসমাজে কোনও ‘কমিউনিস্ট’ শাসক কখনও কৃষক-শ্রমিক হত্যা করতে, কিংবা মেহনতী জনগণকে অত্যাচার করতে পারে? সেই হত্যাকাণ্ডের অথবা অত্যাচারের সাফাই দিতে পারে? পশ্চিমবাংলার কোনও সচেতন ‘বাঙালি’ শাসক কখনও ভাবতে পারে – “আন্দোলনে বসলে পিটিয়ে তুলে দেবো”, কিম্বা “ওদের কথায় কান দেবার দরকার নেই”? চূড়ান্ত স্বৈরাচারীর মতো বলতে পারে “ধর্মঘট চলবে না”? সংসদীয় রাজনীতি এখন পুরোপুরি ক্লেদাক্ত, দুর্গন্ধযুক্ত; সুস্থতা সব জায়গাতেই ব্যতিক্রমী! হাল ধরার আসনে দ্বিপদ ‘মানুষ’ কিছু আছেন বটে, কিন্তু মনুষ্যত্ব বড়ই দুর্লভ! কোনও ‘নীতি’-র ভিত্তিতে ‘রাজ’ করা আজকের সংসদীয় রাজনীতি না; শুধুই ‘রাজ’ করার স্বার্থে সবরকম ‘নীতি’ বিসর্জন দিয়ে, কিছু সুবিধাবাদী কৌশলে শাসকের গদীটা যেনতেনভাবে বজায় রাখা। এটাই এখন সংসদীয় রাজনীতির মূল কথা।
কপর্দকহীন অবস্থা থেকে দুমাসেই স্কর্পিও বা এসইউভি গাড়ি; দুবছরেই তিনখানা ফ্ল্যাট কিংবা তিনতলা বাড়ি; চাকরি-ব্যবসা-পারিবারিক সম্পত্তি ছাড়াই পারিবারিক অনুষ্ঠানে লক্ষলক্ষ টাকা খরচ; – এই ধরণের ইন্দ্রজাল সংসদবাদী রাজনীতি ছাড়া অসম্ভব। সেই ইন্দ্রজালের পথকেই যে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদরা আঁকড়ে ধরেছে, তাঁদের কাছে তোমরা কী আর আশা করতে পারো!
রাজনৈতিক হাস্যরসিকতারও একটা সীমা থাকার কথা। যিনি নিজেই সবকিছুর দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনিই হঠাৎ মিছিল করে ‘দাবি’ তুলে বসলেন “ফাঁসি চাই”! কার কাছে ‘দাবি’? ফাঁসি-ই বা কার চাই? যেকোনও একজন ‘শিখণ্ডী’-র? রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে লিখেছিলেন – “চোর চাই, যে করেই হোক, হোক না সে যেই কোনো লোক”! কোনও ‘একজন’-এর শাস্তির দাবি তো ওঠেনি ‘তিলোত্তমা’-কাণ্ডের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা আন্দোলনকারী লক্ষলক্ষ জনগণের তরফ থেকে! বিকৃত-কাম কোনও একজনের পক্ষে এই পৈশাচিক ঘটনা ঘটানো অসম্ভব। তথ্যপ্রমাণ নষ্টের বিপুল অপচেষ্টা সত্ত্বেও, যেটুকু খবর এখনও পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে, তা থেকেই বৃহত্তর, সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধের বিষয়টা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। টাকা নিয়ে হাউজস্টাফ করা এবং পরীক্ষায় পাশ করানো; মর্গ থেকে মৃতদেহ বিক্রির সিন্ডিকেট; বর্জপদার্থ বিক্রির সিন্ডিকেট; জাল ওষুধের সিণ্ডিকেট; ড্রাগের সিন্ডিকেট; যৌন সিন্ডিকেট; … সবকিছুরই অভূতপূর্ব স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিলো সরকারি হাসপাতাল আরজি কর। এর পিছনে প্রশাসনিক বহু দফতরের যোগাযোগ ছাড়া, বছরের পর বছর এমন ভয়ঙ্কর অবস্থা চলতেই পারে না।
“সকল দোষীর শাস্তি চাই” এবং “দায়ী ব্যবস্থার বিচার চাই”, এ-ই তো গণবিক্ষোভের মূল দাবি। আন্দোলনকারী জনতা তো স্পষ্টতই বলছেন – ডাঃ ‘তিলোত্তমা’র ধর্ষক কোনও ‘ব্যক্তি’ না, প্রশাসনিক ‘ব্যবস্থা’। দায়ী ‘ব্যবস্থা’-র পরিবর্তে কোনও ‘ব্যক্তি’-র ঘাড়ে দায় চাপানোর এতো আগ্রহ কেন প্রশাসনের? কাদের বাঁচানোর জন্য এতো মরিয়া চেষ্টা? একটা সভ্য প্রশাসনের তরফ থেকে তো সর্বতোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত এইধরনের বীভৎসতা নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে। তার পরিবর্তে, যাঁরা এই পৈশাচিক ব্যবস্থা শোধরানোর দাবি তুলছেন, তাঁদের উপরেই প্রশাসনের যতো ক্রোধ! রহস্যটা কী !!
(দুই)
একটা কথা খুব পরিস্কার করেই আজ বলা দরকার।
এই কলকাতায় তথা পশ্চিমবাংলায় আমরা দেখেছি, যুব বয়সেই অনেকের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিলো ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল ধারার মাধ্যমে। জনসেবার সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্কও ছিলো না তাদের। এদের “ছাত্র আন্দোলন” ছিলো সমাজপ্রগতির বিরুদ্ধে, চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়ার পক্ষে। এদের অনেকেরই রাজনৈতিক দীক্ষা হয়েছে অগণিত প্রতিবাদী শক্তিকে নিকেশ করার পথে। বিরোধীদের রক্তে অবগাহনের ভয়ঙ্কর রাজনীতির কুশীলব হিসাবেই এরা বেড়ে উঠেছে। এদের পুরো রাজনৈতিক জীবনটাই কেটেছে চরম প্রতিক্রিয়ার সৈনিক হিসাবে। রাজনৈতিক দীক্ষা ও শিক্ষা হয়েছে পশ্চিমবাংলার বুকে হাজার হাজার বঙ্গসন্তানের পৈশাচিক ও অকল্পনীয় হত্যকাণ্ডের মূল দুই কাণ্ডারি – উচ্চবংশীয় পেডিগ্রী সম্পন্ন বিলিতি ব্যারিস্টার – কংগ্রেস নেতা ‘বঙ্গেশ্বর’ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ খুনি-পুলিশ অফিসার রণজিৎ গুপ্তের কাছে। রণজিৎ গুপ্ত ছিলো সিদ্ধার্থ রায়ের দুষ্কর্মের দোসর। এই জল্হাদ মানিকজোড়ের ছত্রছায়াতেই কিছু মধ্যবিত্ত লুম্পেনের অভিষেক ঘটে রাজনীতির জগতে। অগুনতি যুবশক্তির লাশের উপর দাঁড়িয়ে। পশ্চিমবঙ্গে সীমাহীন খুন-অত্যাচারের অন্যতম প্রধান তিন কুশীলব, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী সুব্রত মুখোপাধ্যায় সোমেন মিত্র ছিলেন এমনি তিন লুম্পেন প্রধান। এদের সহকারী হিসাবেই ক্লেদাক্ত ভূমিকা পালন করেছে অনেকে। ‘দৈনিক সত্যযুগ’, ‘দর্পণ’, ‘বাঙলাদেশ’ ইত্যাদি পত্রিকার হাজার হাজার কপি পুড়িয়ে, হকারদের মারধোর করে কংগ্রেসী ভৈরব বাহিনী যখন তাণ্ডব চালিয়েছিল শিয়ালদহ-কলেজ স্ট্রীট অঞ্চলে (১৯৭২), লুম্পেনদের মুখে তখন স্লোগান ছিলো “প্রিয়দা যুগ যুগ জিও”, “জাতীয় কংগ্রেস জিন্দাবাদ”, ইত্যাদি। সাম্প্রদায়িক-গণহত্যার মতো, এরা একের পর এক রাজনৈতিক-গণহত্যা ঘটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বুকে। বারাসত, ডায়মন্ডহারবার, কোন্নগর, বরানগর-কাশীপুর, হাওড়া (ব্যাটরা), বেলেঘাটা ইত্যাদি গণহত্যাগুলো তারই উদাহরণ। শতসহস্র বঙ্গসন্তানকে বিভৎসভাবে খুন করেছে এইসব বাঙালি কুলাঙ্গারেরা। বরানগর-কাশীপুর গণহত্যার দিন (১২-১৩ অগাস্ট ১৯৭১) “৬০ বছরের ঊর্দ্ধ বয়সের এক বৃদ্ধকে আক্ষরিক অর্থে পেট্রোলে চুবিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। কারণ, তিনি তাঁর ‘নকশালপন্থী’ ভাইপোর খবর দিতে পারেন নি। ১৫ বছর বয়সের নিচে এক স্কুলের বালিকার একটি হাত কেটে নামিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, সে তার ভাই কোথায় আছে জানতো না।”
এই পৈশাচিক গণহত্যা সম্পর্কে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সাংবাদিক যখন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে প্রশ্ন করেছিলেন, “সারারাত সেখানে নরহত্যা চলেছে। শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা কি তাহলে আক্রান্ত হলে পুলিশ প্রোটেকশান পাবে না?” ‘বঙ্গেশ্বর’ তার জবাবে বলেছিলেন, “আগে দেখতে হবে যারা মারা গেছে তারা শান্তিপ্রিয় ছিল কিনা?” সিদ্ধার্থ রায়ের মানিকজোড়, পুলিশ-পিশাচ রণজিৎ গুপ্তের ভাষায় – “আমি বলতে চাই যে নকশাল আমলে সমাজবিরোধীদের পুলিশী নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সমাজবিরোধী লেলিয়ে দেওয়াটা খুবই জরুরি ছিল এবং সেটাই করা হয়েছে।”
১৯৩০ সালে, হিজলী বন্দীশালায় ব্রিটিশ সরকার গুলি চালালে খুন হন দু’জন বন্দী – কলকাতার সন্তোষ মিত্র এবং বরিশালের তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নিহতদের মৃতদেহ নেবার জন্য হিজলী যান; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তীব্র প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। ব্রিটিশ আমলে বন্দীদের উপর হত্যাকাণ্ড এই একটাই। কিন্তু ১৯৭০ থেকে ১৯৭৬, ‘স্বাধীন’ পশ্চিমবঙ্গের ১০-টি জেলের মধ্যে, ১৩-বার বন্দী হত্যা করা হয়। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল (১৬ ডিসেম্বর ‘৭০ এবং ৪ ফেব্রুয়ারি ‘৭১); বহরমপুর সেন্ট্রাল জেল (২৪ ফেব্রুয়ারি ’৭১ আর ২০ ফেব্রুয়ারি ‘৭২); দমদম সেন্ট্রাল জেল (১৪ মে ‘৭১); আলিপুর স্পেশাল জেল (১১ জুলাই ‘৭১); আসানসোল স্পেশাল জেল (৪ অগাস্ট ‘৭১); আলিপুর সেন্ট্রাল জেল (২৬ নভেম্বর ‘৭১ এবং ১ অক্টোবর ‘৭৩); বর্ধমান জেলা জেল (২৮ মে ‘৭২); কৃষ্ণনগর জেলা জেল (৬ মে ‘৭৪); হাওড়া জেলা জেল (৩মে ‘৭৫); এবং প্রেসিডেন্সী জেল (২৪ ফেব্রুয়ারি ‘৭৪)। প্রতিটি জেলের মধ্যেই বন্দীদের উপর গুলি চালিয়ে অথবা লাঠি-রড-খুন্তি ইত্যাদি দিয়ে পিটিয়ে মোট ৬৭-জনকে খুন করা হয়।
সরকারি তথ্য থেকেই জানা যায়, ১৯৭০ সালের মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত, কেবল কলকাতা শহরেই হত্যা করা হয়েছে ১৭৮৩ জনকে। সিদ্ধার্থ-রণজিৎ খুনী জুটি-ই ছিলো সেসময়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রিয়-সুব্রত-সোমেন লুম্পেন বাহিনীর ‘অনুপ্রেরণা’। খেয়াল রাখা দরকার, নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল, রক্তাক্ত, কলুষিত, কুৎসিত বাংলা-বিরোধী অতীতের জন্য এদের মন্ত্রশিষ্যদের কেউই – আজও পর্যন্ত ক্ষমা চায় নি! ‘জরুরি অবস্থা’র দমবন্ধ করা দিনগুলোতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গলাও টিপে ধরেছিলো সেদিনের কংগ্রেসী ‘তরুণ তুর্কি’ সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ-মন্ত্রীসভার সদস্য হিসাবে। বর্তমান সরকারের আমলে এসে তিনিও “জয় বাংলা” শ্লোগানের সহযাত্রী হয়েছিলেন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর আসনে বসে। হাজার হাজার খুনের কুশীলবদের রাজনৈতিক চ্যালারাই আজ পশ্চিমবাংলায় ‘গণতন্ত্র’-র বাণী ছড়াচ্ছেন!
সেদিনের এইসব ‘পুরানো কাসুন্দি’ কিছুটা হলেও আজ আবার ঘাঁটা দরকার। কারণ, সেদিনের সেই লুম্পেন রাজত্বের উত্তরসূরিরাই আজ পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন। এরাই আজ তোমাদের জুনিয়ার ডাক্তার আন্দোলনের প্রধান প্রতিপক্ষ। তোমরা কী আসা করতে পারো এঁদের কাছ থেকে? আজকের প্রজন্ম এদের চেনেন না, এদের অতীত জানেন না। খুনী-অত্যাচারী ঘরানার এইসব প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ‘জনস্বার্থ রক্ষা’র বিন্দুমাত্র আশাও করা যায় কী? জনবিরোধিতাই এদের সাংস্কৃতিক পরম্পরা।
পশ্চিমবাংলার বুকে “সত্তরের দশক” চিহ্নিত হয়ে আছে হাজার হাজার স্বর্ণ-সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল বঙ্গসন্তানের লাশের পাহাড়ে! পাড়ায়-পাড়ায়, মাঠে-ঘাটে, শিক্ষালয়ে-বাড়িতে, রাস্তায়-কারাগারে… সর্বত্রই তখন মৃত্যুর কারবার। শুধুই খুন, খুন, আর খুন! সামাজিক দায়বদ্ধতায় অঙ্গীকারবদ্ধ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার পৈশাচিক রক্তাক্ত অনুশীলন চলেছে লাগাতার। সেই কলঙ্কময় মৃত্যুপুরী গড়ে তোলার কুশীলব লুম্পেন-বাহিনীর হাতেই এখন পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় শাসন-ভার। তারাই আজ তোমাদের প্রধান শত্রু। ছাত্র ও যুব আন্দোলনের চরমতম প্রতিক্রিয়াশীল ধারার প্রতিনিধিরাই এখন “বাঙলার স্বার্থ” নিয়ে তঞ্চকতার তুড়িভেড়ী বাজিয়ে চলেছে।
এইসব সামাজিক জঞ্জালরা ভুলেও কখনও কোনও অসভ্য-বর্বর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই-আন্দোলন করে না। বরং যেসকল শক্তি প্রশাসনিক ব্যবস্থাটাকে দুর্নীতিমুক্ত, ধর্ষণ-মুক্ত, সুস্থ, সুন্দর করে তোলার স্বপ্ন নিয়ে বারবার পথে নামেন, এরা খোলাখুলিভাবেই সেই শুভশক্তির শত্রু। তাই শিক্ষার্থী-শিক্ষক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী-সাহিত্যিক, অধ্যাপক-কর্মচারী, চিত্রশিল্পী-অভিনেতা, রিক্সাওয়ালা-মজুর, ডেলিভারি বয়-আইটি কর্মী,… কেউই এদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। শুধুমাত্র নীতি-আদর্শহীন কিছু লুম্পেন, কু-শিক্ষিত, ডেঁপো, চোর, জালিয়াত, লম্পট, মোদো-মাতালদেরই এখন দাপট!
সমাজে যে “হুমকি সংস্কৃতি” (থ্রেট কালচার) নিয়ে এখন প্রতিদিনই চর্চা চলছে, তারও জন্ম এই কংগ্রেসী লুম্পেনদের হাতেই। জন্মলগ্নও সেই অভিশপ্ত “সত্তরের দশক”। রাজনীতির জগতে বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে কোনো-না-কোনো ধরনের ‘হুমকি’ অনেকসময়ই চলে। কিন্তু সেটাকে একটা সংগঠিত ও ভয়াবহ “কালচার”-এ পরিণত করেছিলো কংগ্রেসী লুম্পেনরাই। এমনকি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আদালতে সওয়াল করা বার-অ্যাসোসিয়েশনের পদাধিকারীকেও বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছিলো। জনগণ সর্বদা, সর্বত্রই, ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকতো! এই বোধহয় খুন করে দিলো; জেলে ভরে দিলো; মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিলো; পিটিয়ে দিলো! শাসকের বিরোধিতা করা তখন ছিলো দুঃস্বপ্ন। এটাই ছিলো ইন্দিরা-সিদ্ধার্থদের কংগ্রেসী “কালচার”; সেদিনের বাস্তব সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি। “গণতান্ত্রিক নির্বাচন” ব্যাপারটাকেই কীভাবে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিরোধী-শূণ্য করার লক্ষ্যে গুণ্ডামী হামলাবাজি ভোটলুঠের পথে এক হাস্যকর ছ্যাবলামিতে পরিণত করা যায়, তার উদ্বোধন-ও হয়েছিলো সিদ্ধার্থশঙ্করের পুলিশ এবং লুম্পেন চ্যালাদের হাতে – ১৯৭২ সালে।
কলকাতা তথা পশ্চিমবাংলা জুড়ে কয়েক হাজার শহীদের মৃত্যু – বহূজনের হৃদয়েই জল্হাদদের সম্পর্কে শুধুই ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। “পরিবর্তীত পরাস্থিতি”-র দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক তঞ্চকতা, সে’আগুনকে নেভাতে পারে নি। সংসদীয় ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা’-র আলখাল্লায় শতসহস্র শহীদের রক্তচিহ্ন সাময়িকভাবে হয়তো আড়াল করা যায়; কিন্তু সমাজের হৃদয়ে যে দগদগে ক্ষত তৈরি হয়ে আছে, তা কোনদিনই মুছে যাবে না। কংগ্রেসী জল্হাদবাহিনীকে আড়াল করার জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে তাদের “উত্তেজিত জনতা” আখ্যা দেওয়া হতো সেসময়ে।
এটাই ছিলো সেইরকম পরিস্থিতি যখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় বলা যায়, “রক্তে পা ডুবিয়ে হাঁটছে // নিষ্ঠুর সময়… // এখনও আকাশচুম্বী ভয়।” তোমাদের “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” আন্দোলনকে ঘিরে আবার যেনো সেইরকম পরিস্থিতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্রমশই জোরদার হয়ে উঠছে!
(তিন)
বর্তমানে শ্রমজীবীদের আন্দোলনকে দমন করার জন্য মাঝেমধ্যেই সরকারের হুঙ্কার শোনা যায় “ধর্মঘট চলবে না”। এখন যেমন তোমরাও মাঝেমধ্যেই শুনতে পাচ্ছো, ‘মিছিল চলবে না’, ‘জমায়েত চলবে না’ ইত্যাদি। এই জন-বিরোধিতার পরম্পরাও চলে আসছে কংগ্রেসী আমল থেকেই। এটাই নির্ভেজাল কংগ্রেসী সংস্কৃতি। এমনকি ‘স্বাধীনতা’-র প্রথম দিনেই (১৫ অগাস্ট ১৯৪৭) শ্রীদুর্গা কটন মিলের চারজন শ্রমিক ছাঁটাই দিয়ে কংগ্রেসী শাসনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। পরবর্তীকালেও, কংগ্রেসী শাসন মানেই ছিলো আন্দোলন-সংগ্রাম-ধর্মঘটের উপর কংগ্রেসী গুণ্ডাদের এবং পুলিশের অনিবার্য হামলা। সেই জনবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল পরম্পরাই আমরা দেখতে পেয়েছি সত্তরের দশকেও। একটি অসম্পূর্ণ তালিকা থেকেই জানা যায় সোনারপুর, মহেশতলা, খড়্দা, টিটাগর, দমদম, দক্ষিণদাড়ী, ব্যারাকপুর মহকুমার পুরো অঞ্চল, বেহালা-যাদবপুর-টালিগঞ্জ, উত্তর কলকাতা, বেলেঘাটা, মানিকতলা, রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চল, দুর্গাপুর এবং আসানসোল শিল্পাঞ্চল, বর্ধমান শহর, হাওড়া ও হুগলি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল, – সমস্ত এলাকাতেই শ্রমিকদের উপর আক্রমণ – হত্যা ও অত্যাচার চলেছে। হাজারো ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অসংখ্য কারখানায় নেতৃত্বস্থানীয় কর্মীদের কাজে যোগদান করতে দেওয়া হয়নি। কলকাতায় স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের দুইশতাধিক শ্রমিককে বাসস্থান থেকে উৎখাত করা হয়েছিলো। বহু জায়গায়, অনেক ট্রেড ইউনিয়ন অফিস দখল করে নেওয়া হয়েছিলো। কংগ্রেসী আমলে পুলিশ ও কংগ্রেসী গুণ্ডাদের এইসব দুষ্কর্মের নথিবদ্ধ (কিন্তু অসম্পূর্ণ) তালিকাতেই এদের বাংলাবিরোধী-জনবিরোধী রাজনৈতিক চরিত্রের আসল ছবি পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় সংস্থায়, অন্যায়ের প্রতিবাদে সংগঠিত কর্মচারী আন্দোলনের উপর সদলবলে গিয়ে, নিজের হাতে বোমাবাজি করে ধর্মঘট ভাঙা ছিলো কংগ্রেসী ‘তরুণ তুর্কি’ নেতা সুব্রত মুখার্জীর বীরত্বপূর্ণ কাজ! এরাই আবার ‘গণতন্ত্র’ ‘গণতন্ত্র’ বলে চেঁচায়!
এটাই কংগ্রেসী রাজনীতির ধারাবাহিক পরম্পরা। চিরকাল। সত্য ইতিহাস সেভাবে ব্যাপকহারে প্রচারিত হয় না বলেই, জনবিরোধী কংগ্রেসী সংস্কৃতির উত্তরসূরিরা আজও সমাজে মুখ দেখানোর সুযোগ পায়। ত্যাগ-বীরত্ব-মৃত্যুর পথ বেয়ে শ্রীদুর্গার শ্রমিক সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়েছিলো। একথাও মনে রাখতে হবে, ঠিক একই ভূমিকায় নেমেছিলেন দেড়শো দিনের ধর্মঘটি বাসন্তি কটন মিলের উপোসী শ্রমিক ঘরের মা-বৌয়েরা। সেদিনের শ্রমমন্ত্রীর কাছে চিঠিতে তাঁরা বলেছিলেন, “আপনি একজন পুরানো শ্রমিক নেতা। শ্রমিকদের দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে। আজ শ্রমমন্ত্রী হিসাবে আপনার হাতে শাসন-ক্ষমতা আসিয়াছে। কিন্তু তবু কেন আপনার এই শাসন ক্ষমতা সেই গরীবদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হইতেছে?” এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ২৫ জন রমনী: নন্দরাণী দাস, কৃষ্ণদাসী দেবী, মনোমোহিনী দেবী, তরুলতা দেবী, কালী তারা ভট্টাচার্য্য, প্রতিভাময়ী দাস, অন্নপূর্ণা চৌধুরী, বাসন্তী বসু, ফেলাবালা দাসী, ভেদীবালা দাসী, রমণী সিকদার, চপলা, সিধুবালা, নূরজাহান বিবি, লক্ষ্মী, শোভা দাসী, তীর্থবালা, বীণা, মঙ্গলা, অন্নদা দাসী, এয়া রাম্মা, সরলাবালা দাসী, পার্ব্বতী, গোলাপী দাসী ও ধনপতিয়া। আজ যাঁরা শোষক রাষ্ট্রের বিরোধিতার পরিবর্তে রাষ্ট্রসেবার ব্রত নিয়েছেন আত্মস্বার্থ ও আত্মসুখের লোভে, তাঁরা এইসব জ্বলন্ত তথ্য আড়াল করতে সর্বদাই তৎপর।
শাসকদের কেউ, কোনোদিন, কোথাও, শোষক মালিক-পুঁজিপতি-ভূস্বামীদের টিকিটিও ছুঁলেন না। কিন্ত আদর্শগতভাবে শোষক শ্রেণীর শত্রু যাঁরা, তাঁদের বিরুদ্ধে সব শাসক সর্বদাই খড়্গহস্ত। আসলে, জনবিরোধী শোষক রাষ্ট্রের কাছে ‘মনুষ্যত্ব’ আশা করা, আর ধুতরো গাছে আঙুর ফল আশা করা একই কথা।
বর্তমান শাসকবাহিনীর আমলে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘তিলোত্তমা’ কাণ্ডের মতো কদর্য ও ঘৃণ্য ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের জনগণ আহত, ব্যাথিত, লজ্জিত এবং ক্রুদ্ধ। কিন্তু শাসকবর্গ কখনও কোনও ঘটনাতেই লজ্জিত হয় না! ১৯৪৭-১৯৪৮ সময়ে কৃষকদের ‘তেভাগা’ আন্দোলনের উপর নৃশংস হত্যা-দমন-পীড়ণ; ১৯৫৯ সালে খাদ্য-আন্দোলনের উপর বর্বর হামলা ও গণহত্যা; ১৯৬৬-তে কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি-বিরোধী সংগ্রামের উপর হত্যার তাণ্ডব চালানো; ১৯৬৭ সালে শান্তিপূর্ণ মহিলা জমায়েতের উপর পুলিশের নির্বিচার হত্যা চালানো; ১৯৯৪-এ অনশনরত শ্রমিক নেতাদের উপর পুলিশের নৃশংস হামলা; ২০০৭ সালে বিদ্রোহী কৃষকদের উপর পুলিশ গণহত্যা চালানো; – কোনও ঘটনাতেই শাসকপক্ষ লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হয় নি। নির্লজ্জতা বোধহয় সংসদীয় রাজনীতির জগতে ‘শাসক’ হবার essential qualification! তাদের কেউকেউ প্যাথলজিক্যাল মিথ্যাবাদীও বটে। বরং পাল্টা অভিযোগের বেহায়া যুক্তি হাজির করার রাস্তাতেই হাঁটেন তাঁরা। ভাবখানা, ‘বানতলা’ কিম্বা ‘দিল্লী’ অথবা ‘হাথরাস’-এর পৈশাচিক ঘটনাবলীর কথা খুব জোরেসোরে বললে, কলকাতায় সরকারি হাসপাতালের মধ্যে কর্তব্যরত ডাক্তার ‘তিলোত্তমা’-র ধর্ষণ ও খুনের পাপকে কিছুটা লঘু করে দেখানো যাবে! সারা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষ তথা বিশ্ব জুড়ে প্রতিদিন-প্রতিঘন্টায় কতো ধর্ষণ হয়, সেই ভয়ঙ্কর তথ্য পরিবেশন করলে ‘তিলোত্তমা’ ধর্ষণ-খুনের সংগঠিত পাপকে যেনো কিছুটা লঘু করে দেখানো যায়! তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে সংঘটিত কোনও ধর্ষণ-খুনের অভিযোগ উঠলেই পূর্ববর্তী “চৌঁত্রিশ বছরের বাম শাসন”-এর ফিরিস্তি; ‘বাম’ আমলের অগণিত খুন-ধর্ষণ নিয়ে কথা বললেই “আধা ফ্যাসিস্ট কংগ্রেস” কিংবা “বিজেপি’র বি-টিম” তৃণমূল আমলের সঙ্গে তুলনা; কংগ্রেস আমল নিয়ে অভিযোগ উঠলেই ১৫০ বছরের “ব্রিটিশ শাসন”-এর অজুহাত … এগুলোই সংসদবাদী রাজনীতির সিলেবাস।
শাসকবর্গ সারাজীবন একাগ্রচিত্তে প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রশক্তির তাঁবেদারি করেই চলে। সেই জন্যেই তাদের শাসকের গদিতে বসে থাকা মঞ্জুর করে রাষ্ট্রযন্ত্র। তারই প্রতিদানে, ইউনিয়ন সরকারের নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আশির্বাদ প্রতিমুহূর্তে রক্ষা করে চলেছে আপাদমস্তক ক্লেদাক্ত তৃণমূল প্রশাসনকে। নির্বাচনে টাকা-পেশি-মিথ্যার জোরে তথাকথিত ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ পেলেই যদি সাত-খুন-মাপ হয়ে যায় তবে কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিআই (এম), তৃণমূল কংগ্রেস, বা অন্য কোনও ‘বিজয়ী’ শাসকদলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগেরই আর কোনও গুরুত্বই থাকে না! কারণ তারা সকলেই তো ‘জয়ী’! মহামূর্খের মতো তাদের হাস্যকর ঘোষণা আমরা সবসময়েই শুনি, “জনগণ আমাদের জিতিয়েছে”। তার মানে কী, ভোটে জেতার অর্থ বাপের জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হওয়া?
‘তিলোত্তমা’ ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে যে অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয় জনজাগরণ তথা সামাজিক নব-জাগরণ ফেটে পড়েছে নগর-রাজ্য-দেশ-মহাদেশ-বিশ্ব জুড়ে, তাতে শাসকগোষ্ঠী উল্লসিত হবার পরিবর্তে গভীরভাবে আতঙ্কিত। সুপরিকল্পিত মিথ্যা-হুমকি-সন্ত্রাসের মাধ্যমে তারা রেহাই পেতে চাইছে। যেনতেনভাবে স্তব্ধ করতে চাইছে প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে।
কেনো?
উল্টোটাই তো হওয়া উচিত ছিলো। সামাজিক দায় পালনের তাগিদেই – মনুষ্যত্বের স্বার্থেই – সর্বশক্তি নিয়ে প্রশাসনের ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত ছিলো সত্য উদ্ঘাটনে। একজন বিকৃত-কাম মানুষের ঘটানো কোনও ধর্ষণ-খুনের ঘটনা যে এটা হতেই পারে না, তা প্রশাসনের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। সময়ের সঙ্গেসঙ্গে এবং পারিপার্শ্বিক তথ্যাবলী থেকে একথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, এক বা কয়েকটি পিশাচের ব্যক্তিগত লালসার শিকার হননি ডাঃ ‘তিলোত্তমা’। তিনি সংগঠিত, ব্যাপক, গভীর, ভয়াবহ, প্রাতিষ্ঠানিক এক পৈশাচিক ‘ব্যবস্থা’র শিকার হয়েছেন। এই ‘ব্যবস্থা’র সঙ্গে বহু… বহুকিছু জড়িত। এর সঙ্গে দীর্ঘদিনের, ব্যাপক ও গভীর প্রশাসনিক যোগাযোগ অবধারিত। কয়েকজন ক্ষমতাবান নরপিশাচের পক্ষে এঘটনা ঘটানো অসম্ভব। বহু দু’পেয়ে পিশাচের অনেকদিন ধরে গড়ে তোলা, বহুরকম অমানবিক স্বার্থপূরণের এক বিশাল পৈশাচিক চক্র এরজন্য দায়ী। একজন “আসল দোষী”-কে ফাঁসিতে লটকে দিলেই খেল খতম, ব্যাপারটা মোটেও এতো সহজসরল না। কয়েকজন বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষীকে হঠাৎ কয়েকদিনের সরকারি ট্রেনিং দিলেই, এবং কয়েকটা সিসিটিভি লাগালেই ডাক্তার-নার্স-কর্মচারী-রুগী-আত্মীয় সহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাঙ্ক্ষিত ‘নিরাপত্তা’ এসে যাবে, এরকম শিশু-সাহিত্য রচনা করেও কোনও লাভ নেই। জনতার আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় আজ দাঁড়িয়ে আছে এই প্রশাসনিক ‘ব্যবস্থা’টা। এই ব্যবস্থাই চতুর্দিকের অমানবিক পরিস্থিতি-পরিবেশের জন্য আসল দায়ী। সরকারি অনিচ্ছা, আমলা-পুলিশের অপদার্থতা (এবং সহযোগিতা), বিচারবিভাগের সীমাবদ্ধতা, সবকিছু মিলিয়েই এই ‘ব্যবস্থা’। কোনও উদ্ধত শাসকের হুঙ্কারে কিংবা কৌশলে একে সজুত করার কথা বলা, এটা নেহাতই একধরনের বালখিল্য ছ্যাবলামো। যুগযুগ ধরে অজস্র ধর্ষণ ঘটছে সমাজে, কিন্তু ডাঃ ‘তিলোত্তমা’ কাণ্ড “বিরলের মধ্যে বিরলতম।” লুম্পেন ব্যক্তি; পৈশাচিক গোষ্ঠী; অমানবিক পুলিশ; অপদার্থ আমলাতন্ত্র; ধর্ষক প্রশাসন; অযোগ্য প্রশাসক … সবকিছু মিলেমিশে যেখানে একাকার। ধর্ষণের বহুপরিচিত এবং খণ্ডখণ্ড চালচিত্র এখানে পুরোপুরি অচল।
(চার)
বৃহত্তর সমাজের ক্রোধ, আবেগ, অভিমান ইত্যাদি সবকিছুকে অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করার যে ঔদ্ধত্য শাসকরা দেখাচ্ছেন, তার যথার্থ ও দীর্ঘস্থায়ী মোকাবিলা সম্ভব একমাত্র মনুষ্যত্বের ও সামাজিকতার বোধে বলিয়ান, ঐক্যবদ্ধ সামাজিক শক্তির দ্বারা। বর্তমানে যাঁরা লাখো লাখো সংখ্যায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পথেই কাটাচ্ছেন, তাঁরা সকলেই উজ্জ্বল ভারতীয় মানবসন্তানদের অন্যতম। আর যারা সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে, আপাদমস্তক কর্পোরেট-সেবী রাষ্ট্রের স্তাবকতার মানসিকতা থেকে এই আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দেবার, কলঙ্কিত করার এবং বিপথগামী করার ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত, তারা ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে নিজেদের চরম অসামাজিক জীব হিসেবেই নিজেদের চিহ্নিত করে রাখলেন। তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ ‘বুদ্ধিমান’ ‘বিদ্দজ্জন’ লোকেরা, যারা জনবিরোধী রাষ্ট্রযন্ত্রের স্তাবকতা ও অনুকম্পা নিয়েই বেঁচে থাকার শপথ নিয়েছেন, তারাও নানাভাবে এই জনবিস্ফোরণের বিরোধিতা করছেন। নানারকম প্রগতিশীল বোলচাল শুনিয়ে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করতেই তাঁরা এখন সচেষ্ট। সুবিধামতো রাজনৈতিক ভোল পাল্টানো, চরম অসৎ ও মেরুদণ্ডহীন ধান্দাবাজদের মাথা নত করাতে হবে – লক্ষলক্ষ মানুষের সামাজিক আন্দোলন-সংগ্রামের চাপেই। মোমবাতির কিম্বা মোবাইলের ম্লান আলো, লক্ষলক্ষ মানুষের সামাজিক নব-জাগরণের আঙিনায় যে হাজার হাজার ওয়াটের বৈদ্যুতিক আলোর চেয়েও জোরদার হয়ে উঠছে, সেটাই আসলে সরকার তথা রাষ্ট্রশক্তিকে শঙ্কিত করে তুলছে।
হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনও ‘ভুল’ এবং দীর্ঘদিনের সুপরিকল্পিত, সুসংগঠিত, সুগভীর, পৈশাচিক ‘অপরাধ’-এর মধ্যে তফাৎ করতে না পারার মতো শিশু কোনও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব না। তাঁরা জেনেবুঝেই ন্যাকা সাজার ভান করেন। সচেতনভাবে অপরাধীদের এবং অপরাধ চক্রকে আড়াল করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।
কোনও মহৎ সামাজিক আন্দোলনের ‘বিজয়’ প্রতিদিনই রচিত হতে থাকে। ‘তিলোত্তমা’-কেন্দ্রিক সামাজিক আন্দোলনেও তা-ই ঘটছে।
# অমিত শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে এতো ব্যাপক ও বিশাল আন্দোলন সংগঠিত করতে পারাই – প্রথম জয়।
# সরকারের তীব্র ও সার্বিক বিরোধিতা সত্ত্বেও, লক্ষকোটি মানুষের মধ্যে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া – বিজয়ের দ্বিতীয় পর্ব।
# মহানগরী থেকে বিভিন্ন জেলা, শহর, রাজ্য হয়ে নানা মহাদেশের মাটিতেও ‘তিলোত্তমা’-র সপক্ষে ‘বিচার’-এর মহাদাবি উত্থাপন, – বিজয়ের তৃতীয় অধ্যায়।
# দুরন্ত গতিতে তৈরি লৌহপ্রাচীর সরিয়ে পুলিশের দাম্ভিক কর্তা নিজের প্রতিকী ‘মেরুদণ্ড’ গ্রহণ করতে বাধ্য হওয়া, – জয়ের চতুর্থ ধাপ।
# সবজান্তা, তোষামোদপ্রিয়, সদা-উদ্ধত, প্যাথলজিক্যাল মিথ্যাবাদী, প্রতিহিংসাপরায়ণ, স্বৈরাচারী শাসকের তরফ থেকে মুখরক্ষার তাগিদ বৃদ্ধি, – বিজয়ের পঞ্চম পর্ব।
# উদ্ধত ও আত্মম্ভরী শাসক ডাক্তারদের ধর্ণা মঞ্চে যেতে বাধ্য হওয়া এবং সমস্ত সরকারি হাসপাতালে ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’ ভেঙে দেবার ঘোষণা করতে বাধ্য হওয়া, বিজয়ের ষষ্ঠ পর্ব।
# আন্দোলনের দাবি মতো একাধিক পুলিশকর্তা ও আমলাদের (পদোন্নতির আড়ালে হলেও) অপসারণ, – বিজয়ের সপ্তম ধাপ।
# অভাবনীয় এই সামাজিক বিস্ফোরণের সমর্থক প্রথম সারির ডাক্তার-সাংবাদিক ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গকে চমকানোর জন্য পুলিশের দপ্তরে ডেকে পাঠানো, – অগ্রগতির অষ্টম পর্যায়।
# ‘গণতান্ত্রিক’ মুখোশটুকু খুলে ফেলে শান্তিপূর্ণ, এমনকি ‘আমরণ অনশন’ আন্দোলনের উপরেও প্রশাসনিক বিরোধিতা, হুমকি তথা হামলা, লুম্পেনবাহিনীর তরফ থেকে নগ্ন কুৎসা-মিথ্যাচার-হুমকি, – আন্দোলনের নবম বিজয়।
# জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দিয়ে, আন্দোলন জারি রেখেও লড়াইয়ের নতুন নতুন পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারা, – লড়াইয়ের দশম বিজয়।
এগুলোই “We want Justice” আন্দোলনের অসীম সম্ভাবনাকে সাহস জোগাচ্ছে। এই অভূতপূর্ব সামাজিক নব-জাগরণের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে শাসক সম্প্রদায়ের হিমশিম খাওয়ায় অবস্থা হয়েছে। স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, অর্থ ইত্যাদি সরাসরি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দপ্তরের দায়িত্ব স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। এগুলোর সম্মিলিত ব্যর্থতা, বঙ্গবাসীর সামনে মুখ্যমন্ত্রীর অপদার্থতাকে উলঙ্গ করে দিয়েছে। এখন শুধু মুখের বুলি এবং হাতের গুলির উপর নির্ভর করেই তাঁরা এই চরম অপদার্থতা থেকে পরিত্রাণ পাবার হাস্যকর চেষ্টা করে চলেছেন।
একের পর এক মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ, সভাপতি, চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা, ছাত্র নেতা, যুব নেতা, ইত্যাদিরা চুরি-জালিয়াতির অভিযোগে জেল খাটছে, – এমন লুম্পেন ‘সততা’-র নজির পশ্চিমবাংলায় তথা ভারতবর্ষে আগে কেউ কখনও কল্পনাও করতে পারে নি!
(পাঁচ)
ডাঃ ‘তিলোত্তমা’-র মৃত্যু-পরবর্তী সামাজিক আন্দোলনের অভিঘাতে নৈতিক পরাজয়ের ধাক্কাতেই শাসকপক্ষের এতো গায়ের জ্বালা। শাসকবর্গ কখনোই “কালের যাত্রার ধ্বনি” শুনতে পায় না; “দেয়ালের লিখন” পড়তে তারা চিরকালই অক্ষম। আজ উদ্ধত শাসক ভীত; কর্পোরেট জগতের লুঠেরাদের রক্ষাকারী রাষ্ট্রযন্ত্র দুশ্চিন্তাগ্রস্ত; শাসকগোষ্ঠীর স্তাবকবৃন্দ ক্ষিপ্ত; প্রতিবাদী জনগণ উল্লসিত এবং আশান্বিত। সরকারের স্তাবকবৃন্দ এই সামাজিক আন্দোলনে কতোরকম ‘অন্যায়’ ‘খারাপ’ ও ‘ক্ষতিকর’ দিক আছে, তা খুঁজে বের করতে অতি তৎপর! কিন্তু সরকারের হিমালয়সম অন্যায়, উদ্ধত, আত্মম্ভরী, মিথ্যাচারী এবং অ-মানবিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তাঁরা সর্বদাই অন্ধ, কালা ও বোবা। ব্যাপক সামাজিক ক্ষোভের গভীরতা ও তাৎপর্য বুঝতে তাঁরা হয় অনিচ্ছুক, অথবা অক্ষম। আন্দোলনের ধাক্কায় শাসক বারবার মাথা নোয়াতে বাধ্য হচ্ছে। যেকোনও বড়ো মাপের সামাজিক আন্দোলনে এগুলোই প্রকৃত বিজয়ের একেকটা মাপকাঠি। বাস্তবিকই ‘তিলোত্তমা’-কেন্দ্রিক এই আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে এক অভূতপূর্ব সামাজিক নব-জাগরণের সূচনা ঘটিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সারা ভারতবর্ষে। এমনকি পৃথিবীর নানা দেশেও বারবার সংগঠিত হচ্ছে প্রতিবাদী মিছিল – “উই ওয়ান্ট জাস্টিস”। তাঁরা আওয়াজ তুলছেন বাঙালি হিসাবেও। অতীতে এর কোনও তুলনা নেই। এতো ব্যাপক, এতো গভীর, এতো সচেতন, এতো স্বতঃস্ফূর্ত, এতো তেজস্বী নব-জাগরণ বাংলা তথা ভারতবর্ষ আগে কখনও দেখে নি।
সমাজের প্রতিটি কোনায় যে ‘হুমকি সংস্কৃতি’ (থ্রেট কালচার) জাঁকিয়ে বসেছে বর্তমান সরকার এবং তার তাঁবেদার বাহিনীর কল্যাণে, তার বিরুদ্ধে সামাজিক স্তরে গড়ে উঠছে অগ্রাহ্য করার মানসিকতা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, নিজে জুনিয়ার ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনার সময়ে হুমকিও শুনিয়েছেন তাঁদের! ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে নিয়মানুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবারও যে তিনি বিরোধী, তা দাপটের সঙ্গেই বুঝিয়ে দিয়েছেন খোলাখুলি। অর্থাৎ যে ‘থ্রেট কালচার’ কংগ্রেসী লুম্পেন বাহিনী শুরু করেছিলো সত্তরের দশকে, তিনি নিজে আজও সেই কালচারের অন্যতম পুরোহিত। কিন্তু মন্ত্রী-সান্ত্রী-লুম্পেনদের ধমকানি-চমকানিকে আর কেউ তেমন গ্রাহ্য করছেন না। চোখে চোখ রেখে, মেরুদণ্ড টান করে কথা বলছে মানুষ। প্রধানত এটাতেই ভীত, সন্ত্রস্ত, আতঙ্কিত, এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে শাসকবর্গ। রক্ত-লাশ-ভাঙচুরের মতো আদর্শহীন, মনুষ্যত্বহীন, প্রতিক্রিয়াশীল, লুম্পেন রাজনীতি করতে করতেই যাদের জীবন গড়ে উঠেছে। প্রগতির হাজার হাজার শ্রেষ্ঠ বাঙালি সৈনিককে খুন করে প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে সক্রিয়ভাবে বাড়িয়ে তোলার কর্মকাণ্ডেই তারা মশগুল ছিলো যৌবনে ও প্রৌঢ়ত্বে। আজ বার্ধক্যের প্রারম্ভে এসে, আজীবন প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিবর্গ হঠাৎ বিড়াল তপস্বী সাজার বৃথা চেষ্টায় এখন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাদের জন্য পুলিশ-মন্ত্রী-আমলাদের দেওয়া রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেও, স্তাবকদের কাছ থেকে তারা অকুণ্ঠ বাহবা পেলেও, তাদের দুষ্কর্মগুলো সামাজিক মান্যতা পাবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সবরকম ভাবেই আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য অপচেষ্টার পাশাপাশি, “আমরাও ‘তিলোত্তমা’-কাণ্ডের বিরোধিতা করছি” – এরকম ভাবভঙ্গি বৃহত্তর সমাজের কাছে হাস্যকর। এই নাটক সমাজে মান্যতা পাবার ন্যূনতম সম্ভাবনাটুকুও নেই।
লাগাতার ও ব্যাপক সামাজিক আন্দোলনের চাপে রোজই এখানে-ওখানে একটুএকটু করে আঁধার কাটছে, আলো ফুটছে। দাম্ভিক মন্ত্রী-আমলা-পুলিশের দম্ভ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
“আমরা ক্ষমতায় না থাকলেই বিজেপি এসে ধরবে কিন্তু!” – আজন্ম বিজেপি-র “মিত্রোঁওঁওঁ” হয়ে, এই ছেলে ভুলানো ছড়া আওড়ালে কী তার মান্যতা থাকে?
“আমরা গেলেই কর্পোরেট দুনিয়া গিলে খাবে!” – কর্পোরেট দুনিয়ার আসল রক্ষাকর্তা যে ভারতরাষ্ট্র, তার “সংবিধানসম্মত” সেবক হবার পরেও, এইধরনের ন্যাকামোর যে আর কোনও মান্যতা থাকে না, সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধিবৃত্তিও সম্ভবত লোপ পেয়েছে বর্তমান শাসকবর্গের।
বলিষ্ঠ এবং তীক্ষ্ণ প্রশ্নাবলির সামনে নিরুত্তর, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও মিথ্যাচারী প্রশাসনিক মাতব্বররা এখন শুরু করেছেন জঘন্য ‘মৃত্যুর রাজনীতি’! অবিরাম মিথ্যা, বিকৃত, বিভ্রান্তিকর, স্ববিরোধী ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রচার চালাচ্ছেন মরিয়া হয়ে। জনরোষকে বিভ্রান্ত আর বিপথে চালিত করার কৌশলী অপপ্রয়াসও চলছে। দুর্গন্ধযুক্ত পাঁক থেকে নিজেরা উদ্ধার পাবার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে আপাদমস্তক কলুষিত সরকার। আন্দোলনের বিরোধিতায় কিম্বা আন্দোলনের চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য দেয়ালে-রাস্তায়-সোশ্যাল মিডিয়ায় যে তৎপরতা চলছে চতুর্দিকে, যে উৎসাহ নিয়ে আন্দোলন সম্পর্কে কুৎসা করতে ঝাঁপিয়েছে তারা, তার ভগ্নাংশের দেখা যদি মিলতো আগে, ডাঃ ‘তিলোত্তমা’ তাহলে বেঁচে থাকতেন! প্রয়োজন পড়লে শোষক ‘রাষ্ট্রযন্ত্র’, তার পাহারাদার ‘সরকার’, তার সেবাদাস ‘দল’ – এরা কতটা বিবেকহীন ও নোংরা হতে পারে, এবং উচ্চশিক্ষিত আমলা-পুলিশ-’বিদ্দজ্জন’ ইত্যাদি আত্মস্বার্থসর্বস্ব ও ধান্দাবাজ স্তাবকবৃন্দ কতটা মনুষ্যত্বহীন জঘন্য ভূমিকা পালন করতে পারে, তার নিত্যনতুন উদাহরণ তৈরি হয়েই চলেছে। আপাদমস্তক লুম্পেনরাজের প্রকাশ ঘটে চলেছে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। উচ্চপদাসীন মন্ত্রী-সান্ত্রী-আমলা, সকলেই ভুলে যান – তাঁদের সকলেরই বিধিবদ্ধ কর্তব্য জনগণের সেবা করা; ডাঃ ‘তিলোত্তমা’-র মতো নিগৃহীতাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করা। কখনোই ক্রিমিনালদের সহায়তা করা না। একথাও ভুলে যান, তাঁদের নিজ জীবনধারণের যাবতীয় উপার্জন ও ফুটানির রসদও আসে জনগণের দেওয়া টাকাতেই। অথচ, প্রতিমুহূর্তে এইসব সমাজবিরোধীদের মোড়লি আর মাতব্বরি সহ্য করতে হয় অন্নদাতা সমাজকেই!
এখানে একটা “নির্বাচিত সরকার” ক্ষমতায় রয়েছে। তার জবরদস্ত্ পুলিশ-প্রশাসন-আমলাবাহিনী সবই মজুত আছে। আইন-আদালত-বিচারব্যবস্থা, কিছুরই অভাব নেই। সবই জনগণের টাকায় তৈরি এবং পোষিত। অথচ, প্রত্যেকটি মানুষই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছিলেন! সেই ভয় এবার ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বলিষ্ঠ দাবি উঠছে – “বিচার চাইছে জনতা, জবাব দাও ক্ষমতা”।
শাসকবর্গ এখন মরিয়া। তারা পুরোপুরিই “থ্রেট
কালচার”-নির্ভর হয়ে উঠেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, স্বাস্থ্যগত, … সব ক্ষেত্রেই। ‘সত্তর দশক’-এ কংগ্রেসী লুম্পেনবাহিনী এবং রণজিৎ গুপ্ত-রুনু গুহনিয়োগীদের হাতে যে কালচারের সূত্রপাত হয়েছিলো, তৃণমূল কংগ্রেস রাজত্বে এসে “রাফ অ্যাণ্ড টাফ” মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে সেই কদর্য লুম্পেন কালচারেরই উত্তরাধিকার আমরা দেখছি। ডাঃ ‘তিলোত্তমা” ধর্ষণ-খুনকে কেন্দ্র করে পুলিশের ও প্রশাসনের উচ্চ পদাধিকারীগণের নিষ্ঠুর অমানবিক ভূমিকা, কিছু অমানবিক ও ক্ষমতাবান ডাক্তারদের পরিকল্পিত ও পৈশাচিক কর্মকাণ্ড, এবং এইসব মনুষ্যত্বহীন ঘটনায় লুম্পেন প্রশাসনের পরিপূর্ণ রক্ষকের ও পালকের ভূমিকা – পুঁতিগন্ধময় ‘সত্তর দশক’-এর পুনরাবির্ভাব।
সভ্যতার চেয়ে অ-সভ্যতা; সততার চেয়ে অ-সততা; গণতন্ত্রের পরিবর্তে অ-গণতন্ত্র; নৈতিকতার পরিবর্তে নীতিহীনতা; … এগুলোই এখন শাসক কূলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠেছে। জনগণের মধ্যে নানারকমভাবে টাকা বিলিয়ে – অভাবী মানুষের মুখ বন্ধ করার খেলাই এখন তাদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
(ছয়)
জুনিয়ার ডাক্তারদের সঙ্গে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সভার লাইভ স্ট্রিমিং-এ কোটিকোটি মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে:
১) সরকার ক্রিমিনাল ও ধর্ষকদের রক্ষকের ভূমিকা নিয়েছে;
২) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতাকে দুরমুশ করতে সরকার নির্লজ্জভাবে তৎপর;
৩) মুখ্যমন্ত্রী চূড়ান্ত অসংবেদনশীল ও স্বৈরাচারী শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই চলেন; এবং
৪) গোড়া থেকে সমস্যার মূল উপড়ে ফেলার তিলমাত্র ইচ্ছাও নেই সরকারের।
আরজি কর দীর্ঘদিন ধরেই অকল্পনীয় দুর্ণীতির আখড়া হয়ে উঠেছিলো। জুনিয়ার ডাক্তাররা ১৩৭ পৃষ্ঠার দুর্ণীতি-নথিতে সেব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে দিয়েছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কথাবার্তা ও হাবভাবে এটা স্পষ্ট, উনি এগুলো নিয়ে আদৌ আগ্রহী না। নম্রতা তথা মানবিকতা তথা যুক্তিগ্রাহ্যতা – কিছুরই লেশমাত্র নেই তাঁর! আছে শুধুই তীব্রতম ‘অহং’ বোধ।
আন্দোলনরত ডাক্তারদের মুখোমুখি হয়ে যে “ছাত্র আন্দোলন”-এর কথা গর্বিত স্বরে বলেছেন ‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী’, সেই ‘আন্দোলন’ ছিলো প্রগতি নাশক। কমিউনিস্ট তথা বামপন্থী তথা প্রগতিশীল ধারার শত্রু। তাদের সংগঠন ‘ছাত্র পরিষদ’ ও ‘যুব কংগ্রেস’ সেদিন ছিলো লুম্পেন ও খুনে বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক আশ্রয়। প্রথমে ‘নকশাল’-দের নিকেশ এবং তারপর ‘সিপিআই(এম)’-দের ঢিট করা, এটাই ছিলো তাদের একমাত্র কর্মসূচি। সেই ধারা মেনেই, এবার ডাক্তারদেরও একটি সংগঠন হঠাৎ করে গড়ে তোলা হলো, রাতারাতি! প্রথা মেনে তদন্ত চালিয়ে যাদের “নটোরিয়াস ক্রিমিনাল” বলা হয়েছে; যাদের একের-পর-এক ছবি রয়েছে ক্রিমিনাল-চূড়ামনিদের সঙ্গে; এতো ব্যাপক সামাজিক আন্দোলনের ধারেকাছেও যাদের দেখা যায়নি এতোদিন; – তাদেরই সংগঠন এটি। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খুবই পরিস্কার, যেনতেনভাবে বৃহত্তর সমাজের বুকে আশা জাগানো “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” আন্দোলনের সংগঠিত বিরোধিতা এবং নাশকতা চালানো। ‘ছাত্র পরিষদ’ ছিলো জমিদার-জোতদারদের ঠ্যাঙারে বাহিনী এবং গণশত্রু তথা গণহত্যাকারী কংগ্রেসের ছাত্র শাখা। আর এবারে তৈরি হলো লুম্পেন তৃণমূল কংগ্রেসের আশির্বাদপুষ্ট এবং ডাঃ ‘তিলোত্তমা’-কে হত্যাকারী ক্রিমিনালদের সহযোগী এক সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গের সত্যিই দুর্ভাগ্য! লুম্পেনদের উদ্যোগেই আবার নতুনভাবে শুরু হলো – কিছু সম্ভাবনাময় বঙ্গসন্তানকে ক্রিমিনাল বানিয়ে তোলার প্রশাসনিক প্রয়াস!
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত সামাজিক আন্দোলনকে সমর্থন ও শক্তিশালী করার পরিবর্তে, তাকে প্রতিরোধ করার জন্য সরকার যেভাবে ক্রমশ নীচে… আরও নীচে নেমেই চলেছে, তাতে আগামী দিনগুলোত কোন ভয়াবহ পশ্চিমবঙ্গ তৈরি হতে চলেছে, তা গভীর দুশ্চিন্তার বিষয়! পেশিশক্তির রমরমার সঙ্গেসঙ্গে সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক আগ্রাসনের দাপটও ক্রমশই তীব্র করা হচ্ছে। আবার যেনো “সত্তর দশক”-এর বিভিষিকাময় পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে! পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে, পুরো বঙ্গজীবনকে অবক্ষয় ও অধঃপতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে নামিয়ে এনে তবেই যেনো এদের সন্তুষ্টি!
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে গেলে শোষক ও শাসকের বিরুদ্ধে সবসময়েই প্রতিবাদ-আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। ‘ওপার বাংলা’-য় চট্টগ্রামের পাহাড় কিংবা ‘এপার বাংলা’-য় কলকাতার সমতল – এব্যাপারে কোনও পার্থক্য নেই। আদিবাসী কল্পনা চাকমা কিংবা বাঙালি ডাঃ ‘তিলোত্তমা’ – প্রতিবাদী চরিত্রকে জনবিরোধী রাষ্ট্র আর লুম্পেন সরকার একই পদ্ধতিতে মোকাবিলা করে – স্রেফ নিকেশ। বহুনিনাদিত ‘বিচার’ সবক্ষেত্রেই এক প্রহসন মাত্র! রাষ্ট্রীয় সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক তুলে নিয়ে যাওয়া কল্পনা চাকমার মামলা ২৮ বছর পরে, এবছরের এপ্রিল মাসে ‘খারিজ’ করে দিলো আদালত! “মামলা খারিজের মাধ্যমে এই অপহরণের সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একপ্রকার দায়মুক্তি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক নতুন নজির তৈরি হলো।” ডাঃ ‘তিলোত্তমা’-র ধর্ষণ ও খুনের ‘তদন্ত’-ও পুলিশ, সিবিআই, আদালত ইত্যাদি সিঁড়ি পেরিয়ে চলতে চলতে শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছায়, দেখা যাক! তবে ‘তদন্ত’-র গতিপ্রকৃতি আর বেশকিছু সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ইতিমধ্যেই বহু সন্দেহের জন্ম দিয়েছে জনমানসে। প্রশাসনের কথাবার্তা; পুলিশের ‘তৎপরতা’: সিবিআই-র ‘দক্ষতা’; ইউনিয়ন সরকারের হাবভাব; আদালতের ‘নির্দেশ’; – সব মিলিয়ে ‘তিলোত্তমা’-র ধর্ষণ-খুন ‘তদন্ত’-র ভবিষ্যৎও যথেষ্ট সন্দেহজনক!
(সাত)
গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তির উত্তরাধিকার যাদের কাছ থেকে পেয়েছে পশ্চিমবাংলার বর্তমান শাসকবর্গ, সেই কংগ্রেসের ইতিহাস চিরকালই নারী-হত্যায় ও নারী-নির্যাতনে কলুষিত। পুলিশের গুলিতে প্রথম ছিন্নমূল নারী নিহত হন, বীণাপাণি মিত্র। কমিউনিস্ট বন্দীদের মুক্তির দাবিতে কলকাতার রাস্তায় মিছিলকারী লতিকা সেন, প্রতিভা গাঙ্গুলি, গীতা সরকার, অমিয়া দত্তকে পুলিশ গুলি চালিয়ে খুন করে (১৯৪৯)। এই সব ঘটনাই হয়েছে “বাংলার নব রূপকার” (!) কংগ্রেস নেতা বিধান রায়ের আমলে। তারপর, নির্দিষ্টভাবে যে মানু-রুনুর কাছ থেকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল লুম্পেন কালচারের দীক্ষা নিয়েছিল বর্তমান শাসকরা, সেই আমলে ইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অর্চনা গুহর উপর বীভৎস অত্যাচারের ঘটনা (১৯৭৪) ইতিহাসের চির কলঙ্ক। বিনাবিচারে, টানা ২৭ দিন লালবাজারে পৈশাচিক অত্যাচারে তাঁর নিম্নাঙ্গ পুরো পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। ১৯৭৬ সাল থেকে দীর্ঘ ১৯ বছর মামলা চলার পর, ১৯৯৬ সালে ব্যাঙ্ক শাল কোর্টের ব্যতিক্রমী রায়ে রুনু গুহনিয়োগী অপরাধী ঘোষিত হয়। কিন্তু তার কোনই শাস্তি হয়নি! ‘অর্চনা গুহ মামলা’ সারা বিশ্বে পৈশাচিক অত্যাচারের এক ঐতিহাসিক নজির হিসাবে নথিবদ্ধ হয়ে আছে।
এই পৈশাচিক কালচারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের আমলে যে ‘তিলোত্তমা’-কাণ্ড ঘটেছে এবং সেসম্পর্কে সরকারের লজ্জাজনক ভূমিকাই প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে এতটুকুও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ধুতরো গাছে কখনোই আপেল ফলে না। যদি ধরেও নেওয়া যায়, কোনও ঘটনা পুরোপুরিই শাসকের জ্ঞান ও প্রভাব মুক্ত, তবে ঘটনা-পরবর্তী সময়ে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গী কথা ও কাজ দিয়েই পরিষ্কার বোঝা যায়। ডাঃ ‘তিলোত্তমা’র পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যে বীভৎস ও (সম্ভাব্য) দলবদ্ধ পৈশাচিকতার স্বাক্ষ্য বহন করছে, এবং পুরো বিষয়টি নিয়ে শাসকবর্গের যে কদর্য ভূমিকা ফুটে উঠছে, তা বর্বর ‘সত্তর দশক’-এর যথার্থ উত্তরসূরিদেরই সাজে! ধর্ষক আর ক্রিমিনালরা আজ পশ্চিমবাংলায় বেপরোয়া; বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। একের পর এক ধর্ষণ চলছেই। অন্যদিকে, নিপীড়িত এবং ভুক্তভোগী জনগণই সর্বদা আতঙ্কিত; এবং তারাই বরং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।
“অনুনয়ের করুণ কাকলি” শাসকদের কানে কোনোকালেই ঢোকে না। ১৯৮৩ ও ১৯৮৬ সালের পরে আবার ২০২৪, জুনিয়ার ডাক্তারদের তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক আন্দোলন একটা শিক্ষা অন্তত হাজির করেছে পশ্চিমবঙ্গবাসীর সামনে। নিজেদের শ্রেণী বা গোষ্ঠীর স্বার্থকে উপেক্ষা করে, বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আন্দোলন করা যায়। তার নজির একমাত্র জুনিয়ার ডাক্তাররাই বারবার দেখাচ্ছেন। কখনও বামফ্রন্ট আমলে, আবার কখনও তৃণমূল কংগ্রেস জমানায়। যারা এই অভূতপূর্ব গণআন্দোলনকে ব্যাঙ্গ ও বিরোধিতা করেই তাঁদের ‘প্রগতিশীল’ ভূমিকা পালন করতে চাইছেন, ডাঃ ‘তিলোত্তমা’ ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা জনআন্দোলনের বিরোধিতা করে তাঁরা নিজেরা শুধু সমাজের ধিক্কার ও ঘেন্নার পাত্র হয়ে রইলেন। তথাকথিত ‘কর্পোরেট বিরোধিতা’-র আওয়াজের আড়ালে, তাঁরা নিজেরাই ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সেবক হয়ে রইলেন। কোনও আন্দোলন-সংগ্রাম না হলে, সকলেই “অতি সুবোধ বালাক” হয়ে থাকলে, সব সরকারেরই ‘গণতান্ত্রিক’ মুখোশ বজায় থাকে। স্তাবকরাও তখন ‘সুবোধ’ সেজে থাকে।
“তিলোত্তমার বিচার চাই” সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সোনার টুকরো ডাক্তারদের বুক দিয়ে আগলানো এবং সর্বতোভাবে সহযোগিতা করা আমাদের সকলের সামাজিক ও মানবিক কর্তব্য। ‘তিলোত্তমা’র বাবা-মায়ের অনুরোধে জুনিয়ার ডাক্তাররা ১৭-দিনের ‘আমরণ অনশন’ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বলদর্পী শাসকদের এবার নতুন করে মুখোমুখি হতে হবে আরও ব্যাপক, আরও জোরদার, আরও শক্তিশালী “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” আন্দোলনের ঝড়কে। মিছিল, অনশন, মহামিছিল, ‘দ্রোহের কার্নিভাল’, গণ-কনভেনশন, ‘দ্রোহের আলো’, ‘জনতার চার্জশিট’, ‘দ্রোহের গ্যালারি’… আন্দোলনে কর্মসূচির বিরাম নেই। প্রশাসনিক মাতব্বরদের মদতে গড়ে ওঠা ‘লুম্পেন-মেড কান্না’ প্রতিরোধের এই সামাজিক সুনামী মোকাবেলা করতেই হবে তাদের। সরকারের পদলেহী স্তাবকদের আরও বহু ‘আক্কেল সেলামি’ দিতে হবে বলেই মনে হয়। কোনও ব্যাপক জনআন্দোলনের রাস্তা ও পরিণতি আগে থেকে ছকে রাখা থাকে না। চলতে চলতেই ঠিক হয়। আন্দোলন কখনোই সোজা রাস্তায় চলে না; চলতে পারে না। অজস্র ‘কিন্তু’ ‘তবে’ ‘যদি’ অতিক্রম করতে করতেই তাকে এগোতে হয়। তা-ই হচ্ছে, তা-ই হবে। “পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা।” – এটাই জন-আন্দোলনের পথরেখা।
লুম্পেন-পিশাচদের বলদর্পী বাহিনী ডাঃ ‘তিলোত্তমা’ ধর্ষণ-খুনের জন্য প্রকৃত দায়ী গণশত্রুদের শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে পারবে কিনা, তা সময় বলবে। কিন্তু সচেতন, ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক শক্তিকে মোকাবিলা করতে গেলে ‘কতো ধানে কতো চাল’ হয়, তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে পশ্চিমবাংলার ‘নির্বাচিত’ লুম্পেন শাসকপক্ষ। শাসক আর শাসিত, শোষক এবং শোষিত, ইতিহাসে উভয় পক্ষের কাছেই উল্লেখযোগ্য শিক্ষক হয়ে থাকবে “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” দ্রোহ।।¶
১৩ নভেম্বর, ২০২৪