১.
শহরের রাজপথে রাশি রাশি জীবন্ত কঙ্কাল..
বুকের পাঁজর গোনা যায়। কোটরাবৃত চোখ। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ‘মানুষের সৎ ভাই’ শুধু ‘ফ্যান’ চায়। তার বেশি চেয়ে ফেলারও স্বপ্ন দেখে না তারা। অলি-গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্ষুধার্ত মানুষের লাশ। শকুনের মধ্যাহ্নভোজের বিপুল আয়োজন..
গ্রামের পর গ্রাম উজাড়। মানুষ পালাচ্ছে.. পালাচ্ছে ক্ষুধার চোটে.. পালাচ্ছে একান্ত আপন প্রিয়জনের থেকে.. পালাচ্ছে বুক মোচড়ানো ভালোবাসার খড়ের ছাউনি কুঁড়েঘর থেকে..
অসহ্য খিদের জ্বালা ভুলিয়ে দিচ্ছে স্বজন হারানোর ব্যথা। মানুষ কোনোমতে শহরে আসতে চায়। শহরে অন্তত উচ্ছিষ্ট ফ্যানটুকু মেলে।
বাড়ির মেয়েরা বিকিয়ে গেছে বড়লোক বাবুদের বাড়িতে কিংবা ‘নোংরা পাড়া’য়। সেখানে একবার গেলে সভ্য সমাজে আর ঠাঁই মেলে না। শরীরের বিনিময়ে মেলে একবেলার ভাত।
মায়ের বুকের দুধ শুকিয়েছে। চোখের জলেরও দেখা মেলে কদাচিৎ। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে অস্থিচর্মসার দুধের শিশু.. উলঙ্গ, জীর্ণ, মৃতপ্রায়..
তেতাল্লিশের মন্বন্তর। অকালে ঝরে গেছিল তিরিশ লক্ষ মানুষ।
২.
রেলপথ তৈরির পর থেকেই প্রাকৃতিক পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্ষায় জল জমে যায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত শক্ত করা আর যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির স্বার্থে শস্যশ্যামলা বাংলায় এলো ম্যালেরিয়ার মহামারী।
কৃষিনির্ভর বাংলায় তখন জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। এদিকে চাষবাসের পদ্ধতির সেরকম উন্নতি হয়নি। ফলে বাড়তি জনসংখ্যার বোঝা নিয়ে বাংলা ধুঁকছিল। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ৪২ সালে আমন ধানের ক্ষেত ছেয়ে গেল ছত্রাক সংক্রমণে। উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হ’ল।
তার মধ্যেই জাপান বার্মা অধিকার করে দ্রুত ব্রিটিশ শাসিত ভারতের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করলো। প্রমাদ গুনলো ব্রিটিশ রাজ। বার্মা পেরোলেই বাংলা। কাজেই সব খাদ্যশস্য, পোষাক দ্রুত সরিয়ে ফেলা হ’ল সেনাবাহিনী আর উচ্চপদস্থ কর্মীদের জন্য। বাকি যা পড়ে রইলো সব পুড়িয়ে ফেলতে বাধ্য করা হ’ল। দশজনের বেশি বহনকারী নৌকো নষ্ট করে ফেলা হ’ল। যাতে জাপানি সেনা কোনোভাবেই জলপথে বাড়তি সুবিধে না পায়। আর তার ফলশ্রুতিতে স্রেফ ধ্বংস হয়ে গেল অগণিত কৃষক, মৎসজীবী ও অন্যান্য গ্রামীণ মানুষ।
জোতদাররা বাড়তি চাল জমিয়ে রেখে কৃত্রিম অভাব তৈরি করলো। কিন্তু প্রভুর কাছে বাধ্য থেকে স্বল্প দামে বিক্রি করলো সৈন্যদের প্রয়োজনে। আর দাম উশুল করলো সাধারণ মানুষের থেকে। ৪২-এর অক্টোবরে যে চালের মণপ্রতি দাম ছিল ৬ টাকা, সেটাই তিনমাস বাদে বেড়ে হ’ল ১৫ টাকা। বছর খানেকের মধ্যে ১০০ টাকা। স্বভাবতই, সে বহুমূল্য ভাত বিপুল সংখ্যক খেটে খাওয়া মানুষের কাছে শুধুমাত্র বিলাসিতা। অতঃপর, দীর্ঘ ক্ষুধার্ত দিন.. অন্তহীন রাত..
অনাহার আর অপুষ্টির হাত ধরেই এলো ম্যালেরিয়া, টিবি, গুটি বসন্ত। ‘এ দুঃসময়.. এ ঘোর প্রলয়.. ‘
ব্রিটিশ শাসক চায়নি এ দুর্ভিক্ষের খবর প্রকাশ পাক। তাই বহুদিন উন্নত বিশ্বের কাছে খবর গোপন করা হয়। দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকা প্রথম এ ব্যাপারে খবর করলে হৈ-চৈ শুরু হয়। অনাহারের খবর পেয়ে অস্ট্রেলিয়ান সরকার ভারতে সাহায্য পাঠাতে চাইলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বাধা দেন। বরং, খাদ্যশস্য বোঝাই জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য পাঠিয়ে দেন। অভুক্ত মানুষের আর্তনাদ উপেক্ষা করে লক্ষাধিক জাহাজ ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
৩.
দলে দলে ভারতীয় সেনা যুদ্ধে গেছে। সম্মুখসমরে মারাও পড়েছে শ’য়ে শ’য়ে। ‘ডার্টি নিগার’দের জীবনের মূল্যই বা কতটুকু?
অবশেষে জাপানি শক্তির পরাজয় হয়েছে। একজন ‘মোটা মানুষ’ আর একটি ‘ছোট্ট বালক’-এর নৃশংসতায় ছারখার হয়ে গেছে জাপান। রক্ত আর হত্যালীলার নতুন ইতিহাস লেখা হয়েছে। সে অধ্যায় খুললে আজও বিশ্ব আতঙ্কে নীল হয়ে যায়।
যুদ্ধ শেষ। বহুদিন ঘরছাড়া সৈনিক ঘরে ফিরছেন। প্রিয়তমা-কে চিঠি লিখতে বসে বারবার ফিরে আসছে দেশের কথা, বাড়ির কথা..
“তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে,
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে
কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে
তোমার আর তোমাদের ভাবনায়।
তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে
ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,
ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে
বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব।
আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্র।
জানি না আজো, আছ কি নেই,
দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে
জানি না তাও”
৪.
আরও একটা যুদ্ধ চলছে আজ। মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই। যুদ্ধের প্রধান সৈনিক স্বাস্থ্যকর্মীদের কাঁধে ‘দুর্জয়’ স্টেথোস্কোপ। শুধু ‘সৈনিকের কড়া পোষাক’ নেই। রোগাক্রান্ত মানুষের চিকিৎসায় অনেক সময়েই ছেঁড়া রেনকোট কিংবা পাতলা কাপড়ের মাস্ক সম্বল। প্রতি মূহুর্তে ঝুঁকি নিয়েই লড়ে যাচ্ছেন নির্ভীক স্বাস্থ্য-সৈনিক। প্রিয় হাত, প্রিয় বুক, প্রিয় ঠোঁট ভুলিয়ে দিচ্ছে কর্তব্যবোধ।
৪৩-এর মন্বন্তর শেষে সে বছরের ডিসেম্বরে রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়। ‘মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি’ এসে ক্ষুধার অভিশাপ ঢেকে দেয়।
এবারের অভিশাপ কাটবে কিনা তা সময়ই বলবে। কেননা এই যুদ্ধটা শুধু সৈনিকের পারদর্শিতায় জেতা যাবে না। জনগণের সামগ্রিক সচেতনতা না হ’লে পরাজয় অনিবার্য। একজন স্বাস্থ্যকর্মী যথাযথ নিরাপত্তা ছাড়াই রোগের সাথে পাঞ্জা নেওয়ার ঝুঁকি নিতে পারেন আর আমরা একটা সান্ধ্য আড্ডার মজলিশ বিসর্জন দিতে পারি না। মানুষ সচেতন না হ’লে কোনও প্রশাসনই কিছু করতে পারবেন না। হয়তো যুদ্ধফেরত কোনও স্বাস্থ্য-সৈনিক আজও লিখবেন..
“আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরেঅথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।”
শুধু জয়ী হিসেবে নাকি পৃথিবীর মৃতদেহের ওপর, তার উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ..