আচ্ছা কখনো কি ভেবে দেখেছেন “7 up” নামক কোল্ড-ড্রিংকস এর নাম এমন হল কেন? এখন হয়তো আবার ভাবছেন লিথিয়ামের কথা লিখতে বসে আবার “7 up”-এর গল্প শুরু করলাম কেন। আসলে দুটোর মধ্যে একটা যোগাযোগ আছে।সে গল্পই আজকে শোনাব।
যে সময়ের কথা বলছি সেটা 1843 সাল। আলেকজান্ডার উরি নামের এক বিজ্ঞানী দেখলেন মূত্রথলিতে তৈরি ইউরিক এসিড স্টোন লিথিয়াম কার্বোনেটের দ্রবণে ফেলে দিলে সেগুলি কিছুক্ষণের মধ্যেই গলে যাচ্ছে। এবার চলে আসি 1847 সালে। এই সময় লন্ডনের চিকিৎসক আলফ্রেড গ্যারোড গবেষণা করে দেখলেন বাতের রোগীদের রক্তে অতিরিক্ত পরিমাণে ইউরিক এসিড থাকে। তাই তিনি লিথিয়ামের বিভিন্ন যৌগকে বাতের চিকিৎসায় ব্যবহার করা শুরু করলেন।
এই সময় গবেষকদের মধ্যে ক্রমশ এই ধারণা তৈরি হল যে শরীরে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিক এসিডের কারণেই নানান রোগ তৈরি হয়। তাই কিডনিতে পাথর হলে সেখানেও লিথিয়ামের বিভিন্ন যৌগ ব্যবহৃত হতে লাগল। সেই সময় চিকিৎসকদের কাছে পেটের সমস্যা থেকে শুরু করে মাথার সমস্যা সব কিছুতেই লিথিয়াম যেন সর্বরোগহারক।
লোকমুখে রটে গেল কিছু কিছু ঝর্ণার জলে লিথিয়াম থাকে। তাই সেইসব ঝর্ণার জলের নাকি নানান রোগ নিরাময় ক্ষমতা আছে। কিছু ব্যবসায়ী “লিথিয়া ওয়াটার” নামে সেই সব ঝর্ণার জল বোতলবন্দি করে বেচতেও লাগলেন। বিয়ার তৈরিতেও এই জাতীয় জলের ব্যবহার হতে লাগল।
“7 up”নামক পানীয়টির নামে “7 ” ব্যবহারের কারণ লিথিয়ামের পারমাণবিক ওজন 6.9 অর্থাৎ প্রায় 7। আর এই পানীয় খেলে মন সতেজ হবে এই কারণে “up”কথাটির ব্যবহার। 1950 সাল অব্দি এই পানীয় প্রস্তুত করতে লিথিয়াম ব্যবহৃত হত।
এই ভাবে চলতে চলতে লিথিয়ামের জনপ্রিয়তা এতটাই বাড়ল যে 1907 সাল নাগাদ ইউরোপে প্রায় 43 রকমের লিথিয়ামের নানান যৌগ ঔষধ হিসাবে পাওয়া যেত। ক্রমশ দেখা গেল এই সব ঔষধের ভালো রকমের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে এবং প্রচারের তুলনায় অনেকটাই কম কাজের।তাই লিথিয়ামের জনপ্রিয়তা এবার কমতে থাকল।
মেলবোর্নের বান্দুরা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসক ছিলেন ডাঃ জন এফ কাড। মানসিক রোগের চিকিৎসা বলতে তখন উপায় ছিল হয় বেঁধে রাখা, ঘুম পাড়িয়ে রাখা অথবা শক থেরাপি। যদিও সে সময় বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি বা উপযুক্ত রসায়নাগার ছিল না, কিন্তু ডাঃ কাড থামবার পাত্র ছিলেন না। তিনি তাঁর সীমিত ক্ষমতায় নতুন নতুন ঔষধ আবিষ্কারের চেষ্টায় দিন রাত মগ্ন থাকতেন। সেই সময় চিকিৎসকদের ধারণা ছিল শরীরের কোন বিশেষ কেমিক্যাল মাত্রাতিরিক্ত থাকলে ম্যানিয়া রোগ হয় আর কম থাকলে ডিপ্রেশনের সমস্যা হয়। শরীরে কোন কেমিক্যাল বেশি থাকলে তা নিশ্চই রোগীর প্রস্রাবের সাথে বেরোবে। ডাঃ কেড তাই বিভিন্ন রকমের মানসিক রোগীদের প্রস্রাব নিয়ে গিনিপিগের শরীরে প্রবেশ করিয়ে ফলাফল দেখতেন। দেখা গেল ম্যানিক রোগীদের প্রস্রাব গিনিপিগের শরীরে সব চাইতে মারাত্মক প্রাণঘাতী প্রভাব ফেলছে। তিনি পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে প্রস্রাবের মধ্যে থাকা ইউরিয়া থেকেই এই সমস্যা হচ্ছে। তার পরেই তিনি ভাবতে থাকলেন কিভাবে এই ইউরিয়ার ক্ষতিকারক প্রভাবকে বাড়ানো বা কামানো যায়।দেখা গেল ইউরিক এসিড ,ইউরিয়ার ক্ষতিকারক প্রভাবকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ইউরিক এসিড জলে দ্রবণীয় নয় বলে সেভাবে পরীক্ষা করা যাচ্ছিল না।ডাঃ কাড সে সময় ডাঃ গ্যারোডের গবেষণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরিক এসিডকে লিথিয়ামে দ্রবীভূত করে লিথিয়াম ইউরেট তৈরি করলেন। গিনিপিগের শরীরে লিথিয়াম ইউরেট ও ইউরিয়া একসাথে প্রবেশ করালে ফলাফল যে রকম মারাত্মক প্রাণঘাতী হবার কথা ছিল সেরকম তো হচ্ছেই না, উল্টে যেন ইউরিয়ার প্রভাব কমে যাচ্ছে। বোঝা গেল লিথিয়ামের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু গুণ আছে।গিনিপিগের মধ্যে শুধু লিথিয়াম কার্বোনেটের ইনজেকশন প্রয়োগ করে দেখা গেল তারা কেমন যেন শান্ত প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছে।এই সব ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ডাঃ কাড তাঁর দশ জন রোগীর ওপর লিথিয়াম কার্বোনেট প্রয়োগ করলেন। ম্যানিক রোগীদের ওপর লিথিয়াম প্রয়োগের ফলাফল হল নাটকীয়। কয়েকজন এতটাই সুস্থ হয়ে উঠলেন যে তাঁদেরকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া গেল।ডাঃ কাড তাঁর এই আবিষ্কারের কথা এক জার্নালে প্রকাশ করলেন।
কিন্তু অন্যদিকে লিথিয়াম নিয়ে সেই সময়টাতেই মানুষের মনে এক আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে। ডাঃ কাড যখন লিথিয়াম নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন, মোটামুটি সেই সময়েই (1949) হার্টের রোগীদের মধ্যে প্রচলিত” লো -সোডিয়াম ডায়েট” হিসাবে লিথিয়াম ক্লোরাইড লবণ ব্যবহৃত হতে শুরু হয়। ফল হল মারাত্মক খারাপ। লিথিয়ামের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় অনেক রোগী মারা অব্দি গেলেন।
তাই এই সব নানান কারণে ডাঃ কাডের আবিষ্কার সেভাবে প্রচারের আলো দেখল না।
শেষ পর্যন্ত ডেনমার্কের ডাঃ মজেন্স চাও রোগীদের ওপর লিথিয়ামের প্রভাব নিয়ে 1954 সালে এক ব্রিটিশ জার্নালে এক বিখ্যাত প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন। এবার লিথিয়াম নিয়ে নানান গবেষণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। 1960 সালের পর থেকে বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকেরা এর ব্যবহার শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত 1970 সালে আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিষ্ট্রেশন ম্যানিক রোগীদের মধ্যে লিথিয়ামের ব্যবহারের আনুষ্ঠানিক সম্মতি দেয়। ক্রমশ অন্যান্য মানসিক সমস্যাতেও লিথিয়াম কার্বোনেট ব্যবহৃত হতে লাগল।
সেই সময় থেকে আজ অব্দি “দামে কম,মানে ভালো” লিথিয়াম কার্বোনেট মানসিক রোগের চিকিৎসার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ভালো লাগলো।