রাত দশটায় নারী কন্ঠের ফোন, ‘হ্যালো, ডাক্তারবাবু, খুব বিপদে পড়ে আপনারে স্মরণ করছি?’
লোকনাথ বাবার বাজার খারাপ যাচ্ছে। বিপদে লোকজন ডাক্তারকে স্মরণ করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘বলুন।’
‘ডাক্তারবাবু, সকাল থেকে খুব লেবারের পেন হচ্ছে। কী করবো?’
বাস্তবিকই চমকালাম। বললাম, ‘লেবার পেন নিয়ে সকাল থেকে বাড়িতে বসে আছেন। আর এই মাঝ রাত্রে মনে পড়ল!’
‘ডাক্তারবাবু, আমি আপনারই পেশেন্ট। আজ যাবো ভেবেছিলুম। কিন্তু লকডাউনের মধ্যে ময়না থেকে মধ্যমগ্রামে যাওয়ার মতো কিচ্ছু পেলুম না। আপনারে সন্ধ্যা থেকে অনেকবার ফোন করেছি। ফোনে পাইনি।’
বললাম, ‘লেবার পেন নিয়ে আমার কাছে আসবেন কেন? আমি কী ওই সবের ডাক্তার? আমি মেডিসিন… ইয়ে মানে… সুগার, প্রেশার, জ্বর টর হলে আমাকে দেখাবেন।’
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি তো জানতুম আপনি লেবারের ডাক্তার।’
লেবার এ জীবনে কম করাই নি। মেডিকেল কলেজে গাইনিতে হাউসস্টাফশিপ করার সময়ে অন্তত হাজার খানেক ডেলিভারি করিয়েছি। গ্রামীণ হাসপাতালে কোনো লেবার কেস ঘাঁটলে সকলেই আমাকে ডাকত। কিন্তু সেতো অন্য জন্মের কথা।
ভদ্রমহিলা আবার বলছেন, ‘ডাক্তারবাবু, যাহোক কিছু একটা ওষুধ বলে দিন। আপাতত লেবারের পেনটা কমুক। কাল দুপুরে আপনারে গিয়ে দেখাবো।’
এইবার রাগ হচ্ছে। ইনি কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন? বললাম, ‘এক্ষুনি বারাসাত হাসপাতালের এমারজেন্সিতে যান। আমি লেবারের ডাক্তার নই। আর এমন কোনও ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি যে লেবারের পেন চেপে রেখে আপনি পরের দিন ডাক্তার দেখাবেন।’
‘কিন্তু ডাক্তারবাবু আগেরবার যখন লেবারের পেন হয়েছিল, আপনিই দেখেছিলেন। পাঁচদিনের ওষুধ দিয়েছিলেন। ব্যথা একেবারেই কমে গেছিল। এতদিন ভালোই ছিলাম। ওই ওষুধগুলোই কি আরেকবার খেয়ে নেব?’
রীতিমতো ধমকে উঠলাম, ‘আপনার ঠিক কী হচ্ছে পরিষ্কার বাংলায় বলুন।’
‘ইয়ে…পেটের উপর দিকটায় খুব ব্যথা হচ্ছে।’
তাহলে এতক্ষণ ধরে “লেবার পেন, লেবার পেন” করছিলেন কেন?
‘আমি জানতুম ওই জায়গাতেই লেবার থাকে।’
হতাশ হয়ে বললাম, ‘মা জননী গো, শব্দটা লেবার নয় লিভার। আর তুমি জানলেই বা কী করে ওটা লিভারেরই ব্যথা?’
এই লিভার নিয়ে বাঙালীরা অত্যন্ত চিন্তিত। এক মাঝবয়সী মহিলার মুখে মেচেতার দাগ হয়েছে। উনি একটা লিভার ফাংশন টেস্ট করে চলে এসেছেন। ‘ডাক্তারবাবু, দেখুন তো। মনে হচ্ছে লিভারের অবস্থা ভালো নয়। মুখে কেমন দাগ টাগ হচ্ছে।’
করোনার দাপটে সকলেই কিছুদিন লিভারের সমস্যা ভুলে ছিলেন। আবার দলে দলে লিভারের রোগী আসায় বুঝতে পারছি করোনা সত্যিই একটু কমেছে।
কম বয়সী ছেলেকে নিয়ে মা আসছেন। যথারীতি ঘ্যানঘ্যান শুরু করছেন, ‘আমার ছেলে কিছু খায় না। দেখুন না ওর কীরকম ব্রণ বেরোচ্ছে। ওর নির্ঘাৎ লিভার দুর্বল হয়ে গেছে।’
অল্প বয়সী মেয়ে স্মার্টলি বলছে, ‘ডাক্তার কাকু, আমার লিভারের সমস্যা।’
‘কী করে বুঝলি?’
‘মুখ দিয়ে বাজে গন্ধ বের হয়।’
আমি বললাম, ‘তোর কি ধারণা পেটের মধ্যে লিভার পচে সেই গন্ধ মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে? একবার হাঁ কর দেখি।’
মেয়েটির দাঁতের অবস্থা কহতব্য নয়। অর্ধেক দাঁতেই কালো গর্ত। দু-তিনটে দাঁতের শুধু মাড়িটাই অবশিষ্ট আছে।
করোনার আগে থেকেই আরেকটি রোগের মহামারী চলছে- ফ্যাটি লিভারের। দলে দলে রোগীরা আল্ট্রাসোনোগ্রাফি রিপোর্ট নিয়ে আসেন। সকলেরই ‘গ্রেড- ১ ফ্যাটি লিভার’। আজকাল ফ্যাটি লিভার ছাড়া একদম স্বাভাবিক পেটের ছবি প্রায় দেখাই যায় না। সেরকম ইদানীং কেউ ইকোকার্ডিওগ্রাম করলে স্বাভাবিক রিপোর্ট আসে না- গ্রেড- ১ ডায়াস্টোলিক ডিসফাংশান থাকে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই রিপোর্ট পেয়ে রোগীরা এক অদ্ভুত ভয় মেশানো আনন্দ পান। এবং মাসের পর মাস লিভ- ৫২, আর্সো-ডিঅক্সি-কোলিকএসিড, ইত্যাদি দামী দামী ওষুধ নিষ্ঠা ভরে খেয়ে যান। এতটা নিষ্ঠা ভরে আমি কোনো রোগীকে সুগার বা প্রেশারের ওষুধ খেতে দেখিনি।
আরেক ধরনের রোগী আসেন। এনারা প্রতি তিন- চারমাস অন্তর বিলিরুবিন পরীক্ষা করেন এবং প্রত্যেকবার বিলিরুবিন ২ মিগ্রা/ডেসিলিটার -এর বেশি থাকে। এদের গিলবার্ট সিন্ড্রোম বলে একটি জন্মগত রোগ আছে। যদিও একে রোগ বলা উচিৎ নয়, কারণ এতে কোনো শারীরিক সমস্যা হয় না। শুধু রক্তে আনকঞ্জুগেটেড বিলিরুবিন বেড়ে যায়। প্রায় ৫% বাঙালীর গিলবার্ট সিন্ড্রোম আছে।
এনারাও মাঝে মধ্যেই নানা রকম লিভারের ওষুধ ও টনিক খান। এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই এবং চিকিৎসার দরকারও নেই বুঝিয়ে বললে অনেকেই অত্যন্ত হতাশ হন এবং আমার কাছে সাধারণত আর আসেন না।
আজই একজন রোগী এসেছিলেন। বছর চল্লিশ বয়স। প্রেশার, সুগার, কোলেস্টেরল, হার্টের সমস্যা, থাইরয়েডের সমস্যা -সবই আছে। মোট ১১ রকমের ওষুধ খান। যাওয়ার আগে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, একটা লিভার গার্ড দিয়ে দেন না।’
‘কী দেব?’ আমি অবাক প্রশ্ন করি।
‘এই লিভারটাকে গার্ড দেবে, এমন একটা ওষুধ দিয়ে রাখেন। আমি আসলে রাত্রিবেলায় একটু হুইস্কি খাই। হুইস্কি খেলে শুনেছি লিভারের সমস্যা হয়।’