জনসাধারণের অবাধ যাতায়াতের ওপর একটা বিশাল মাপের নিষেধাজ্ঞা জারি যা লোকমুখে লকডাউন হিসেবে পরিচিত সেই ব্যবস্থা (মেজার) গ্রহণ করার কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কি না সেটা বিবেচনা করতে গেলে এই ব্যবস্থার ভালো মন্দ-দুটি দিকই খুঁটিয়ে দেখা দরকার।
প্রথমে এই ব্যবস্থার অপকারিতার দিকগুলোতে আসা যাক। এই ব্যবস্থার ফলে জনসাধারণের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হতে বাধ্য এটা বোঝার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র না হলেও চলে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিক দিয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল এই যে দেখা গেছে এই বিপর্যয় মোকাবিলা করার (কোপিং) ক্ষমতা জনসাধারণের যে যে অংশের মধ্যে কম তারা এমনিতেই জনস্বাস্থ্যের বিচারে ভালনারেবল অংশ, যেমন দারিদ্রসীমার নীচে/আশেপাশে ঘোরাফেরা করা মানুষজন, তারা আরোই ভালনারেবল হয়ে পড়ে। খাদ্যসামগ্রী, পুষ্টি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নাগাল (একসেস) পাওয়া ইত্যাদি আরো কঠিন হয়ে যায় তাদের জন্য। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কথা ছেড়েই দিলাম। অর্থাৎ কোভিডের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে টিবি রোগে বা ম্যালনিউট্রিশনে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে চলবে। দুর্ঘটনা সহ অন্যান্য মেডিক্যাল ইমার্জেন্সিতে সময়মতো রুগীকে পৌঁছাতে না পেরে বিপদ বাড়বে।
এবার উপকারিতার দিকগুলো। এই ব্যবস্থার ফলে সাময়িক ভাবে রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কমবে কারণ রোগ বিস্তারের রাস্তা অর্থাৎ সামাজিক মেলামেশা কৃত্রিমভাবে বন্ধ বলে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে ভাইরাসের চরিত্র ও গতিপ্রকৃতির ওপর এর কোনোই প্রভাব নেই, যেমন নেই জনগোষ্ঠীর অনাক্রমন্যতা (ইমুনিটি)-র ওপরে। ফলে ওই বিধিনিষেধ শিথিল হলেই আবার যে কে সেই।
তাহলে আদৌ এই ব্যবস্থা নেওয়া হয় কেন। উত্তরটা খুবই সহজ। দেশ/রাষ্ট্র/ সরকার- যাই বলুন না কেন, অপ্রস্তুত অবস্থায় এই মহামারীর মোকাবিলা করতে নামলে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল করুণ থেকে করুণতর হওয়া। হাসপাতালে বেডের অপ্রতুলতা, সাজ সরঞ্জামের অপ্রতুলতা, কর্মীবাহিনীর অপ্রতুলতা, ইত্যাদি।
ওই লকডাউন পিরিয়ডে কিছুটা সময় কেনা যায় যে সময়টা সুবিবেচনার সাথে পরিকাঠামোর উন্নতি, যন্ত্রপাতি ক্রয়, ওষুধ-ভ্যাকসিন-অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতার বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ নিয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মজবুত করে তোলার কিছুটা অবসর পাওয়া যায় অর্থাৎ অপ্রস্তুত থেকে প্রস্তুত হওয়া।
বাস্তবে ব্যবহারিক জীবনে এসব তাত্ত্বিক আলোচনার বিশেষ মূল্য নেই। কারণ সাধারণ মানুষরা নাগরিক হিসেবে তাদের রাজনীতিবিদ-শাসকদের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের সদিচ্ছা থাকলে তাঁরা ওই লকডাউন এর সময়টা সদ্ব্যবহার করবেন সার্য ক্যাপাসিটি বাড়াতে নতুবা তাঁরা মেলা-খেলা নির্বাচন নিয়ে মেতে থাকবেন আর প্রতিবার মহামারীর একটা করে ঢেউ আসলে অসম্ভব উদ্ভট সব ব্যবস্থা নিতে শুরু করবেন। ভিড় কমাতে ট্রেন সহ গণপরিবহন ব্যবস্থার যোগান না বাড়িয়ে ট্রেন বন্ধ করা তাঁরা হাত ধুয়ে ফেলবেন।
লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ মানে একটাই কথা – রাষ্ট্র তার সময়ের কাজ সময়ে করেনি। এই অতিমারীর প্ৰথম ঢেউয়ের সময়, এমনকি দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ও কিছুটা (এত অক্সিজেন লাগবে এটা স্বাস্থ্যবিজ্ঞান আন্দাজ করতে পারেনি) রাষ্ট্রকে তার অপ্রস্তুত অবস্থার জন্য ছাড় দিলেও এযাত্রা তৃতীয় ঢেউয়ের আগে সেই ছাড় দেওয়া যায় না।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইড বলে মাথা ঘামালে হবে না। টেলিমেডিসিন দিয়ে অপুষ্ট শিশুর পুষ্টি ফেরানো যায় না, টিকাকরণের হার বাড়ানো যায় না। “স্টে হোম স্টে সেফ” এর মতো অবাস্তব স্বার্থপর স্লোগান আর একটাও তৈরি হয় নি। স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িতে বসে থাকলে স্বাস্থ্য পরিষেবা চলবে কাদের দিয়ে? গণপরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করে স্বল্প সময়ের জন্য ডাক্তারদের আনা নেওয়ার বিশেষ বাসের ব্যবস্থা দেখে যাঁরা আপ্লুত হয়ে পড়েন তাঁরা আদৌ কি খোঁজ রাখেন যে সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মীরা (ফ্রন্ট লাইন ওয়ার্কার)– এএনএম, সিএইচও-রা তাঁদের কর্মস্থল ওই গ্রামীণ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে বা তাঁদের সদর দপ্তর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কি ভাবে যাতায়াত করেন ওই লকডাউনের ভয়ানক দিনগুলিতে ?
এই রাষ্ট্রীয় নির্মম উদাসীনতার ছবিটা এখানেই শেষ নয়। কন্টেইনমেন্ট জোনে আটকে পড়া জনতার ন্যূনতম চাহিদা পূরণের জন্য বাড়ি-বাড়ি রেশন, শিশুখাদ্য, দুধ, ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে প্রশাসন -এ দৃশ্য কল্পনা করাও মহাপাপ আমাদের দেশে। গণ পরিবহন বন্ধ থাকার সময় দুয়ারে কোভিভ টে্সটের ব্যবস্থা পৌঁছে যাচ্ছে এমন দৃশ্য কেউ কখনো দেখেছেন, শুনেছেন?
লক ডাউনের নাটকবাজি করাটা সহজ কাজ, বন্ধ করাটা সহজ কাজ, ঠেলে, গুঁতিয়ে মানুষকে ঘরবন্দি করাটা সহজ কাজ কারণ রাষ্ট্রের হাতে কেবল পুলিশ মিলিটারি আমলা প্রশাসন আছে তাই নয়, তার সাথে আছে পোষা বুদ্ধিজীবীর দল যারা “স্টে-হোম-স্টে-সেফ” বলে চিল্লিয়ে ওই লকডাউনের সম্মতি নির্মাণ করার চেষ্টা করে।
এসব তথাকথিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের চোখে কেবলই বড়দিনে পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় নামা “আমোদগেঁড়ে” জনগণ চোখে পড়ে, নিজেদের এসি গাড়িতে যাতায়াত করা এদের চোখে ধরা পড়ে না চন্ডিপুর ক্ষুদিরাম মোড় থেকে রিয়াপাড়া গ্রামীণ হাসপাতালে সময় মতো পৌঁছে টেস্ট শুরু করার জন্য ট্রেকারের পেছন দরজায় ঝুলে থাকা কোনও ল্যাব টেকনোলজিস্টের চেহারা, এদের চোখে ধরা পড়ে না মেছেদা লোকালের দমবন্ধ করা ভিড়ে বিপর্যস্ত সেই ইনফেকশন কন্ট্রোল নার্সের চেহারা যে একটু বাদেই হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তারদের শেখাবে ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং সহ আদর্শ কোভিভ আচরণ বিধি। ভিড় মানেই আমোদ নয়, জীবন জীবিকার টানেও ভিড় হয় সেটা এদের কে বোঝাবে? মানুষের সেবা করতে গিয়ে কোভিভ আক্রান্ত হয়ে পরার অপরাধে “একঘরে” হয়ে যাওয়া আশাকর্মীর ছোট বাচ্ছাটি দুধের যোগান পেল কি না সেটা দেখার সময় নেই এদের। রাষ্ট্রের যত জুলুমবাজিকে খামখেয়ালিপনাকে বিজ্ঞানের পোষাক পরিয়ে মান্যতা দেয়াই এসব বিশেষজ্ঞদের কাজ।
সমাজ ও সভ্যতার এই সংকটকালে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানকে রাজনীতির কারবারিদের কাছে বিকিয়ে দিয়ে নয়, ধারালো তরবারির মত ব্যবহার করেই এসব ছলনার জাল ছিন্ন করতে হবে, সঠিক জনমত তৈরি করতে হবে যাতে রাষ্ট্র ওই লকডাউন করার আগে একবার অন্ততঃ থমকে থেমে দাঁড়ায়। আমার মতো সামান্য জনস্বাস্থ্য কর্মীর কথা বাদ দিতে পারেন, পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতে পারেন কিন্তু দয়া করে মনে রাখবেন যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম ভারতীয় চিফ সায়েন্টিস্ট আমার সাথে আছেন লকডাউনের অসারতা সম্পর্কে তাঁর জোরালো বক্তব্য নিয়ে।
(পুরোনো লেখা, আবার দিলাম, যদি কারুর কোনো কাজে লাগে)