ধু ধু মাঠজোড়া কাঠফাটা রোদের ভেতর একটা গাছ দাঁড়িয়ে আছে, তার নীচে গিয়ে দাঁড়াতে পারছি না কিছুতেই…
_____________________________________
ঠিক তিনদিন দূরে থাকা নিট পিজি স্থগিত হয়ে গেল কাল। নিট পিজি, অর্থাৎ যে পরীক্ষা পেরিয়ে এমবিবিএস ডাক্তাররা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে আসেন। কারণ? কারণ, ডঃ হর্ষবর্ধন জানিয়েছেন করোনা আপাতত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, “তরুণ ডাক্তারদের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত”
সারাটা বছর প্যান্ডেমিকের ভেতর একদিকে মানসিকভাবে সুস্থ থাকার লড়াইয়ের পাশাপাশিই পিজির এই অমানুষিক প্রস্তুতি চালানো পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত তাদের ঠিক কোন মানসিক অবস্থায় ফেলে সে প্রসঙ্গ আপাতত এড়িয়েই যাচ্ছি নাহয়! আপাতত কিছু প্রশ্ন থাকছে ডঃ হর্ষবর্ধন এবং সংশ্লিষ্ট মাথাদের প্রতি। এমন নয় যে আমার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ বসে আছেন, বা থাকেন, কিন্তু রোদের ভেতর একলা গাছের দিকে একা একা অসহায় ঢিল ছুঁড়ে যাওয়ার চেয়ে মরীচিকাদের সাথে কথা বলাই কেমন ভালো দেখায়…
১. আগে নিট পিজি হ’ত ডিসেম্বরের শুরুতে, শেষ কয়েক বছর তা পিছিয়ে হচ্ছিল জানুয়ারির শুরুতে। এবছর যখন করোনার প্রথম ঢেউ নিশ্চিত শেষের দিকে নামছিল তখন সেপ্টেম্বর- অক্টোবরের সেই নিম্নগামী ট্রেন্ড ফলো করে কেন শেষ-জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, অন্তত মার্চে নিট পিজির ডেট ঘোষণা করা গেল না? প্রশ্ন জাগে, জনগণেশ যেমন নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন করোনাকে বেশ কয়েকখানা জ্যাকহ্যামার আর পেডিগ্রি দিয়ে কাবু করে ফেলা গেছে এবং দ্বিতীয় ঢেউটেউ এর আর কোনও গল্পই নেই, দিল্লিতে সমস্ত রিসোর্স, এপিডেমিওলজিস্ট আর সিদ্ধান্তের সুতো হাতে নিয়ে বসে থাকা হোমড়াচোমড়ারাও কি সেই একই দিবাস্বপ্নেই মশগুল ছিলেন?
২. গত পরশু, ১৪ই এপ্রিল, হরিদ্বারে মহাকুম্ভে শাহীস্নান করেন একসঙ্গে প্রায় সাড়ে নয়লক্ষ মানুষ! সপ্তাহ তিনেক আগেও যখন আমরা ঋষিকেশে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা কেউ ভাবতেও পারছেন না (আমরা সহ), তখনও হরিদ্বার এড়িয়ে গেলাম প্রধানত এই বিপুল জনসমাগমের কারণেই। সেকথা আপাতত থাক, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত আর সরকারি শিলমোহরের ভেতর বিস্তর হাইওয়ের দূরত্ব।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সরকার যেখানে একটিমাত্র হটস্পটে সাড়ে নয়লাখ জনসমাগমকে আটকান না কিন্তু তার মাত্র চারদিনের মাথায় খুব বেশি হলে দেড় বা পৌনে দু’লাখ ডাক্তারদের সারাদেশ জোড়া বিভিন্ন আলাদা আলাদা সেন্টারে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে চলা একটি পরীক্ষাকে বাতিল ঘোষণা করেন, তাহলে তার প্রায়োরিটি ঠিক কী এবং তার ডিকশনারিতে দূরদর্শিতা বলে আদৌ কোনও শব্দবন্ধ আছে কি?
৩. নাকি হাতে পর্যাপ্ত সময় পেয়েও, এই বিপুল পরীক্ষার্থীর প্রত্যেকের থেকে ফর্মের দাম হিসেবে পাঁচটি হাজার টাকা নেওয়ার পরেও ন্যাশনাল বোর্ড অফ এক্সামিনেশন ঠিক বুঝেই উঠতে পারেন না একদিনে সাড়ে তিনঘন্টার একটি পরীক্ষাকে ঠিক কীভাবে ‘সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন’ করা যায়? এনবিইর কি মনে হয় সাধুদের তুলনায় ডাক্তাররা মাস্ক পরা বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখায় কম সাবধানী হতেন? প্রশ্নটা তাহলে একবছরের বেশি সময় ধরে অমানুষিক পরিশ্রম ও মানসিক চাপ সামলানো এবং পিজি জয়েন করার জন্য মুখিয়ে থাকা ডাক্তারদের সদিচ্ছার নাকি এনবিই এর পরিকাঠামো, সদিচ্ছা এবং দূরদর্শিতার অভাব?
৪. বারবার দূরদর্শিতার কথা বলছি, কারণ ডাক্তার ছাড়া সাধারণ মানুষ হয়ত ঠিক জানেন না এই মুহূর্তে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ- হাসপাতাল গুলোর অবস্থাটা ঠিক কী বা সামনের সময়ে কী হতে চলেছে! সাধারণ মানুষের না জানাটা স্বাভাবিক, সরকার- এনবিই এবং ডাঃ হর্ষবর্ধনের সেটা না জানাটা অপরাধ।
করোনার প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কায় বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ফাইনাল এমবি পিছিয়ে গেছে, ফলে আপাতত ইন্টার্ন ডাক্তাররা নেই। গোটা চাপটা গিয়ে পড়ছে প্রথম- দ্বিতীয় বর্ষের পিজিটিদের ওপর, যারা ইতিমধ্যেই নিজের বিষয়ের চাপ এবং করোনার চাপ সামলে বার্নড আউট। তৃতীয় বর্ষের পিজিটিরা এই মুহূর্তে খুব স্বাভাবিক সমীকরণেই আসন্ন পরীক্ষার পড়াশুনোয় ব্যস্ত, সামনের এক মাসের মাথায় তারা পুরোপুরি বেরিয়ে যাবে ওয়ার্কফোর্স থেকে। এর মধ্যে যদি নিট পিজি অনির্দিষ্টকালের জন্য পেছোয় তাহলে পরীক্ষা হয়ে কাউন্সেলিং হয়ে শেষ পর্যন্ত ঠিক কবে নতুন পিজিটিরা যোগ দেবেন ওয়ার্কফোর্সে? তাদের ছাড়া এই ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভেতর দিনরাত এক করেও, নিজেদের সমস্তটুকু দিয়েও ঠিক কীভাবে কাজ সামলাবেন পিজিটিরা? যারা ইতিমধ্যে বার্নড আউটই শুধু নন, পজিটিভও আসছেন হুহু করে?
জানিনা এই সিদ্ধান্তে নিট পিজি পরীক্ষার্থীদের ইন জেনারেল বক্তব্য কী, কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে অথবা তাদের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে বলতে পারি আমি নিজে পরীক্ষার্থী, ডাক্তার বা এদেশের জনসাধারণের একজন হিসেবে কিছুতেই এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে পারতাম না।
_________________________________
গতকাল একদিনে কোভিড পজিটিভ এসেছেন ঠিক দু’লক্ষ সতেরো হাজারের কিছু বেশি মানুষ, মারা গেছেন বারোশোর সামান্য কম, দিল্লি থেকে লক্ষ্ণৌ- ইলেকট্রিক চুল্লি চব্বিশ ঘন্টা টানা চালানোর পরেও শ্মশানের বাইরে মৃতদেহবাহী গাড়ির লম্বা লাইন। চোখের সামনে রোজ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পজিটিভ রোগীর সংখ্যা, চেনা- আধচেনা- কলিগ- বন্ধুরা পজিটিভ আসছে, হু হু কমে আসছে বেড।
আবার স্মৃতি জুড়ে ফিরে আসছে একবছর আগের দুমড়ে যাওয়া, ফাঁকা, ক্লান্ত দিনগুলোর শব্দ। চারিদিকের চিৎকার- মিছিল- ধূলিধূসর দিনগুলো থেকে সরে এসে যে পাতার সামনে লেখা ছিল “এ পৃথিবীর রণ-রক্ত-সফলতা সত্য/ তবু শেষ সত্য নয়”, এতদিন তার সামনে নিঃশব্দে এসে বসেছিলাম। আজ আবার উপচে পড়া ওয়ার্ডের করিডোর বেয়ে, স্ট্রেচারে পড়ে থাকা রোগীর শরীরের পাশ দিয়ে বয়ে আসছে বিষণ্ণ তবু তীব্র কোনও রোদ।
দিগন্তজোড়া এক ধূসর মাঠের ভেতর ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় তালেবের বই থেকে উঠে আসা কালো রাজহাঁসেরা। তাদের পাশ থেকে আমি, আমরা অনিশ্চয়তা আর উত্তরহীনতার ঢিল ছুঁড়ে যাই মরীচিকার দিকে। এদেশের দিগন্তে যেটুকু সুচিন্তিত অরণ্যের প্রয়োজন ছিল হয়ত কবরের মাটি আর সার থেকে প্রকৃতিই গড়ে নেবে তাকে।
দেখা যাক নিজস্ব গাছের তলায় শান্তিতে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য আরও কতকাল অপেক্ষা করতে হয় আমাদের…