ছোট হল, কিন্তু এয়ার-কন্ডিশনড। এলাকার ডাক্তারদের জমায়েত। বেশিরভাগই তরুণ। অনিমেষ ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এসেছে ওর মেয়ে আর জামাই। ওরাও আজকের প্রজন্মের ব্যাস্ত ডাক্তার। কি এক জরুরী আলোচনা। বক্তা ডাঃ জে.বি.ত্রিপাঠি,–জীবন বন্ধু ত্রিপাঠি।
“হ্যাঁরে,উনি কি ডাক্তার? কোন কলেজ!”——অনিমেষের কৌতূহল থামিয়ে মেয়ে ফিসফিস করল,”চুপ করে শোনো।”
ঝকঝকে জে.বি.বলতে উঠলেন,”প্রথমেই বলে রাখি আমি ডাক্তার নই, মার্কেটিং-এ পি.এইচ.ডি.। ল’ নিয়ে কিছু পড়াশোনা আর এখন এই “মেড-অ্যাস এর এম.ডি.”–বাচনভঙ্গিটি ভারি সুন্দর,” ‘মেড-অ্যাস’ মানে মেডিক্যাল ফেটার্নিটি মানে আপনাদের অ্যাসুরেন্স দিই।”
অনিমেষ অবাক চোখে তাকিয়ে, তরুণ চিকিৎসকদল আগ্রহী-চিত্তে শুনছে।
“আপনারা আপনাদের প্রফেশনে ভীষণ ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি তো ঘটতেই পারে। আমরা আছি তার মেরামতের জন্যে।”
“ছোকরা বলে কি! ডাক্তারের ত্রুটি মেরামত করবে মার্কেটিং-এর ডাক্তার।”
“ক্রেতা-সুরক্ষা আদালত বসে রয়েছে”—ছোকরা বলে চলেছে,”প্রতিক্ষণে আপনাদের সাঁড়াশি আক্রমণ করে চলেছে। আমরা বলতে চাই আমরা আছি, আপনারা আপনাদের কাজ করুন, আমরা আমাদের কাজ করে যাব।”
অনিমেষও মন দিয়ে শুনছে,”শুধু প্রতি তিন মাসে আমরা একটা ওয়ার্ক-শপ করব। আমাদের এক্সপার্ট আনব, আপনারা অবশ্যই সেখানে থাকবেন।”
“আপনাদের এক্সপার্টরা কি মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসররা?”—কৌতূহলী বেয়াড়া অনিমেষ।
“আরে না না, আপনাদের মেডিক্যাল কলেজের স্যাররা রুগী বাঁচাতে শেখায় আর আমাদের এক্সপার্টরা আপনাদের বাঁচাতে শেখাবে।”
অনিমেষের বিষ্ময়ের শেষ নেই। “আরে মশাই, আপনি বাঁচলে রুগীর নাম। আপনার নামে যখন পঞ্চাশ লাখের কেস ঝুলবে তখন কোন স্যার আপনাকে বাঁচাবে?”
“অনিমেষদা, আপনি একটু চেপে যান,আমাদের শুনতে দিন। বলুন স্যার, প্রিমিয়ামের কথাটা একটু বলুন।”
“দেখুন, মার্কেটে যারা আছে তাদের মধ্যে আমাদের প্রিমিয়াম অবশ্যই বেশী, কিন্তু সার্ভিসটার কোনো তুলনা নেই। আপনি আপনার প্রফেশনে ব্যস্ত থাকুন, শুধু আমাদের কথা শুনে চলুন। ব্যাস,আর কিছুটি ভাবতে হবে না”
“আপনাদের কথা শুনে মানে?”–বেয়াড়া অনিমেষ আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।
“যেমন যে কোনো অপারেশন বা ইনডোর পেসেন্টের সি.টি., এম.আর.আই., ইকো ইত্যাদি, আমরা সব লিস্ট দিয়ে দোব,অবশ্যই করাবেন।”
“দরকার না হলেও”–অনিমেষের সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
“হ্যাঁ, দরকার না হলেও”–এবার একটু বিরক্ত স্বর, “আরে মশাই, রুগীর দরকার না হলেও আপনার দরকার, আপনাকে বাঁচাতে। আর একটা কথা–“–এবার সবায়ের উদ্দেশ্যে পাশে বসা এক সুবেশা তরুণীকে দেখিয়ে, “ম্যাডাম এষা বণিক! ইনি ডিজিজ এণ্ড ডায়াগনোসিস সংক্ষেপে ডি.ডি.র এম.ডি। সারা দেশে এঁদের ইনভেস্টিগেশনের চেন আছে। প্রত্যন্ত প্রান্তেও এঁরা ছড়িয়ে পড়বেন। আমাদের সাথে এঁদের টাই-আপ আছে।আপনারা এঁদের কাছে সব ইনভেস্টিগেশন করান, আপনার সমস্ত রুগীর সমস্ত ডকুমেন্টের সফ্ট কপি এঁরা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে, আপনার ফাইলে তা সযত্নে রাখা থাকবে।”
“আমাদের কিছু রাখতে হবে না!”—উৎফুল্ল সবার প্রশ্ন।
“কিছছু নয়। একবার একটা প্রিমিয়াম দিয়েই আপনি মুক্ত। প্রিমিয়াম একটু বেশি হলেও সার্ভিসটা একবার ভাবুন।”
“আচ্ছা, কোনো কেস না হলে টাকাটা ফেরত পাওয়া যাবে?”—বেয়াড়া অনিমেষ।
“না স্যার,”–এবার একটু হাসলেন ত্রিপাঠি, “ছোটবেলায় আমরা বলতাম এল.আই.সি.তে না মরলে লাভ নেই আর এখানে না মারলে লাভ নেই। মারুন, যত খুশি মারুন ,আমরা তো আছি।”
অনিমেষের শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। আস্তে আস্তে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
“বাবা, আর একটা ফিসফ্রাই নাও, ভালো করেছে।”–অরিন্দম বাবাকে বলল। ও জানে বাবা অনিমেষের ফিসফ্রাই আর ফিসফিঙ্গারের প্রতি দূর্বলতা। আজ সুখসৃষ্টি আবাসনের অ্যানুয়াল জি.বি. মিটিং। অনিমেষের ছেলে অরিন্দম সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, এই আবাসনের বাসিন্দা। আজ বাবাকেও থাকতে বলেছিল। আজ লাঞ্চের পরেই একটা’হেলথ অ্যাওয়ারনেস’ প্রোগ্রাম আছে, অনিমেষ ডাক্তারের সেই লোভেই আসা।
“হ্যাঁরে, তোদের সেই স্বাস্থ্য-সচেতনতা কখন?”
“এই তো, লাঞ্চের পরেই।”
“অরিন্দমদা,ওদিকে মাট্ন বিরিয়ানীটা নাও। জাস্ট অ্যসাম।”
খাওয়া শেষ। এদের অডিটোরিয়ামটাও খুব সুন্দর। পোডিয়ামে সেক্রেটারি মিস্টার মিত্র স্বাগত ভাষণের পর বললেন,”আজ একটি স্বাস্থ্য-বিষয়ক আলোচনা আমরা রেখেছি। আমরা কৃতজ্ঞ ঐ সংস্থা আমাদের এই সুন্দর মধ্যাহ্নভোজের দায়িত্ব নেওয়ায়। আমি এর কর্ণধার ডঃ ত্রিপাঠিকে ডেকে নিচ্ছি কিছু বলার জন্য।”
অবাক চোখে অনিমেষ দেখছে অত্যন্ত সুন্দর নায়কোচিত ভঙ্গিমায় পোডিয়ামে এসে দাঁড়ালেন ডা:জীবনবন্ধু ত্রিপাঠি।
“ওয়েলকাম মাই ফ্রেন্ডস, এতো সুন্দর একটি আবাসনের প্রতিটি আবাসিকের সুস্বাস্থ্য কামনা করি। মনে রাখবেন, স্বাস্থ্যই সম্পদ। আর আমাদের সংস্থা ‘মেড-অ্যাস’ আপনাদের সেই সম্পদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে। ‘মেড-অ্যাস’ অর্থাৎ আপনাদের মেডিক্যাল অ্যাসেট। এই রকম একটা আবাসনে সকলেই সুস্থ থাকুন এটাই আমরা চাই, কিন্তু অসুস্থ হলে কী করবেন?”
“কেন? চিকিৎসকের কাছে যাব।”
“আর সেই চিকিৎসক ভুল করলে কি করবেন? আর এখানেই আমাদের কাজ শুরু।”
অনিমেষ মন দিয়ে শুনছে।
“আমাদের সংস্থার এক্সপার্টরা বসে রয়েছে সেই চিকিৎসার ত্রুটি ধরে আপনার স্বাস্থ্যকে সম্পদ করে তুলতে।”
“একটু বুঝিয়ে বলুন”–সেক্রেটারি মি. মিত্র কৌতূহলী।
“আপনাদের কাজ শুধু একটা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে নামটা আমাদের কাছে এনরোল করানো”
“তারপর?”
“মজাটা তো তারপরেই। আপনি যে ডাক্তারই দেখান আর যে চিকিৎসাই করান ভুল আমরা বার করেই দেবো।”
“কিন্তু–” একটু সন্দেহ কারো মনে।
“আমরা প্রত্যেককে একটা ইউনিক আই.ডি. নম্বর দেবো। আপনার কাজ শুধু চিকিৎসার যাবতীয় কাগজপত্র আমাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে আপলোড করে দেওয়া, বাকিটা আমরা সামলাবো।”
সবাই খুব উৎফুল্ল। ত্রিপাঠি বলে চলেছে,”আপনি যদি পাঁচ হাজার খরচ করেন আপনাকে আমরা পঞ্চাশ হাজার এনে দেব। শুধু প্রসেসিং ফি বাবদ দশ পার্সেন্ট বাদ দিয়ে পুরোটাই আপনার। এজন্যই বলি ওয়েলথ ইস হেল্থ, স্যরি,হেল্থ ইস ওয়েলথ।”
তুমুল করতালি-ধ্বনির মধ্যে সভা শেষ।
অরিন্দম দেখল, বাবা আপন-মনে বিড়বিড় করছে, “মেড-অ্যাস তাহলে আসলে কি? ছোটবেলায় অ্যাস মানে একটা জানত ওরা কি সেটাই বানাচ্ছে আমাদের?”
“অরিন্দম-“–মুখোমুখি বাবা,”অ্যাস মানে কী?”
“কেন! গা–”
হো হো করে হেসে উঠেছে অনিমেষ ডাক্তার,”ঠিক।ঠিক।।”
**পুরনো লেখা। প্রাসঙ্গিকতা অটুট।
ভালো লেখা।