আলোচনার শুরুতেই বেশ খটমট দুটো শব্দ, “মন” যা এখনও আমাদের কাছে অনেকটা অধরা এবং তার “ইন্দ্রজাল” বা মায়াবী রূপ! সাহিত্যের ভাষায় একে মেটাফোর বা সিমিলি, দুই ই বলা যায়। মন কি, কেমন, কখন, কিভাবে এইসব বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বহু যুগ ধরে নানা তত্ব উঠে এসেছে। দর্শন, মনোবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান সব শাখাতেই মন খোঁজার কাজ চলেছে, আজও চলছে, তবু তা অসমাপ্ত। শুরুর সময়ের শরীরের চেয়ে “পৃথক সত্তা মন” থেকে গেস্টালটের “সামগ্ৰিক মন” হয়ে জীববিজ্ঞানের বংশগতি ও পারিপার্শ্বিক উপাদানের ছাঁচে তৈরি হওয়া “আজকের মন” এ এসে পৌঁছেছি আমরা। বলা বাহুল্য যে এই এক লাইনে জুড়ে দেওয়া যাত্রা পথ এক সুদীর্ঘ ইতিহাস।
মনের জৈবিক গবেষণা মূলতঃ শুরু হয় মনোরোগের হাত ধরে। মনোরোগ বলতে আমরা স্বাভাবিক ভাবে ব্যতিক্রমী ব্যবহার বুঝে থাকি। ব্যবহারের স্বাভাবিক চলন দেশ কাল ভেদে বিভিন্ন, তাই কোনটা স্বাভাবিক আর কোনটা ব্যতিক্রমী তা অনেকটাই পরিস্থিতি নির্ভর। এর নির্দিষ্ট মাপকাঠি আছে, ঠিক যেমন ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, আর্থ্রাইটিস বা অন্যান্য শারীরিক অসুখের থাকে, তেমনই। শরীর মনের সখ্যতাও অনেক, শরীর যেমন মনকে প্রভাবিত করে, মনও তার রঙ ছড়ায় শরীরে। কিন্তু জটিলতা হলো মনের চলনে। কখন কিভাবে এই মন ছুটে বেড়ায় তার বিস্তৃত বিবরণ আমার কাছে যেন কোন জাদুকরের নিখুঁত জাদু বিদ্যার জৈবিক রূপ।
মস্তিস্কের বিভিন্ন স্তরে মনের অস্তিত্ব। ফ্রয়েডের অবচেতন মনের উৎস যদি হয় মস্তিষ্কর ভিতরের ছোট্ট এক অ্যামিগডালাতে, তো চেতন মন ছড়িয়ে আছে উপরিভাগের ফ্রন্টাল কর্টেক্সের নানান জায়গায়। কেউ ভাবায়, কেউ অঙ্ক করায়, কেউ নাম মনে রাখায়, আবার কেউ রাতের অন্ধকারে ঘুম চোখে কতো পা ফেললে সুইচ বোর্ডের কাছে পৌঁছে যাবো তার হিসেব দেয়। তাহলে কি শুধু অবস্থানের হদিস পেলেই মনকে বোঝা যাবে? এক একটা অংশকে আলাদা করে চিনে নিতে পারলেই মনের মানচিত্র হাতের মধ্যে এসে যাবে! এতো সহজ? তা হলে তো একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম ভয়ঙ্কর সমস্যার মধ্যে মানসিক রোগ থাকতোই না!
মস্তিস্কের প্রতিটি অংশ একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রাখে বিভিন্ন নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে। কোন নেটওয়ার্ক কতোটা পোক্ত তার ওপর নির্ভর করে মনের প্রকাশ। আর এই নেটওয়ার্ক তৈরির প্রধান কুলি মজুর হল জেনেটিক লোডিং এবং পরিবেশ। যেমন ধরা যাক্, লার্নিং এবং মেমোরি-র সাথে জড়িয়ে রয়েছে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ এবং নেটওয়ার্ক। নতুন কিছু শিখলে তার যেমন একটা লজিকাল ইনপুট তৈরি হয়, তেমনই তৈরি হয় একটা আবেগ। অর্থাৎ একই সাথে কনসাস বা লজিকাল মাইন্ড এবং আবেগ তাড়িত লিম্বিক সার্কিট দুই উত্তেজিত হয়। কিন্তু অনুশীলন কতো সহজ হবে বা তার থেকে কতোটা ভালো লাগা তৈরি হবে তা নির্ভর করে ওই অংশগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগের ওপর। আর কতো তাড়াতাড়ি সেখানকার স্নায়ুকোষগুলো হাত ধরাধরি করে নেটওয়ার্ক তৈরি করবে তা পরিচালিত হয় কোষের আভ্যন্তরীণ অবস্থার দ্বারা। প্রচুর মিল থাকলেও কিছু সূক্ষ্ম অমিল একই পরিবেশে দুটো মানুষকে দুভাবে ভাবায়। আর তাই আমরা সকলে আলাদা, আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ব্রেন ম্যাপ রয়েছে।
আজকের যুগ বিজ্ঞানের। প্রতিদিন বহুসংখ্যক গবেষক মনকে আরও ভালো করে চিনতে দিন রাত এক করে কাজ করছেন। এফ এম আর আই, পেট, স্পেকট, কিউ ইইজি প্রভৃতি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে মনকে চেনা অনেক সহজ হয়েছে। ভালো গান শুনলে বা ছবি দেখলে যে ব্রেন ওয়েভ তৈরি হয় পরক্ষণেই তা মিলিয়ে নতুন রকম কিছু তৈরি হয়, সেও অল্পের অতিথি। অর্থাৎ প্রতিটি সেকেন্ডে, বা বলা ভালো প্রতিটি মিলি সেকেন্ডে বদলে যাচ্ছে মনের রঙ। এক কথার অভিব্যক্তিকে ধরতে ধরতেই পরের পালা শুরু। কি জটিল, কি গভীর, অথচ কি ভীষণ শাশ্বত! হাজার হাজার নেটওয়ার্ক জোড়া লাগছে, ভাঙছে, আবার জুড়ছে! আর সেই ভাঙা গড়ার খেলার মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা। দিগন্তের সামনে নিজেকে যেমন ক্ষুদ্র মনে হয়, তেমনি মস্তিস্কের এই বিশাল কর্মকাণ্ডের এক নগণ্য পুতুল লাগে নিজের বহিঃপ্রকাশ।
আমরা রোজ নিজের থেকে যে ইনফরমেশন নি, পরিবেশ থেকে যা গ্ৰহণ করি তার এক সামান্য অংশ আমাদের ব্যবহারে ফুটে ওঠে। বেশিরভাগটাই থেকে যায় মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্তরে, অপ্রকাশিত অবস্থায়। সেই সব চুপকথারা মাঝে মাঝে জেগে উঠে আত্নপ্রকাশ করে, কখনও স্বপ্নে, কখনও রাগে, কখনও গভীর কোন শোকে, আবার কখনও বা হঠাৎ গরমকালের দমবন্ধ করা সন্ধ্যের কালবৈশাখী হয়ে। পরিবেশের জল হাওয়া শরীরের কাঁচা মাল নিয়ে স্তরে স্তরে সেজে ওঠা এই যে মন, তা কি মায়াজাল নয়?
বিঞ্জানের তুলিতে প্রকৃৃতির ইন্দ্রজাল!
Informative and interesting indeed !!
ভালো লাগলো লেখাটা। সংক্ষেপে অনেক তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।
খুব সুন্দর লিখেছো। সত্যি মন বড়ই জটিল।
খুব সুন্দর লেখাটা। অনেক কিছু জানতে পারলাম।
interesting
ভীষণ সুন্দর,,,,❤️❤️❤️