(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। শেষ রাতের দিকে ঘুম এসে গিয়েছিল। দাঁত মেজে হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকে চললাম। বড় রাস্তাটা একটা ছোট লোহার ব্রীজের উপর দিয়ে রাম্ভী ঝোরা পার হয়েছে। এই ব্রীজটা নতুন। পুরনো লোহার ব্রীজের কঙ্কালটা পরিত্যক্ত হয়ে পাশে পড়ে আছে।
সকালে দৃশ্যপট খুব দ্রুত বদলে যায়। দূরে শিরীষ গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে। একফালি সকালের রোদ এসে পড়েছে শেওলায় ঢাকা পুরোনো ব্রীজটা আর তার পাশে আমলকী গাছটার উপরে। ক্যাঁ-ক্যাঁ করতে করতে একটা ফ্লাইক্যাচার এ-ডাল থেকে উড়ে ও-ডালে গিয়ে বসল। আমার মত অবাঞ্ছিত আগন্তুককে দেখে উষ্মা প্রকাশ করল বোধহয়।
ঘরে ফিরে মুখ ধুয়ে চা খেলাম ক্যান্টিনে গিয়ে। ক্যান্টিনের গীতা দিদি জিজ্ঞাসা করল জলখাবার খাবো কি না। টোষ্ট আর ওমলেট পাঠিয়ে দিতে বললাম ঘরে। জলখাবার খেয়ে ঝোরার জলে স্নান সেরে আউটডোরে বসলাম। রুগী আসছে একজন-দুজন করে । দুমাস আগেই মেডিক্যাল কলেজের আউটডোরে শ’য়ে শ’য়ে রুগী সামলে এসেছি। অদ্ভুত ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিন্তু হতাশ হতে দিল না মনীষা আর প্রতিভা সিষ্টার। ফাঁকা আউটডোরে পাঠশালার দিদিমণির মত আমাকে নেপালি ভাষা শেখাতে শুরু করল।
মনীষা হল দীপক ভুজেলের নতুন বিয়ে করা বউ। দুজনেই রাম্ভীবাজার হাসপাতালে কাজ করে। প্রতিভা তামাং-এর স্বামী কালিম্পং হাসপাতালের আপার ডিভিসন ক্লার্ক।
‘টাউকো দুখ ছ’?’
‘দুখ দেই না।’
‘দাওয়া দিনুস।’
দাওয়া অর্থাৎ ওষুধ পাহাড়ের হাসপাতাল গুলোতে পর্যাপ্ত সাপ্লাই ছিল। অন্ততঃ সমতলের থেকে বেশী। যক্ষ্মার প্রাথমিক ওষুধগুলো প্রত্যেকটা পাওয়া যেত। পাওয়া যেত অ্যান্টিবায়োটিক, পেটের রোগের ওষুধ, ব্যাথার ওষুধ। রুগী অর্থ্যাৎ চাহিদা কম। যোগান বেশী।
‘আপনি তো অর্থোপেডিক সার্জেন, তাই না?’ প্রতিভা সিষ্টার বলে।
‘হ্যাঁ। কেন?’
‘আর যদি পনেরো দিন আগে আসতেন!’
‘তাহলে কি হতো?’
‘কয়েকটা লোক হয়ত বেঁচে যেত।’
‘কিভাবে?’
বিএমওএইচ আর প্রতিভা সিষ্টার দুজনে যা বললো তা হল এই-
রাম্ভী থেকে আর একটা রাস্তা সোজা উপরে উঠে মংপু হয়ে দার্জিলিং চলে গেছে। ওই রাস্তায় আছে ভালুকখোপ। খুব বিপজ্জনক জায়গা। রাস্তা খুব ভাঙা ও সরু। পাশে গার্ডওয়াল নেই। মাঝে মাঝেই দুর্ঘটনা হয়। দিন পনেরো আগে একটা ছোটো বাস ওখান থেকে ব্রেক লক হয়ে নীচে রাম্ভীর কাছে রিয়াং-এ এসে পড়ে। বাসের বডি কেটে যাত্রীদের উদ্ধার করতে হয়। তিনজন ঘটনা স্থলে, বাকি ন’জন কালিম্পংয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যায়।
‘ঈশ্। কিন্তু এখানে তো ট্রমা বা অর্থোপেডিক ট্রিটমেন্টের কোনো ব্যবস্থাই নেই।’
‘এবার তাহলে দার্জিলিং থেকে অন্ততঃ কিছু প্লাষ্টার পাঠাতে বলব।’ বিএমওএইচ বলে।
‘পাঠাতে বলো।’
‘আরেকবার রাম্ভীর কাছে রোপ ওয়ে ছিঁড়ে পড়ে তিনজন লেবার মারা যায়।’
‘রোপওয়ে?’
‘হ্যাঁ, ব্রিটিশ আমলে তোমার সামতাহার থেকে একটা রোপওয়ে ছিল দার্জিলিং অবধি। অবশ্য সেটা কয়লা পরিবহনের জন্য।’
‘কয়লা?’
‘হ্যাঁ, ছোট ছোট কয়লাখনি ছিল দার্জিলিং জেলায়।’
‘তারপর?’
‘কয়লাখনি তো অনেকদিন বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কখনো কখনো ওই রোপওয়ে-তে মানুষ যাতায়াত করে। অবশ্য কোনো কেবলকার নেই ওতে। খোলা ট্রলি চলাচল করে।’
বর্ষায় পেটের রোগ বেড়ে যায়। আউটডোরে রুগী ছিল সর্বসাকুল্যে পঁয়ত্রিশ জন। মেট্রোনিডাজোল, এন্টারোকুইনল আর ওআরএস লিখে চলেছি। অর্থোপেডিক্সের ট্রেনিং-এ মরচে ধরে যাচ্ছে। আবার কবে অপারেশন করার সুযোগ পাবো কে জানে! এখানে তো হবে না। অপারেশন থিয়েটার বা অ্যানাস্থেসিয়ার ব্যবস্থা এখানে নেই। বিপিএইচসি-তে সেটা সম্ভবও নয়।
সেদিন রাতে যা হল তা অবশ্য চরম। আমার নাইট ডিউটি ছিল। ওয়ার্ড প্রায় ফাঁকা। একবার রাউন্ড দিয়ে হোটেলে খেয়ে ঘরে এসে তারাপদ রায় নিয়ে বসেছি। টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি পড়ছে। পড়তে পড়তে রাত প্রায় বারোটা। দরজায় ঠক্ ঠক্ আওয়াজ। দরজা খুলে দেখি অরুণ।
‘প্রতিভা দিদি পাঠালো। পেশেন্ট আছে।’
‘কি পেশেন্ট?’
‘লেবার।’
‘চল।’
বারান্দা থেকে নেমে বৃষ্টিভেজা অন্ধকার পথে অরুণের টর্চের আলোয় চললাম।
রোগীনি লেবার রুমে টেবিলে শুয়ে। যন্ত্রনায় ছটফট করছে। প্রতিভা সিষ্টার অ্যাপ্রন পরে তৈরী। দেখলাম ক্রাউনিং হয়ে গেছে।
‘এপিসিওটমি দিতে হবে। আপনি দিতে পারবেন?’
‘আমি? হ্যাঁ পারব।’
ইন্টার্নশিপের সামান্য জ্ঞান ও সার্জারি করার আত্মবিশ্বাস একত্র করে হ্যাঁ বললাম। এছাড়া মাঝরাতে ওই পাহাড়-জঙ্গলের মাঝে এক ছোট্ট হাসপাতালে আর কোনো উপায় ছিল না। নিকটবর্তী বড় হাসপাতাল কালিম্পং। সেই বর্ষণমুখর মাঝরাতে পিচ্ছিল পাহাড়ী পথে রুগীকে নিয়ে ভোরের আগে সেখানে পৌঁছনো কার্যতঃ অসম্ভব।
‘সিষ্টার, এপিসিওটমি সেট রেডি করুন। লোকাল দিন।’
‘আমি আছি, চিন্তা নেই।’
হাত ধুয়ে গ্লাভস পরে প্রতিভা সিষ্টারের সাহায্যে লোকাল অ্যানাস্থেসিয়ায় এপিসিওটমি দিয়ে ডেলিভারিটা করেই ফেললাম। প্রবল কান্নায় মাঝরাতে পাহাড়-জঙ্গলের নৈঃশব্দ্য খানখান করে নতুন অতিথির আগমন ঘটল পৃথিবীতে।
সকাল হল। আউটডোরের পরে শিলিগুড়ি যেতে হবে। ইনডোরে তিনজন রুগী। চার্জ হ্যান্ডওভার করে স্নান করতে গেলাম। জল নেই। ঝোরার বালি পাইপে আটকে বন্ধ হয়ে গেছে। সে অন্ততঃ তিনশ ফুট পাহাড়ের উপরে। আজ সকালে আর ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু হালকা হাওয়ায় সেগুন গাছের বড়বড় পাতাগুলো থেকে টুপটাপ করে জল পড়ছে। কোয়ার্টারের সামনে পেয়ারা আর ডালিম গাছ দুটোয় ফুল এসেছে।
আউটডোর শেষ করে খেয়ে ফিরছি হনহন করে। ব্যাগ গুছিয়ে বেরোতে হবে। এসএনটি-র বাসটা মিস করলে আবার দুঘন্টা বাদে বাস।
নীল জামা পরা একটা লোক হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে হাসপাতালের গেট থেকে বেরিয়ে ব্রীজের দিকে হাঁটছে। এ তো কিছুক্ষণ আগে আউটডোরে দেখিয়ে এল! চা বাগানের শ্রমিক। বুকে যক্ষ্মা হয়েছে। কাশির সাথে রক্ত ওঠে। ওষুধ দিলাম। চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে যক্ষ্মার প্রবণতা খুব বেশী।
হঠাৎ দেখি লোকটা একটু এগিয়ে গিয়ে এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে ব্রীজের ধারে ঝুঁকে পড়ে কি একটা নীচে ছুঁড়ে দিল। বাসের কথা ভুলে লোকটার দিকে ছুটে গেলাম। লোকটা আমাকে দেখে ভূত দেখার মত ছুটে পালালো। প্যাকেটটা ঝোরার জলে পড়ে নি। পাথরের খাঁজে আটকে ছিল। নীচে থেকে একটা ছেলে সেটা কুড়িয়ে এনে আমার হাতে দিল। কাগজের প্যাকেটটা খুলতে বেরোলো চার রকমের যক্ষ্মার ওষুধ ও ভিটামিন! যক্ষ্মার রোগী বিনে পয়সায় পাওয়া ওষুধও ফেলে দিয়ে গেল! শিক্ষা, শিক্ষা না থাকলে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব নয়।
এইসব করতে গিয়ে এসএনটির বাসটা বেরিয়ে গেল। ভাগ্যিস অরুণের দাদা সেভক যাচ্ছিল। ওর মারুতি ভ্যানে চড়ে সেভক অবধি পৌঁছে গেলাম। করোনেশন ব্রীজের মুখ থেকে শিলিগুড়ির বাস ধরলাম। কালীবাড়ি পেরিয়ে সমতলে নেমে এল বাস। কালো পিচ ঢাকা রাস্তা চলে গেছে মহানন্দা ফরেষ্টের বুক চিরে শিলিগুড়ির দিকে। বাস ছুটে চলল।
(ক্রমশঃ)