গতকাল (২৯.১০.২০২৪) মালদা মেডিক্যাল কলেজে আরজি কর-এর নির্যাতিতা, ধর্ষিতা এবং খুন হওয়া তরুণীটির পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে বিরুদ্ধতার কণ্ঠ-ঋদ্ধ একটি গণ সমাবেশ হল। যথেষ্ট ভাল অডিটোরিয়ামে আরও যথেষ্ট সংখ্যক জুনিয়র ডাক্তার, সিনিয়র ডাক্টার এবং নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণে সাড়া জাগানো সমাবেশ হয়েছে। মঞ্চের ওপরে রাখা ছিল “অভয়া”র প্রতীকী অবয়ব।
অরাজনৈতিক? অদলীয়? দলীয় ঝাণ্ডাহীন?
সমাবেশের প্রথম বক্তা ছিলেন জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস-এর যুগ্ম আহ্বায়ক ডঃ পুণ্যব্রত গুণ। তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই তিনি পরিষ্কার করে দেন, অরাজনৈতিক বলে কিছু হয়না। এ প্রতিবাদকে “অদলীয়” বলা যেতে পারে। আমার বিচারে, এখানেই সমাবেশের মূল সুর বাঁধা হয়ে গিয়েছিল।
সত্যিই কি অরাজনৈতিক বলে কোন কার্যকলাপ হয়? ইতিহাস ধরে পেছনে হাঁটলে অনেকেরই মনে পড়বে ভিয়েতনামের বৌদ্ধভিক্ষু কোয়াং ডুচ (Quang Duc) সায়গনের রাজপথে বসে ১৯৬৩ সালের ১১ জুন নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন আমেরিকান আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানাতে, সে প্রতিবাদ কি অরাজনৈতিক ছিল? একেবারেই না। আগ্রাসী, হিংস্র, মানবহন্তারক আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সর্বব্যাপী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এ ছিল আগুন-জ্বালানো প্রতিবাদ। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক লড়াইয়ের এও ছিল এক অহিংস রাজনৈতিক প্রতিবাদ। বন্দুক হাতে গেরিলা কায়দায় রাজনৈতিক কার্যক্রমের ধরনে প্রতিবাদ নয়। এক শিষ্ট নির্বিবাদী সৌম্য বৌদ্ধভিক্ষুর একান্ত নিজস্ব প্রতিবাদ। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিন্ন রূপ – বৃহত্তর অর্থে রাজনৈতিক তো বটেই।
কিংবা আমার মতো এক উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চিকিৎসক যখন রাজনৈতিক মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের প্রেসক্রিপশন প্যাডে “জাস্টিস ফর অভয়া”র স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেন, তখন দলীয় বিশ্বাসকে অতিক্রম করে এক নীরব প্রতিবাদ – এই অনাচার, ব্যভিচার, খুনে রাজনীতি এবং রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিগ্রস্ত তথাকথিত মেডিক্যাল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ – চরিত্রে রাজনৈতিক।
(বৌদ্ধভিক্ষু কোয়াং ডুচের আত্মবলিদান)
(ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনে নীরব প্রতিবাদ)
জুনিয়র ডাক্তারদের দশ দফা দাবিগুলো কি ছিল?
১। দ্রুত এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্যাতিতার বিচার।
২। স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের অবিলম্বে অপসারণ।
৩। হাসপাতালগুলিতে কেন্দ্রীয়ভাবে ‘রেফারেল’ (রোগীকে অন্যত্র স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া) ব্যবস্থা চালু করা।
৪। প্রতিটি হাসপাতালে কত বেড ফাঁকা, কেন্দ্রীয়ভাবে তার ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা, যাতে একেবারে দূরের রোগীর স্বজনও জানতে পারে কলকাতার কোন হাসপাতালে কোন ডিপার্টমেন্টে কত বেড ফাঁকা আছে এবং কোথায় ভর্তি করা সম্ভব। এর ফলে কলকাতার হাসপাতালের ওপরে অহেতুক রোগীর অসম্ভব চাপ এড়ানো সম্ভব। রোগীদেরও এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ছুটোছুটি করতে হয়না। রোগীর প্রাণ, ডাক্তারদের প্রাণের মতোই অতি মূল্যবান।
৫। কলেজভিত্তিক টাস্কফোর্স গঠন। সিসিটিভি, ডাক্তারদের জন্য অন কল রুম, শৌচালয়, হেল্পলাইন নম্বর, প্যানিক বোতাম চালু করতে হবে।
৬। নিরাপত্তায় সিভিক ভলেন্টিয়ারের বদলে পুলিশকর্মী নিয়োগ। সঙ্গে মহিলা পুলিশকর্মীও নিয়োগ করতে হবে।
৭। হাসপাতালগুলিকে দ্রুত শূন্যপদে নিয়োগ করতে হবে।
৮। ‘ভয়ের রাজনীতি’-তে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৯। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং রেসিডেন্ট ডাক্তারদের সংগঠনকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
১০। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং রাজ্যের হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে দুর্নীতি ও বেনিয়মের অভিযোগগুলির প্রসঙ্গে দ্রুত তদন্ত শুরু করতে হবে।
৩ থেকে ১০ নম্বর দাবীগুলো দেখলে বোঝা যায়, এগুলো একটি “legalized lawlessness”-পুষ্ট সিস্টেমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই। কিন্তু কোন দলীয় আনুগত্য বা পতাকার নীচে নয়। জুনিয়র ডাক্তারেরা নিজেরাই নিজেদের পথ চিনে নিয়েছে। আজ বড়ো স্পষ্ট করে প্রশ্নটি এসেছে – “কোন দিক সাথী কোন দিক বল / কোন দিক বেছে নিবি তুই” – ন্যায় বিচারের পক্ষ, স্বচ্ছ দুর্নীতি ও “সন্ত্রাস সংস্কৃতি” মুক্ত একটি ব্যবস্থা? কিংবা যা চলছে, সে স্রোতে গা ভাসিয়ে প্রতিষ্ঠার উজান বেয়ে যাওয়া?
এ কাজটি করলে নিজেদের “অরাজনৈতিক” হয়তো বলা যায়। কিন্তু সত্যিই যায় কি? আমাদের বিবেক কি বলে – স্থিতাবস্থার রাজনীতি নয়?
জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন তো ভীষণভাবে রাজনৈতিক, কিন্তু রাজনীতির চেনা ছকে নয়, কোন দলীয় রাজনৈতিক চিন্তায় পুষ্ট নয়। এ জন্য রাজনীতির চেনা ছকে অভ্যস্ত মানুষদের একাংশের একে হজম করতে অসুবিধে হচ্ছে। সাম্প্রতিক অতীতে ৯ আগস্ট “অভয়া’ হত্যার পরে এর সর্বব্যাপী সূচনা হয়েছিল নারীদের রাত/রাস্তা দখলের কর্মসূচী দিয়ে।
নিহত মেয়েটি হয়তো আমাদের বলেছে বারেবারে – “বড়ো পাপী হে আমরা!” বিভিন্ন সূত্র থেকে যতটুকু জানা যাচ্ছে, হাসপাতালের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসা ওষুধ-মাদক-সেক্স র্যাকেট-পয়সার বিনিময়ে পাস করানো বা ইন্টার্নশিপ শেষের সার্টিফিকেট দেওয়ার যে মধুচক্র গড়ে উঠেছিল (যাতে আশঙ্কা করা যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্রছাত্রীদের একটি অতি ক্ষুদ্রাংশ যুক্ত ছিল) এই তরুণী চিকিৎসক সেটা জানতে পারে এবং হয়তো বা প্রতিবাদও করেছিল। এর পুরষ্কার হিসেবে সে পেয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত নিজের গাড়ি, গণধর্ষণ এবং মানুষের জীবনের সর্বাধিক-কাঙ্খিত বেঁচে থাকার অধিকার হারানো।
নির্ভয়া, কাশ্মীমেরর বাচ্চা মেয়ে আসিফা, হাথরাস, তারও আগে ২০০৪ সালে মণিপুরের মনোরমা – ধর্ষণ এবং নৃশংসভাবে খুন হবার মিছিল চলছে। এখন অব্দি সর্বশেষ সংযোজন আর জি করের ডাক্তার মেয়েটি। আমাদের বিবশ হয়ে যাওয়া সামাজিক বোধকে এই মৃতদের অনুক্ত প্রশ্ন একবারও বিদ্ধ করছেনা –
কেন নারী হবার জন্য আমাকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দিতে হবে? কিসের সুরক্ষা? আমার দেহের এবং জীবনের সুরক্ষা?
কেন এই “পবিত্র” পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজ আমার সুরক্ষা সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ হবে বারংবার?
উত্তর দিতে হবে, কেন আমাদের বেলাতেই কেবল সুরক্ষার প্রসঙ্গ আসবে?
কেন আমাদের সামাজিক মানসিকতা আমাকে নিজের চারিত্র্যলক্ষ্মণ নিয়ে বাঁচা একজন “মানুষ” হিসেবে গ্রহণ করবেনা? কেন?
আর কত ধর্ষণ, হত্যা, রক্তাক্ত শরীর আর ছিন্নভিন্ন দেহ দেখতে চায় “সমাজ”? ঠিক কতটা দেখলে তৃপ্তি হবে সমাজের চোখের, মনের, ধর্ষকামিতার?
আপনারা “ফাঁসী” কিংবা “এনকাউন্টার” কিংবা “রাজনৈতিক যোগ” নিয়ে কথা বলুন, বলতে থাকুন। কিন্তু এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন না? এই “ইতরের দেশ” কী সভ্য হবে? উত্তর কী কেবল বাতাসেই ভেসে বেড়াবে?
আমরা যে বুকভরে বাতাসও নিতে পারিনা মরে যাবার সময়ে। আমাদের কথা ৩৬৫ দিনে একবার ভাবুন – কারো ফুটফুটে মেয়ে, সক্ষম যুবতী কিংবা গৃহবধু, কামদুনির পড়ুয়া মেয়েটি কিংবা পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের যুবতী।
কলকাতা সহ ভারতের সবজেলায় এবং অঞ্চলে নারীরা, হ্যাঁ কেবলমাত্র নারীরা, রাজপথের দখল নিয়েছে। Reclaim the Night! আমি অন্ত্যেবাসি, প্রান্তিক অঞ্চলের একজন ডাক্তার। কিন্তু এই রায়গঞ্জেও এ মহাযজ্ঞ হয়েছে। কয়েক হাজার নারী দখল নিয়েছেন রাজপথের। তবে পুরুষেরাও পাশে বা পেছনে ছিল। তারা ছিল নিজেদের তাগিদে। এ নারীদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল – দয়া করে কোন রাজনৈতিক দল এসে আমাদের এ প্রয়াসকে কলুষিত করবেন না, কোন রাজনৈতিক ব্যানার বা শ্লোগানও থাকবেনা। এ আন্দোলন আমাদের নিজের – আমাদেরকে করতে দিন। প্রসঙ্গত বলা দরকার রায়গঞ্জ মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারেরাও নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
১৪ আগস্ট মধ্যরাতে নারীরা কোনরকম রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া যেভাবে রাজপথ অধিকার করার আন্দোলনে হাজারে হাজারে সামিল হলেন, এ ঘটনা অভূতপূর্ব এবং ঐতিহাসিক। হারিয়ে যাওয়া একটি পরিসর উন্মোচিত হল ঐতিহাসিকভাবে – রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত আন্দোলনকে অতিক্রম করে “তৃতীয় পরিসর”। এ সম্ভাবনাকে পরম যত্নে, মমতায়, পুষ্টি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নাগরিক সমাজের। একে যেন আমরা ধ্বস্ত না করি।
“অগ্নিবর্ণ সংগ্রামের পথে প্রতীক্ষায়
এক দ্বিতীয় বসন্ত। আর
গলিতনখ পৃথিবীতে আমরা রেখে যাব সংক্রামক স্বাস্থ্যের উল্লাস।
ততদিন আত্মরক্ষার প্রাচীর হোক
প্রত্যেক শরীরের ভগ্নাংশ।” (নির্বাচনিক”, সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
আরও কিছু কথা
১৯৭৭ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ছাত্র ও রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে একটি বিশেষ চারিত্র্যলক্ষ্মণ পীড়া দেয়।
প্রান্তের আন্দোলন ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রায় সবস্ময়েই কেন্দ্রাভিমুখী। মালদা মেডিক্যাল কলেজেও এর ব্যতিক্রম দেখলাম না। নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় হয়তো। কিন্তু একটি সমাবেশ যদি কেবল কেন্দ্রের কথাই শোনে, তাহলে প্রান্তের কথা সমাবেশের কানে পৌঁছবে কী করে? আন্দোলনের চলনশীলতা (locus) এবং অভিমুখের (vector) এরকম পরিণতি কী কাঙ্খিত? এ সমস্যা অতিক্রমের ক্ষেত্রে কলকাতা-কেন্দ্রিক সংগঠক এবং বিভিন্ন প্রান্তের সংগঠক উভয়কেই যত্ন নিতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে। নাহলে সব আন্দোলনই কেন্দ্রাভিমুখী হয়ে থাকবে। কেবল সাময়িক ব্যাপ্তি ঘটবে মাত্র।
Very nice 🙏🙏🙏
Loved this sir 🙏🏼
সময়োচিত লেখা।
অসাধারণ লেখা, যারপর নাই ।
বিচারের দাবীই হলো শেষ কথা. দাবি গুলো খুব স্বাভাবিক ও প্রাসঙ্গিক আমাদের shastha দুর্নীতির সাথে. প্রশাসন রাজনৈতিক বলুক, দল bhanganor চেষ্টা করুক. কি ঘটে চলেছে সবাই বুঝতে পারছে. তবে জেলা ভিত্তিক আন্দোলন গুলো সেভাবে সামনে এলো না.
All good but you have to involve the public. Without public