হ্রদের কোলে ভাসন্ত ক্ষেত (Phumdis) আর নাচুনে হরিণের (Sangai) দেশ: মেঘ বৃষ্টিতে মোড়া উত্তর পূর্ব ভারতের সাত সুন্দরী বোনের একটি ছবির মত সুন্দর পাহাড় – উপত্যকা – সবুজ বনানী – লোকতাক হ্রদ ভরা মনিপুর বা Kangleipak রাজ্য। মহাভারতের চিত্রাঙ্গদা ও বভ্রুবাহনের এই রাজ্যের ঐতিহ্য এবং শিল্প – সংস্কৃতিও যেমন প্রাচীন তেমনই অনন্য। এর সঙ্গে রয়েছে এখানকার মানুষদের সামন্ত এবং বর্মী, অহম, ব্রিটিশ ও ভারতীয় আধিপত্যের বিরূদ্ধে প্রবল সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস। আবার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তি ধর্মে প্লাবিত হয়েছিলো সমগ্র ইম্ফল উপত্যকা ও মনিপুরী সমাজ।
ঈশান কোণে কালো মেঘ: এমন সুন্দর জায়গা এবং ভলোবাসা ও পরিশ্রমে দীক্ষিত মানবসমাজ ও তার অগ্রণী নারীদের জয়গাথা এবং বীর টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ, আইরম ইবোবি সিংহ, মাইরা পাইবি, বিশ্বেশ্বর সিংহ, আইরম চানু শর্মিলাদের ঐতিহ্যকে কে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে ম্লান করে দিয়েছে নোংরা রাজনৈতিক দলীয় বা ব্যক্তি স্বার্থরক্ষার সঙ্গে সীমাহীন অবহেলা, অনুন্নয়ন, শোষণ, বৈষম্য, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক – আমলা – সামরিক অফিসার – ব্যবসায়ী – ঠিকাদার – মাফিয়া চক্রের লুঠপাট এবং অত্যাচার, বিশেষত নারীর উপর অত্যাচার।
রাষ্ট্র সৃষ্ট গৃহযুদ্ধ: এর প্রতিস্পর্ধি হিসেবে উঠে এসেছে সশস্ত্র উগ্রপন্থা। আবার তাকে দমন করতে সমগ্র রাজ্যে আফস্পা লাগু, পবিত্র কাংলা দুর্গ দখল, সেনার ঘেরাও দমন সহ পুরো সমাজটির সামরিকীকরণ। একে একে এর উপর জুটল রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মায়ানমার থেকে কুকি – জো জনজাতিদের ব্যাপক অভিবাসন / অনুপ্রবেশ, তার সহযোগী হিসেবে লাভজনক অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান এবং বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্ম এবং গাঁজা ও আফিং চাষ। তার সঙ্গে নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী বৃহৎ শক্তি চীন ও ক্ষমতাধর চার্চ ও খ্রিষ্টান মিশনারী সংস্থাগুলির প্রভাব বৃদ্ধি। অন্যদিকে ইম্ফল উপত্যকায় ভারতীয় বৃহৎ পুঁজি পুষ্ট হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাব বৃদ্ধি। রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে সিপিআই এবং জাতীয় কংগ্রেসের জায়গায় আরএসএস – বিজেপি – জাতিবাদী আঞ্চলিক দলগুলির উত্থান। সমাজ জীবনে জাতি বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, ঘৃণা ও হানাহানির বাড়বাড়ন্ত।
যা ২০২৩ এ বিজেপির সংরক্ষণের নামে জাতিগত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর পরীক্ষায় আগুন জ্বালিয়ে গৃহযুদ্ধের রূপ নিল। এবং তারপর থেকে এটি আর থামার কোন লক্ষণ নেই। প্রথমে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে প্রশ্রয় দিয়ে এখন হাতের বাইরে চলে যাওয়া ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে থামাতে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। মেইতেই – কুকি দাঙ্গা – সংঘর্ষ সমগ্র মনিপুরকে পুড়িয়ে ছারখার করে এখন তার লেলিহান শিখা নিয়ে অমিত শাহ – হিমন্তবিশ্ব শর্মাদের বিশ্বস্ত মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিংয়ের গৃহ অবধি পৌঁছে গেছে।
জাতি ও ধর্মগত সংঘাত: যেহেতু মনিপুরে এখন জাতি ও ধর্ম গত বিভাজনকে কেন্দ্র করে ড্রোন ও অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের হানা সহ পুরোপুরি যুদ্ধ এবং রাষ্ট্র পরিচালিত বা প্রশ্রয় দেওয়া নারকীয় গণহত্যা ও নিপীড়ন – ধর্ষণ চলছে তাই আমরা এই জাতি ও ধর্ম গত সমস্যাটি একবার চোখ বুলিয়ে নেই।
২২,৩২৭ বর্গ কিমি আয়তনের মণিপুরের ১৬ টি জেলা মিলিয়ে প্রায় ৩০ লক্ষ বিভিন্ন জনজাতির বাস। ভৌগোলিকভাবে মণিপুরের মধ্যটা ইম্ফল উপত্যকা যার চারিদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এই ইম্ফল উপত্যকায় মূলত বাস করেন হিন্দু বৈষ্ণব মেইতেই বা মনিপুরী ভাষাভাষী মেইতেই জনজাতি। রাজধানী ইম্ফল, উর্বর উপত্যকা ও মিষ্টি জলের বৃহৎ লোকতাক হ্রদ সমৃদ্ধ কেইবুল – লামজাও অভয়ারণ্য সহ সমস্ত কেন্দ্র ও রাজ্য সংস্থা থাকায় এরা সুযোগ – সুবিধা এবং শিক্ষা ও চাকরিতে অন্য জনজাতিদের চাইতে অনেকটা এগিয়ে এবং এদের হাতেই কার্যত মনিপুরের রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনীতি, আমলাতন্ত্র ও পুলিশ বাহিনী। এদের সংখ্যা প্রায় ১৮ লক্ষ। এদের মধ্যে ৮% সনাতনী সানামাহী ধর্মের এবং ৮% পাঙ্গল মুসলমান।
উত্তর, উত্তর পূর্ব এবং উত্তর পশ্চিমের নাগাল্যান্ড সন্নিহিত জেলাগুলিতে বাস আও, অঙ্গামী, কাবুই, কাচা, মাও, মারান, পাওমই, সেমা, জেমে প্রমুখ নাগাদের। মনিপুরে নাগাদের মধ্যে থ্যাঙ্কুল নাগাদের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। মনিপুরে নাগাদের সংখ্যা প্রায় ছয় লক্ষ। এরা মূলত ধর্মান্তরিত ক্রিশ্চিয়ান। কিছু হেরেকা বা আদি ধর্মাবলম্বী।বর্তমান মেইতেই – কুকি জাতি সংঘর্ষে নাগারা এখনও নিরপেক্ষ। যদিও স্বায়ত্বশাসন এবং এনএসসিএন সহ জঙ্গী সশস্ত্র নাগা সংগঠনগুলির দাবি স্বাধীন নাগালিম।
মণিপুরের পূর্ব, দক্ষিণ পূর্ব এবং দক্ষিণের তেংনৌপাল, চুরাচাঁদপুর, কংপোকি, চন্ডেল প্রভৃতি মায়নমার ও মিজোরাম সংলগ্ন জেলাগুলিতে কামহাও – সুক্তে বৃহত্তর নৃগোষ্ঠীর কুকি – জো ধারার বিভিন্ন কুকি – চিন ভাষাভাষী গঙ্গতে, মার, সিমতে, সুলতে, থাদেউ, ভাইপেই, ঝৌ, চিন প্রভৃতি পার্বত্য জনজাতির বসবাস। এদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ। এরা মূলত ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান। সামান্য কিছু ইহুদি ও আদি ধর্মাবলম্বী। এদের সঙ্গে মায়ানমারের চিন ও মিজোরামের মিজোদের আত্মিক যোগাযোগ।
এবার সব জেলাতেই কিছু মেইতেই – কুকি মিশ্র অঞ্চল রয়েছে যে গুলি সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত। চাকরি, ব্যবসা, শ্রমিকের কাজে রয়েছেন বেশ কিছু নেপালি, বাঙালি, তামিল, বিহারী, মারওয়ারি প্রমুখ। এদের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। ইম্ফল উপত্যকা ও পাহাড়ি অঞ্চলে যথাক্রমে বাস করেন ৫৭% ও ৪৩% জনসংখ্যা। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর সেনা ও আধা সেনা।
আগুনে ঘৃতাহুতি: বর্তমান বিজেপি জোট সরকার এসে যে তিনটি দ্বন্দ্ব উস্কে দিয়ে মেইতেই – কুকি যুদ্ধের সৃষ্টি করলো:
(১) এস টি সংরক্ষণ এর ললিপপ (অন্যরা বেশি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার আশঙ্কা), (২) মায়ানমার থেকে কুকি অনুপ্রবেশ ও পাহাড়ি জেলায় স্থায়ী বসবাস তত্ত্ব (জাতিগত বিন্যাসের পরিবর্তনের আশঙ্কা) এবং (৩) হিন্দু, সানামহি, হেরেকা বনাম খ্রিষ্টান দ্বন্দ্ব (অন্য ধর্মের প্রাধান্যের আশঙ্কা)।
একসময় যে মনিপুর দেশকে অসম সাহসী সব যোদ্ধা, আন্তর্জাতিক স্তরের নৃত্য ও থিয়েটার শিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালক, ফুটবলার, বক্সার, ওয়েট লিফটার প্রমুখ উপহার দিয়েছে সে এখন প্রতিদিন সংবাদের শিরোনামে আনছে অত্যাচারিত শিশু, গণধর্ষিতা নারী, গুলিতে ঝাঁঝরা পুরুষের বীভৎস লাশগুলির ছবি। হিংসার আগুন জিরিবাম ছড়িয়ে অসমের মিশ্র এলাকা বরাক উপত্যকার দিকে এগোচ্ছে।
এই সব দেখে বাকি ভারত কি বসে থাকবে? : মনিপুর জ্বলেই চলেছে, ওখানকার মা বোনেরা প্রতিদিন ইজ্জত হারাচ্ছেন, প্রতিদিন জনজাতির মানুষ মারা যাচ্ছেন। কৃষি, অর্থনীতি, শিক্ষা, যাতায়াত, প্রশাসন সব কিছু স্তব্ধ। এমনিতেই ল্যান্ডলক প্রান্তিক সীমান্ত রাজ্যের পশ্চাদপদ, কঠোর দারিদ্র্যের জীবন এখন পুরোপুরি স্তব্ধ। এথনিক ক্লিনসিং এর ধাক্কায় এখন নিজভূমি থেকে উৎপাটিত শরণার্থী শিবিরের মানোবেতর জীবন।
না, মানবিক, দেশপ্রেমিক, গনতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী ভারতবাসী কিছুতেই নিশ্চুপ থাকতে পারেন না। মনিপুরে স্থায়ী শান্তি নিয়ে আসতে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সুতরাং মনিপুরকে রক্ষায় মনিপুরের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সাধারণ মানুষকে যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি এগিয়ে আসতে হবে উত্তর পূর্বের অন্য রাজ্যগুলি সহ সমগ্র ভারতের মানুষকে। প্রবল চাপ তৈরি করতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, বিরোধী দল, আদালত ও নিরাপত্তা সংস্থা গুলির উপর।
এক্ষনি যেগুলি করণীয়:
১) অবিলম্বে হিংসা বন্ধ করতে মেইতেই ও কুকি অঞ্চলের মধ্যে এবং মেইতেই ও কুকি শরণার্থী শিবির গুলি ঘিরে মনিপুরী পুলিশ নয় কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী ডিপ্লয় করা। ওই ডিপ্লয়েড ব্যাটালিয়নগুলিতে কোন মেইতেই বা কুকি – জো বা নাগা অফিসার বা জওয়ান এখন রাখা যাবেনা।
২) অসম রাইফেলস ও সামরিক বাহিনী দিয়ে মোরে – তাইমু বৈধ স্থল বন্দর ছাড়া সমগ্র মায়ানমার সীমান্ত ভালোভাবে সিল করে দেওয়া এবং অনুপ্রবেশ, চোরাচালান এবং আন্ত – সীমান্ত সন্ত্রাস ও হামলা বন্ধ করা।
৩) নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও অসম সীমান্তে আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী দিয়ে কড়া নজর রাখা।
৪) মণিপুরের মেইতেই ও কুকি অঞ্চলের সমস্ত প্রাইভেট সশস্ত্র বাহিনীকে নিষিদ্ধ করা, সমস্ত লুঠ আমদানি ও প্রস্তুত করা অস্ত্র গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধার করে নিরাপদ ও সুরক্ষিত জায়গায় রাখা। প্রাইভেট সশস্ত্র বাহিনীর যোদ্ধাদের গ্রেফতার করা। সমস্ত গ্রামরক্ষী বাহিনী গুলির থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নেওয়া।
৫) এই সমস্ত ঘটনার জন্য মূল দায়ী এন বীরেন সিংহ সরকারকে বরখাস্ত করে মনিপুরে আপাতত রাষ্ট্রপতি শাসন চালু করা। বীরেন সহ দোষী দের বিচার শুরু করা।
৬) চূড়ান্ত ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের অপসারণ।
৭) সম্রাট নিরোর মত ঘন ঘন শৌখিন বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অবিলম্বে দেশে ফিরে উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও আধিকারিকদের নিয়ে মনিপুরে গিয়ে থেকে সমস্যা মেটানোর ব্যবস্থা করা।
৮) প্রতিটি হিংসা ও অপরাধের দ্রুত বিচার বিভাগীয় তদন্ত সেরে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
৯) বিরোধী দল এবং ইণ্ডিয়া জোটকেও উদ্যোগী হওয়া। মনিপুরে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম পাঠানো। সংসদের মধ্যে ও বাইরে রাজপথে ঝড় তোলা। নাগরিক সমাজেরও মনিপুর সহ প্রতিটি রাজ্যে সক্রিয় হওয়া, গণ আন্দোলন গড়ে তোলা, ত্রাণ সংগ্রহ ও সেগুলি সঠিক বণ্টনের ব্যবস্থা করা।
১০) মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক নেতা (Natural Leaders), জন প্রতিনিধি, চার্চ ও মাইরা পাইবি সহ সামাজিক সংগঠন, মনিপুরে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলি, মণিপুরের বরেণ্য নাগরিক সহ সমস্ত শ্রেনীর প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রের দ্রুত আলোচনা সহ শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করা।
১১) চান্ডেল বা চূড়াচাঁদপুর বা অন্য কোন স্থানকে সদর করে ইম্ফল উপত্যকার দক্ষিণের কুকি – জো অঞ্চল গুলি নিয়ে একটি কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসাবে ভাবনা চিন্তা করা।
১২) ট্র্যাপড অঞ্চল ও শরণার্থী শিবির গুলিতে অবিলম্বে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বাস্থ্যকর বাসস্থান, শুদ্ধ পানীয় জল, খাদ্য জ্বালানি ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের এবং পরিবার পিছু আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা। চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা।
১৩) নিরাপত্তা বজায় রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সমস্ত সরকারি অফিস ও সংস্থা, বাজার, গণ পরিবহন ইত্যাদি খুলে দেওয়া। বিছিন্ন হওয়া পরিবার গুলিকে দ্রুত একত্রিত করার ব্যবস্থা করা।
১৮.১১.২০২৪