নিত্যকার কেজো রোজনামচার অবকাশে আমার আজকাল কোনো সুচারু, সুঠাম কাজকর্ম করতে ভাল লাগে না।
এমনিই এলেবেলে বসে থাকি রঙচটা দিনটাকে কোলে নিয়ে — হেমন্তশেষের এতোলবেতোল উত্তুরে হাওয়ার মতো শীতার্ত ভাবনারা দল বেঁধে আসে, এলোমেলো করে দিয়ে যায় আমার মনের সংসার।
সেদিন পুরোনো অ্যালবামটা ঝেড়েঝুড়ে নামিয়েছিলাম আলমারির উপরের তাক থেকে। সে তাকে এখনো ভাঁজ করে সাজিয়ে রাখা পাঁশুটে রঙের ফুলপ্যান্ট, হাফহাতা চেকশার্ট আর বাফতার পাঞ্জাবি। অ্যালবামের মোটা, কালো, খসকুটে পাতাগুলো উল্টোতে গিয়ে দেখা হলো নিজের সঙ্গে। জন্মগম্ভীর, উদাস, সদাসন্ত্রস্ত একটা বাচ্চা মেয়ে — উচ্ছ্বাসহীন, আবেদনহীন — কিন্তু, যার চোখের ভাষা খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায়, একটুও অতৃপ্ত নয়।
হবে কি করে? ঐ তো তাকে ঘিরে রয়েছে জীবনরসের কড়াইতে টগবগে রসগোল্লার মতো ফুটতে থাকা বাবা, ভালবাসার আঁচলে অক্ষয় চাবির গোছার মতো বেঁধে রাখা মা — অতৃপ্তির আর জায়গা কোথায় থাকল?
ঐ যে, বুড়োদাদুর ভিটেয় বাড়ির সরস্বতীপুজোর প্রথম বছর — বাবা এনে দিয়েছে মাটির সরস্বতী। পুরোটাই মাটির, চকচকে পাটের কাপড় পরানো নেই, গলায় ঝুটো মুক্তোর গয়না ঝোলানো নেই, এমন কি চুমকি বসানো শোলার মুকুটটাও নেই বলে মেয়েটার মন খারাপ। বাবার বুড়ো ক্যামেরায় তোলা ছবির পোজে তার মুখটি তাই বিষণ্ণ। গায়ের জামার রঙটা মনে পড়ে গেল, হলুদে খয়েরিতে মেশানো। তার ওপর ইলিবিলি কাটছে বারান্দার জাফরির বরফিকাটা আলোছায়া — মনখারাপের চোটে মেয়েটা দুটো প্লাস্টিকের চুড়িই পরে ফেলেছে বাঁ হাতে — ধুর, ধুর, আর ভাল্লাগে না।
ক্লাস থ্রি তে ওঠার পরে মা ভর্তি করে দিয়ে এলো পাড়ার নাচের ইস্কুলে। সেখানে এক অনুষ্ঠানে মেয়ে জিপসি বালিকা সেজে নাচল, ‘মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে নেচে যায়’ —
বাবা-মা স্টুডিওয় নিয়ে গিয়ে সেই অদ্ভুত সাজসুদ্ধ মেয়ের ছবি তুলিয়ে নিয়ে এলো — স্মৃতিটুকু থাক।
আশ্চর্য এটাই, হাতের সেই বাজনা এখনো রয়ে গিয়েছে একতলায় বাবার ঘরের পুরোনো ড্রেসিং টেবিলের কাচের শোকেসের অন্দরে। গত আটচল্লিশ উনপঞ্চাশ বছরের অসংখ্য ঠাঁইবদলের পরেও হারিয়ে ফেলেনি তার সাকিন।
যে বয়েসে কিশোরীর প্রথম শাড়ি পরার শখ হয়, সেই বয়সেই মেয়েটাকে বিষম রকম কবিতায় পেলো।
বাবার উপহার দেওয়া সোনালি টুপির উইং সাং ঝর্নাকলমে ঝরে পড়তে লাগল আবেগের বর্ণমালা, ভরে উঠতে লাগল ‘বঙ্গ লিপি’ খাতা।
দু’চার ছত্র মনে রয়ে গিয়েছে আজও।
‘অন্ধকারের ঘন্টা বাজছে,
রাত দু’টো।
দমকা হাওয়ায় যাচ্ছে উড়ে,
শুকনো পাতা, খড়কুটো’।
কিংবা —
‘কালকে রাতে,
মানুষটাকে
স্বপ্নে দেখেছিলাম।
কেন? নেই তো জানা।
মন থেকে যে মুছেই গেছে,
মানসপটে স্মৃতিও মলিন,
তবুও কেন ডেকে আনা?’
এইসব অনভিপ্রেত অকালপক্কতা পেরিয়ে, হঠাৎই জীবন তাকে আছড়ে ফেলল বাস্তবের পাটে।
ঐ যে, কোনারকের চাকার সামনে তিনজন দাঁড়িয়ে, তার বয়স তেরো — মায়ের তখন সবে ৩৯! মানসিক ব্যাধিতে ধরল মাকে। কাঁচা বয়সে অসুস্থ মা, অসহায় বাবা, অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্য আর আকাশচুম্বী পারিবারিক প্রত্যাশাকে সামলাতে সামলাতে মেয়েটার মুখের হাসি গেল মিলিয়ে।
ঐ যে মালদার চিকা মসজিদের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো সদ্যতরুণী, সে তখন তার প্রথম ভালবাসা, তার সাহিত্যপ্রেমকে বিসর্জন দিয়ে এসেছে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিদ্যামঠতলে।
নাহ্, বন্ধ করে দিলাম অ্যালবাম। আমার মনের উঠোনে শৈশবের প্রবেশ নিষেধ। সেখানে মেথুসেলা বসে আছে এক পৃথিবী অভিজ্ঞতা নিয়ে — তার লোল চামড়ার অজস্র ভাঁজে লেখা আছে যাপনের কাহিনী — তার, মায়ের, বাবার, বুড়োদাদুর বাড়ির, খড়্গপুরের কাঁসাইয়ের চর আর ইস্কুল লাইব্রেরির এনিড ব্লাইটনের গল্পের, ডানবার মিলের মেস কোয়ার্টার আর পাক্ষিক আনন্দমেলার, শিয়ালদা-নৈহাটি রেললাইনের, বাগবাজার আর চালতাবাগানের দুগগাঠাকুরের, ন্যাশনাল মেডিক্যালের রামমোহন ব্লক আর লেডিজ হোস্টেলের ঢালা ছাদের, ঝন্টুর রোল আর গড়িয়াহাটের তিরিশ টাকার নাইটির, বেহালা বালানন্দের চিলেকোঠার ঘরের নির্জনতার, কল্যাণীর জে এন এম আর কালিয়াগঞ্জের মফস্বলী হাসপাতালের প্রাত্যহিক প্রাণচঞ্চল ব্যস্ততার।
আমার একান্ত নিজস্ব ভোরবেলায় সূর্য ওঠা আছে, আছে অবাক পাখির গান, ঘাসের ডগায় রোদের মুকুট পরা শিশিরকণা, বাগানে ঝরে পড়া কলকে ফুল আর পাকা বাতাবি লেবু, বনতুলসীর ঝোপের ফাঁকে বুকে হেঁটে যাওয়া একলা গিরগিটি, ছোট্ট টিনের বাক্সে খাতা, বই, পেনসিল সাজিয়ে মোড়ের ইশকুল — নেই কেবল এক্কাদোক্কা, চাইনিজ চেকার, ফুচকা কিংবা হজমিগুলি, নাগরদোলা বা মেলার পাঁপড়ভাজা, আচমকা কালবোশেখির পরের নতুন বৃষ্টিতে হঠাৎ ভেজা — এসব আমার অ্যালবামে নেই, কোনোদিনও ছিল না।
এই ফুরিয়ে আসা হেমন্তবেলায় তার জন্য আফশোসও নেই অবশ্য।
যা রয়েছে, তা-ই বা কাকে দিয়ে যাব? সেইসব গুরুভার, দুর্বহ মুহূর্তদের তুলে দিয়ে যাব কার হাতে?
না, তারা আমারই সঙ্গে পেরিয়ে যাবে রেনবো-ব্রিজ, ওপারে কুয়াশাঢাকা জনশূন্য কালচে সবুজ বনপথ হাতছানি দিয়ে ডাকবে আমায় — দ্য রোড নট টেকেন।
এখন শুধুই শীতের অপেক্ষা।