[ডঃ মনমোহন সিংহের নাম শুনলে অনেকেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভরিয়ে দেন। আবার কেউ কেউ তাঁর অর্থনীতিক নীতির কঠোর সমালোচনা করেন। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, অটলবিহারী বাজপেয়ীদের মত প্রবল ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন প্রধানমন্ত্রী এবং নরেন্দ্র মোদীর উচ্চকিত প্রচারের মাঝে ঢাকা পড়ে যাওয়া সদ্যপ্রয়াত প্রচারবিমুখ ডঃ মনমোহন সিংহের রয়েছে এক বিশাল ও সুদূরপ্রসারী কর্মকাণ্ড।]
ভারতের সাড়া জাগানো প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী, ত্রয়োদশ ও দুটি সম্পূর্ণ সময় ১০ বছরের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের একমাত্র সংখ্যালঘু ও শিখ প্রধানমন্ত্রী, ডঃ মনমোহন সিংহ ছিলেন মেধাবী ছাত্র, বিশিষ্ট অর্থনীতিক, শিক্ষাবিদ এবং কৃতবিদ্য আমলা। তাঁর রাজনীতিতে আসা, অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হওয়া তিনটিই ঘটনাচক্রে। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ পর্বে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নীতিপঙ্গুত্বের অভিযোগ থাকলেও সর্বত্র তিনি বিদ্বান, মিতবাক, মৃদুভাষী, নম্র, ভদ্র, নীতিনিষ্ঠ, নিয়মানুবর্তী, কাজ অন্ত প্রাণ, সজ্জন ব্যাক্তি হিসাবে এবং সাদাসিধা জীবন যাপনের জন্য সমাদৃত। বিভিন্ন দল ও বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের সামলে ঐক্য মতের ভিত্তিতে দু দুটি সরকার চালানো ও সম্পূর্ণ করার বিরল কৃতিত্ব রয়েছে তাঁর। তিনি পদ্মবিভূষণ, ইউরো মানি অ্যাওয়ার্ড, এশিয়া মানি অ্যাওয়ার্ড সহ বহু সম্মাননা পান।
চিত্তাকর্ষক সংগ্রামী জীবন (Interesting Struggling Life) : অবিভক্ত ভারতের অবিভক্ত পাঞ্জাবের (বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের চকওয়াল জেলা) গাহ গ্রামে এক ক্ষত্রী শিখ সাধারণ ব্যাবসায়ী পরিবারে মনমোহন সিংহের জন্ম। বাবার ছিল শুকনো ফলের ব্যাবসা। অল্পবয়সে মাতৃহারা হয়ে ঠাকুমার কাছে মানুষ। তাঁর যখন ১০ বছর বয়স তাঁদের পরিবার উত্তর – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পেশোয়ারে চলে যায়। তিনি প্রথমে গ্রামের সরকারি উর্দু মিডিয়াম স্কুলে ও পরে পেশোয়ারে খালসা স্কুলে পড়াশোনা করেন। সেই কারণেই মাতৃভাষা পাঞ্জাবির সঙ্গে উর্দু ভাষা এবং গুরমুখির সঙ্গে উর্দু লিপিতে তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয়েছিল। বিদ্যুতের অভাবে সেইসময় হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করতে হত।
তিনি যখন কিশোর তখন টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, খুন ও রক্তপাতের আবহে ১৯৪৭ এর দেশভাগ এবং দেশভাগের আবর্তে তাঁদের পরিবার উৎপাটিত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তিনি কোনরকমে একটি উদ্বাস্তু বোঝাই ট্রেনে ভারতে চলে আসতে পারেন। অবশেষে তদানীন্তন সংযুক্ত প্রদেশের হলদয়ানিতে উদ্বাস্তু শিবিরে তাঁদের পরিবারের সংযোগ ঘটে। এরপর তাঁদের পরিবার পাঞ্জাবের অমৃতসরে স্থানান্তরিত হলে তিনি সেখানকার কটন কলেজে ভর্তি হন। প্রবল অর্থাভাবের মধ্যে মনমোহন সিংহ কে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়।
এরপর হোশিয়ারপুরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুবারই পরীক্ষায় প্রথম হয়ে অর্থনীতিতে বিএ (১৯৫২) ও এমএ (১৯৫৪) পাশ করেন। তারপর যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জনস কলেজ থেকে অর্থনীতিতে ট্রাইপস হন (১৯৫৭) এবং অ্যাডাম স্মিথ পুরস্কার অর্জন করেন। তারপর দেশে ফিরে চণ্ডীগড়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের নবগঠিত ক্যাম্পাসে কয়েক বছর অধ্যাপনা করে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিড কলেজ থেকে অর্থনীতিতে ডিফিল (১৯৬০ – ’৬২) করেন। কেমব্রিজে থাকাকালীন স্বনামধন্য অধ্যাপিকা জোয়ান রবিনসন ও অধ্যাপক নিকলাস কালডর এবং তাঁদের কেইনসীয় অর্থনীতির বামপন্থী ব্যাখ্যা মনমোহন সিংহের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন (Illustrious Career) :
১৯৫৯ ও ১৯৬৩: রিডার, অর্থনীতি বিভাগ, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৬৩ – ১৯৬৫: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৬৬ – ১৯৬৯: সুইজারল্যান্ডের জেনিভাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের United Nations Conference on Trade and Development (UNCTAD) এ কর্মরত
১৯৬৯ – ১৯৭১: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকস
১৯৭১: কেন্দ্র সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য দপ্তরের উপদেষ্টা
১৯৭২ – ১৯৭৬: কেন্দ্র সরকারের অর্থ দপ্তরের প্রধান উপদেষ্টা
১৯৭৬ – ১৯৮১: কেন্দ্র সরকারের অর্থ দপ্তরের সচিব
১৯৮২ – ১৯৮৫: রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর
১৯৮৫ – ১৯৮৭: যোজনা কমিশনের (Planning Commission) ভাইস চেয়ারম্যান
১৯৮৭ – ১৯৯০: সেক্রেটারি জেনারেল, সাউথ কমিশন, জেনিভা, সুইজারল্যান্ডে
১৯৯০: প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের বিদেশ নীতি সংক্রান্ত উপদেষ্টা
১৯৯১: চেয়ারম্যান, ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন (UGC)
১৯৯১ – ১৯৯৬: কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের অর্থমন্ত্রী
১৯৯১ – ২০১৯: অসম থেকে কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ
১৯৯৮ – ২০০৪: রাজ্যসভার বিরোধী নেতা
২০০৪ – ২০১৪: দু দুটি পর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ‘ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়ান্স (UPA)’ জোট সরকারের সফল পরিচালনা
২০১৯ – ২০২৪ এপ্রিল (অবসৃত): রাজস্থান থেকে কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ
১৯৯১, ভারতীয় অর্থনীতির জলবিভাজিকা (1991, The Watershed of Indian Economy): তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে ১৯৯১ তে হত্যার পর জুনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ২৪৪ টি আসন পেয়ে কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও বৃহত্তম দল হিসাবে কয়েকটি দলের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়ে। কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের কারণে বানপ্রস্থে চলে যাওয়া পিভি নরসীমা রাও কে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। দেশের অর্থনীতির হাল যথেষ্ট খারাপ ছিল। পিভি রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর আইজি প্যাটেল কে অর্থমন্ত্রী করতে চাইলে তিনি রাজি হলেন না। এরপর ভরাডুবির সম্মুখে পৌঁছনো ভারতীয় অর্থনীতিকে বাঁচাতে রাজনীতির বৃত্তের বাইরে থাকা অর্থনীতিবিদ ডঃ মনমোহন সিংহ কে এই গুরুভার দেওয়া হয়।
মনমোহন সিংহ যখন দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন তখন ভারতের রাজস্ব ঘাটতি (Fiscal Deficit) জিডিপির ৮.৫%, পরিশোধের বাকি (Balance of Payment) বিপুল, চলতি হিসাবের ঘাটতি (Current Account Deficit) জিডিপির ৩.৫%। বিদেশি মুদ্রার (Foreign Reserve) ভাণ্ডার মাত্র ১০০ কোটি ডলার অর্থাৎ খনিজ তেল, ইস্পাত, ইলেক্ট্রনিক ইলেক্ট্রিক্যাল ও কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি, সার, ওষুধ, ভোজ্য তেল, ডাল ইত্যাদি আমদানির উপর নির্ভরশীল ভারতের মাত্র দু সপ্তাহ আমদানি করার ক্ষমতা ছিল। এমতাবস্থায় ভারতের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির এক প্রভাবশালী রূপকার তিনি পুঁজিবাদের পথ ধরে দেশের অর্থনীতির বিনিয়ন্ত্রনের (Deregulation) দাওয়াই বাতলালেন। তাঁকে সমর্থন জানালেন স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত বাণিজ্যমন্ত্রী পি চিদাম্বরম। কিন্তু কংগ্রেসের বাদবাকি নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিধা এবং / অথবা বিরোধিতা ছিল। শেষমেশ প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসীমা রাও অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ কে প্রয়োজনীয় অনুমতি দেন। বাকিটা ইতিহাস।
২৪ জুলাই ১৯৯১ এবং পরবর্তী বছরগুলিতে মনমোহন সিংহ যে কেন্দ্রীয় বাজেট গুলি পেশ করেন তাতে অর্থনীতিতে বিনিয়ন্ত্রন ও উদারীকরণ (Liberalization) ঘটিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিকে বিশ্ব অর্থনীতির কাছে উন্মুক্ত (Open) করেন এবং বিশ্বায়িত পুঁজিবাদী নব উদার অর্থনীতির (Globalized Capitalist Neo Liberal Economy) প্রবাহে সামিল করেন। অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনেন, এতদিনকার লাইসেন্স ও পারমিট রাজের বিলোপ ঘটান, অর্থ ব্যাবস্থার মধ্যেকার লাল ফিতের ফাঁস ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আঘাত হানেন, আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেন, অলাভজনক পাবলিক সেক্টর সংস্থার বিলোপ (Liquidation) ও বেসরকারিকরণের (Privatization) পথ খুলে দেন, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (Foreign Direct Investment or FDI) কে উৎসাহিত করেন। এরফলে ব্যাবসা বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, ব্যাক্তি উদ্যোগ বৃদ্ধি পায়, শেয়ার বাজার চাঙ্গা হয়, সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নতি ঘটে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়।
আর্থিক বৃদ্ধির (Economic Growth) হার ৭ – ৯% এ পৌঁছয়। ঘাটতি সামলাতে বিক্রি করে দেওয়া রিজার্ভ ব্যাংকের সোনা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়, বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার বৃদ্ধি পায়, শিল্পে প্রতিযোগিতা বাড়ে, বাড়ে বিদেশি লগ্নি ও প্রযুক্তি। জাতীয় কংগ্রেস দাবি করে যে মনমোহন সিংহ অর্থ ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার আগে ভারত ছিল বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম অর্থনীতি যা তাঁর সময়ে হয়ে ওঠে প্রায় দুই লক্ষ কোটি ডলারের (Trillion Dollars) বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। তাঁর ১০ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে গড় আর্থিক বৃদ্ধি ছিল ৭.৭% যা সর্বকালীন রেকর্ড। ২০০৭ – ’০৮ এর বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের সময়ে ভারতীয় অর্থনীতি যথেষ্ট মজবুত ছিল। আবার ১৯৯২ তে সরকারি নিয়মনীতির ফাঁক গলে একটি বড় আর্থিক দুর্নীতি প্রকাশিত হলে মনমোহন সিংহ পদত্যাগ করতে চান। প্রধানমন্ত্রী পিভি তাঁকে নিরস্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং আর্থিক সংস্কার (Prime Minister Ship and Economic Reforms): তাঁর অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন উদার আর্থিক সংস্কার, পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী বিজেপির অটল বিহারী বাজপেয়ীর সময়কার পুঁজিবাদী শিল্পপতিকেন্দ্রিক ‘ইন্ডিয়া সাইনিং’ পুঁজিবাদী আর্থিক নীতি এবং দেশব্যাপী বাজার অর্থনীতিকে (Market Economy) আরও সহজে ছড়িয়ে দিতে ‘সোনালী চতুর্ভুজ (Golden Quadrilateral)’ নির্মাণ এবং সড়ক সহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কর্মসূচি অক্ষুণ্ণ রাখেন। এরপর তিনি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির সংস্কারের কাজে হাত দেন। শিল্প বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। কৃষকদের ঋণ ভার মকুবের এবং ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মুল্য (Minimum Support Price or MSP) নির্ধারণে উদ্যোগ নেন। সেলস ট্যাক্সের পরিবর্তে সমস্ত দেশে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (VAT) প্রবর্তন করেন।
প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি (Prime Minister Ship and Welfare Programmes): এক্ষেত্রে ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গান্ধী এবং অভিজিত সেন, জা দ্রেজ, অরুণা রায়, মাধব গ্যাডগিল, রামদয়াল মুন্ডা প্রমুখ যোজনা কমিশন সদস্য এবং ‘ন্যাশনাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলে’র পরামর্শদাতাদের অবদান অনস্বীকার্য। ২০০৫ এ এল একই সঙ্গে গ্রামীণ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণের অভিনব প্রকল্প National Rural Employment Guarantee Act (NREGA, পরবর্তীতে MGNREGA)। সাধারণের ভাষায় ১০০ দিনের কাজের কর্মসূচি। একই বছর পাঁচ লক্ষ গ্রামীণ স্বাস্থ্য কর্মী Accredited Social Health Activists (ASHA) দের সন্নিবেশিত করে লাগু হল সার্বিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের National Rural Health Mission (NRHM, পরবর্তীতে NHM) কর্মসূচি। এল জনগণের অধিকার অর্জনের Right to Information Act (RTI)। ২০০৬ এ এল জনজাতি ও বনবাসীদের অধিকার রক্ষায় Scheduled Tribes & Other Traditional Forest Dwellers (Recognition of Forest Rights) Act। ২০০৬ এই AIIMS, IITs, IIMs প্রভৃতি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিতে ২৭% ওবিসি সংরক্ষণ আনা হল। ২০০৯ এ ‘সর্ব শিক্ষা অভিযান’ কর্মসূচিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি Right to Education Act (RTE), Right of Children to Free and Compulsory Education Act প্রবর্তন করে শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হল। Midday Meal Scheme কে প্রসারিত করা হল। নতুন আটটি IIT তৈরি হল।
২০০৯ এ Unique Identification Authority of India (UIDAI) স্থাপন করে প্রতিটি নাগরিকের জন্য Unique Identification Number এবং সর্বত্র ব্যাবহারের জন্য Aadhaar (Multi Utility Card) এর প্রবর্তন। ২০১৩ তে খাদ্য ও জমি সুরক্ষার ক্ষেত্রে National Food Security Act (NFSA) এবং Right to Fair Compensation & Transparency & Land Acquisition, Rehabilitation & Resettlement Act।
জম্বু ও কাশ্মীরের পরিকাঠমো উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। উত্তর পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদকে প্রশমিত করা হয়। ২০০৮ এ মুম্বাই বিস্ফোরণের পর জাতীয় স্বার্থে National Intelligence Agency (NIA) গঠন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রিত্ব ও নতুন বিদেশ নীতি (Prime Minister Ship and New Foreign Policy): খুবই উল্লেখযোগ্য পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ জিগির বন্ধ করে শান্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হয়। চিনের সঙ্গে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। চিনা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে আসেন। নাথু লা সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য খুলে দেওয়া হয়। আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কেরও উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক অটুট রেখে ইসরায়েল এর সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ২০০৯ এ রাশিয়া, চিন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা কে নিয়ে BRICS গঠিত হয়। ন্যাটো কর্তৃক লিবিয়ায় হানার বিরোধিতা করা হয়।
সোভিয়েতের ভাঙ্গনের পর বিশ্ব জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক বিশ্ব (Unipolar World) গঠনের পর নেহরুর আমল থেকে এতদিন চলে আসা নিরজোট (Non – Aligned Movement or NAM) বিদেশ নীতি থেকে সরে এসে ভারত বর্তমান দুনিয়ার একমেবাদ্বিতীয়ম কর্তৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝোঁকে। যার চূড়ান্ত রূপ পায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি (US – India Civil Nuclear Agreement)। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারতের অসামরিক ও সামরিক পারমাণবিক কেন্দ্রগুলির পৃথকিকরণ, অসামরিক ক্ষেত্রে International Atomic Energy Agency (IAEA) সংস্থার নজরদারি ও নিরাপত্তা এবং মার্কিন সংস্থাগুলির থেকে পারমাণবিক জ্বালানি সহ সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি ক্রয়ের বিষয়গুলি থাকে। ২০০৫ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার পর ২০০৮ এ চুক্তি চূড়ান্ত হয়। বামপন্থী দলগুলি প্রথম থেকেই এই চুক্তির বিরোধিতা করে। মনমোহন সিংহ একসময় পদত্যাগ করতে চান। অন্যরা নিরস্ত করেন। চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বামপন্থীরা ইউপিএ সরকারের থেকে সমর্থন তুলে নেয়। মনমোহন সিংহ তথাপি ঐ চুক্তিতে স্থির থাকেন। সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের মুখে তাঁর সরকার টিকে যায়। ২০০৯ লোক সভা নির্বাচনে (কংগ্রেস ২০৬ আসন, জোট ২৬২ আসন) কংগ্রেস ২০০৪ লোক সভা নির্বাচনের (কংগ্রেস ১৪৫ আসন, জোট ২১৮ আসন) থেকে বেশি আসন পেয়ে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার গঠন করে।
প্রদীপের নিচে অন্ধকার (Darkness under the Lamp): ভারতীয় অর্থনীতির বিকাশ ঘটলেও তাদেরই কেবল সুযোগ থাকায় উন্নতি ঘটে ধনী ও শিল্পপতিদের। মুলত ভারতীয় বড় ব্যাবসায়ী – দালাল এবং করপোরেট শিল্প – বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটলেও নিজস্ব শিল্প, কৃষি ও কর্মস্থানের বিকাশ এবং বুনিয়াদি অর্থনীতি ও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর উন্নতি না ঘটায় বিপুল সংখ্যক নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রদের কষ্ট লাঘব হয়নি। দেশে বিদেশে লগ্নি, যাতায়াত ও ব্যাবসা করার সুযোগ ইত্যদির সুফল সীমিত সংখ্যক ধনী ও উচ্চবিত্তর করায়ত্ব থেকেছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি হ্রাসের সুযোগ নিয়ে ক্রমশ দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে পারিবারিক (Crony) ফাটকা পুঁজির (Lumpen Capital) অধীশ্বররা। ফলে একের পর এক তহবিল তছরুপ (Money Laundering) ও বিদেশে অবৈধ অর্থ পাচার (Illegal Fund Transfer), নিত্য নতুন আর্থিক কেলেঙ্কারি (Financial Scam), শেয়ার বাজার প্রথমে ফাঁপিয়ে প্রচুর মূলধন সংগ্রহ করে তারপর ধ্বস নামিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ নিয়ে শোধ না করা, সাইবার প্রতারণা ও জালিয়াতি, বিভিন্ন রকম আর্থিক দুর্নীতি ও কারচুপির জন্ম হয় যা পরবর্তী মোদী – শাহ জমানায় চূড়ান্ত রূপ পায় এবং জনসাধারণকে সর্বস্বান্ত করে দিতে থাকে।
নেহরুভিয়ান মিশ্র অর্থনীতির (Nehruvian Mixed Economy) যুগের রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তারকারী কতিপয় বৃহৎ শিল্পপতি, বিদেশি বহুজাতিক ও কর্পোরেট সংস্থাগুলি এবার রাষ্ট্রের পরিচালক হয়ে ওঠে। ফলে তাদের লুঠ, মুনাফা, শোষণ ও শ্রমিক বিরোধিতা অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে। আর্থিক বৈষম্য প্রকট হয়। বহু লাভজনক সরকারি সংস্থাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বহু মানুষ কাজ হারান। যে দ্রব্য দেশেই উৎপন্ন হত তার উৎপাদন বন্ধ করে অনেক বেশি দামে বিদেশ থেকে আমদানি করা হতে থাকে।
নতুন অর্থনীতি প্রয়োগের এক বছরের মধ্যে ১৯৯২ তেই ঘটে ১৮০ কোটি ডলারের একটি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। এরপর এই সরণী বেয়ে টু জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি, কমনওয়েলথ গেম কেলেঙ্কারি, কয়লার ব্লক বণ্টন নিয়ে বড়সড় দুর্নীতি ……। তাই বোধহয় ইতিহাসের পরিহাস যে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম পর্বের সবচাইতে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি নোটবন্দী (Demonetization) নিয়ে তাঁকে বলতে হয়ঃ “An organized loot and legalized plunder, a monumental mismanagement and disaster, an underestimate not an overestimate. The ordinary people have suffered as a result of this imposition on the country overnight by the PM.”
অন্যদিকে তিনি নকশাল মতবাদকে দেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রধান বিপদ হিসাবে আভিহিত করে মাওবাদী কার্যকলাপ দমনের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে মধ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের ৯৫ টি জেলায় আধা-সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত অভিযান Operation Greenhunt কে সম্মতি দেন। তার আগেই ২০০৫ এ সেখানে চালু হয়ে গেছে ‘সালওয়া জুলুম’ এর তাণ্ডব। তাঁর সময়েই উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে সামাল দিতে কালা কানুন Unlawful Activities (Prevention) Act (UAPA) কে আরও কঠোর (UAP Amendment Act 2004) করা হয়।