আমার খুব প্রিয় সিনেমার একটা হলো উত্তম কুমারের শেষ সিনেমা ‘ওগো বধূ সুন্দরী’।
সিনেমার স্ক্রিপ্ট বা অন্যান্য ব্যাপার তেমন বুঝি না, কিন্ত গানগুলো খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে ওই গানটা- “শুধু তুমি নয় অবলাকান্ত, অনেকেরই বলার সময় খেয়াল থাকে না!”
কিশোর কুমারের গলায় এই গানটি যে কি ভালো লাগে আমার, বলে বোঝানো যাবে না।
বাস্তব জীবনেও আমরা কখনো কখনো কি কথা বলি, সেটা বলার আগে, বলার সময় বা বলার পরেও খেয়াল হয় না কি বললাম। কখনো শব্দের বানানে ভুল, ভুল অর্থে ব্যবহার, বাক্যে ভুল, প্রকাশ ভঙ্গিতে ভুল – ইত্যাদি সবারই কিছু না কিছু হয়।
তো এসব ক্ষেত্রে সবটাই যে খারাপ, সবটাই ভালো বা মজার, তা হয় না।
এরকম একটি সমস্যা হলো মুদ্রাদোষ যেটা আমাদের অজান্তেই ঘটে যায়। আমাদের অনেকের অনেক রকম মুদ্রাদোষ থাকে। তার একটি হলো – কথা বলতে বলতে বিশেষ একটি শব্দ বারবার ব্যবহার করা। সেই শব্দের ব্যবহার প্রায়ই ব্যাকরণ মানে না।
কথার শুরুতে, মাঝে বা শেষে আমরা যেখানে খুশি গুঁজে দিই সেই শব্দ। সেটা কখনো কখনো বিরক্তিকর লাগে শুনতে, কখনো এমন হাসির উদ্রেক করে যে চুপ থাকা যায় না।
বহু রোগীদের এই মুদ্রাদোষের কারণে, ডাক্তারি করতে করতে বহুবার চমকে উঠেছি! এখনো যতবার কেউ এটা বলেন- চমকে উঠি। সত্যি বলতে – বহুবার নিজেই একদম অবলাকান্ত হয়ে গেছি! না কিছু বলতে পেরেছি, না হাসতে বা কাঁদতে বা রাগ করতে পেরেছি। ডাক্তারকে ইমোশন লুকাতে হয় সব কিছুতেই।
এবং আমি নিশ্চিত অন্য ডাক্তাররাও এই মুদ্রাদোষে দুষ্ট মানুষকে পেয়েছেন কখনো না কখনো।
নিতান্তই একটু হাস্যরসের জন্য এটা লেখা। যদিও দু’একটা ঘটনা মোটেই হাসির নয়, বরং রাগ করার মত, দুঃখ পাবার মত। ঘটনাগুলো একশো শতাংশ
সত্যি। একটুও বানানো নয়। তাই এই লেখা কাউকে আঘাত করার জন্য নয়।
এমনিতেই এখন নানারকম মুদ্রাদোষে অর্থনীতির হাল খারাপ। তাই একটি মাত্র মুদ্রাদোষ নিয়ে বলবো। বাকি গুলো পরে কখনো হবে ….
বিভিন্ন সময়ে ঘটা ঘটনাগুলো পরপর লিখছি।
১. রোগী সামনে বসেছেন। বললামঃঃ কি সমস্যা বলুন?
– সমোস্যা হইছে কি আপনের পাছায় একটা ফোঁড়া!
আমি এক লাফে উঠে দাঁড়ালাম। তখন আমি যে
হাত দিয়ে দেখবো, সে উপায়ও নেই! অতএব, হাসি চেপে নড়েচড়ে বসলাম। রোগী বুঝতে পারেনি।
শুয়ে পড়ুন, দেখছি!
২. গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। শুনেই একজন চলে এসেছেন। সাথে তাঁর এক আত্মীয়কে নিয়ে।
এ কথা সে কথার পর বললেন – শরীরটা ভালো নাই আপনার।
মুখ ভার করে ডাক্তারিকে গাল দিচ্ছিলাম। সত্যিই – কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে শরীরটা।
বললাম – কি সমস্যা?
– সে আর কি বলবো! সমস্যা একটা নয়। এই ধরুন আপনার সুগার কোলেস্টেরল হাইপ্রেসার তো আছেই! এখন আবার শুনছি আপনার প্রস্টেটও বেড়েছে!
আমার কেমন যেন মাথা ঘুরতে শুরু করলো!! ইনি কি জ্যোতিষী?
টেস্ট করাতে হবে!! ?
৩. রোগী মধ্যবয়সী মহিলা। বললাম – বলুন কি হয়েছে?
আমার পেটের উপর হাত দিয়ে দেখালেন- এখানে খুব ব্যথা!
(বলে রাখি, এই ব্যাপারটা বহুবার ঘটেছে। রোগী নিজের শরীরে না দেখিয়ে ডাক্তারের শরীরে দেখাবে কোথায় সমস্যা! একবার তো একজন উঠে এসে আমার পিঠ টিপে টিপে দেখিয়েছিল ঠিক কোথায় ব্যাথা আর কোনদিকে যায়!! তা কোমর থেকে আর একটু নিচের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বলতে বাধ্য হলাম – থাক। বুঝেছি!)
আমি একটু আনমনা ছিলাম মেশিনের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ পেটে হাত দেবে আশা করিনি। তাও ভাগ্যিস পেটে হাত দিয়েছেন!! এবং একদম নিষ্পাপ মন থেকেই! কিছু বলতে পারছি না।
– তাই? আর কি কি সমস্যা?
– আপনার তিন বছর আগে অ্যাপেন্ডিক্স, সাত বছর আগে পিত্তথলি, তারপর এই ক’দিন হলো আপনার লাইগেশন করা হলো!!
আমি মন দিয়ে শুনছিলাম। পিত্তথলি আর অ্যাপেন্ডিক্স অব্দি ঠিক ছিল।
‘আপনার লাইগেশন করা হলো’ টা শুনে ভাবলাম – ভাগ্যিস ভ্যাসেকটমি বলেনি!!
হাসবো না কাঁদবো?
৪. আরেকজন মহিলা তো আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিলেন। ইউএসজি করাতে এসেছেন। শুয়ে পড়েছেন বেড এ।
– বলুন কি হয়েছে?
– আপনের দুইডা বাচ্চা হইছে!
শুধরে দিলাম।- আপনের নয়, বলুন আমার। তারপর?
মহিলা হাসলেন, অথচ বুঝলেন না !
– ধরুন সেই থেইক্যা আপনের মাসিক হইচ্ছে না !
এবার সহকারী মেয়েটি অব্দি হেসে ফেললো।
সে ই বললো- বলুন আমার মাসিক হইচ্ছে না।
মহিলা লজ্জায় জিভ কাটলেন।
আমি হাসি কান্না রাগ সব মিলিয়ে বললাম- বলুন।
– এবার ধইরেন আপনার ডাক্তার নাহি কপাট্টি পড়াই দিছে। হের লাইগা আপনার বাচ্চা আহে না।
(আসলে অনেক মহিলাকে বাচ্চা জন্ম দেয়ার পর কপার-টি নামক জন্ম নিরোধক একটা ডিভাইস জরায়ুতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।)
এবার আর পারলাম না। – থামুন। বুঝেছি।
গিন্নী এসব শুনলে ডিভোর্স পাক্কা! হায় ভগবান!
প্রমাণ অব্দি করতে পারবো না এতো কিছু!!
৫. একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এলেন। কোনরকমে শুয়ে পড়লেন। অসুস্থ বোঝা যায়।
যেই জিজ্ঞেস করলাম – বলুন আপনার সমস্যা। বলে আমি মেশিন রেডি করছি।
ভদ্রলোক কানে কম শোনেন সেটা বাড়ির লোক বললো।-এই কারণে একটু জোরে কথা বলেন।
– আপনার তিন দিন ধরে পায়খানা প্রস্রাব বন্ধ!!
এই কথা গুলো এতোটাই জোরে বললেন- বাকি সবাই হেসে ফেললো।
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম- সত্যি কি তাই? আমারতো কোনকালেই এমনটা হয়নি! আজ সকালেও দিব্যি সব ঠিকঠাক হয়েছে।
বললাম – বুঝলাম আপনার পায়খানা প্রস্রাব বন্ধ। আর কিছু?
– ও হা। তারপর ধরুন আপনার প্রচণ্ড দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস! সেটা আবার ধরুন মাঝে মাঝে আপনার মাথায় ও উঠে যায়।
মাথা ঘুরছে আমার। সত্যি গ্যাস উঠে গেল নাকি মাথায় ?
হেসে ফেলতে হলো বাধ্য হয়ে।
৬. ইনি মধ্যবয়সী পুরুষ। হালকা করে নেশা করেন। লিভার একটু গড়বড় শুরু করেছে। কত বছর নেশা করেন জিজ্ঞেস করতেই – এই ধরুন দশ বারো বছর আপনার মদের নেশা।
– আচ্ছা !
মনে মনে বললাম – তুমি কোথাকার গোয়েন্দা যে আমার নেশার খবর নিয়ে বেড়াও? এখনো অব্দি কেউ বলতে পারলো না কত বছর নেশা করি!! হে হে হে
পেছন থেকে তাঁর বউ আরেক কাঠি উপরে- আপনার মদের নেশা তো আছেই। তার সাথে আপনার গুটখা খৈনি বিড়ি সব নেশা আছে। এবার আপনার লিভার খারাপ হবে না তো কি হবে!
আমি হতভম্ব। আমার যে এতো নেশা আছে আমি ই জানি না! আমি কি পুরো মাতাল হয়ে গেছি??
বললাম – হুম। তা যা বলেছেন। এতো নেশা!
হায় রে! এই ঘটনা আমার বাড়িতে জানলে ঘরেই ঢুকতে দেবে না!
৭. ইনি বছর পঞ্চাশের এক রোগী। বেশ কিছুদিন ধরেই মাথাব্যথা। একবার নাকি বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিল। তো স্ত্রী কোনরকমে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। এবং অন্য বিভাগের ডাক্তার আমাকে বলে রেখেছিল একে দেখার জন্য। সিটি স্ক্যান প্লেট দেখতে দেখতে কথা বলছি।
ভদ্রলোক চুপচাপ। মহিলাকে বললাম – বলুন কি সমস্যা?
– আর কি বলবো ডাক্তার! এই ছ’মাস ধরে আপনার বউ ছেলে মেয়ে কে চিনতে পারছে না!!
(ভাবলাম একবার বলেই ফেলি – আমি অন্যের বউ কে অন্ততঃ চিনতে পারি !!?)
তারপর ধরুন আপনার রাত্তিরে ঘুম হয় না। তারপর মাঝে মাঝে আপনার মাথাব্যাথায় এতো চিৎকার করেন – পাড়া পড়শি জমে যায়!
এ একটি দুঃখের কাহিনী। কথাটা কানে লাগলো বটে, হাসবো কি করে?
ভদ্রলোকের মাথার খুলির ভেতরে একটা ইয়া বড় টিউমার। সেটা চেপে বসেছে ব্রেনের সামনের দিকটায়। এমন রোগী আগেও পেয়েছি। ভবঘুরে বলে পেপার পত্রিকায় লেখালেখি ও হয়েছে এরকম রোগী নিয়ে।
মনে মনে বললাম – সত্যি এমন যেন না হয় আর কারো! আমার আপনার কারো নয় !
৮. একজন অবাঙালি ভদ্রলোক এসেছেন। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেন। বললাম – সমস্যা কি?
– ইয়ে লিজিয়ে আপনার পেপার।
নিলাম পুরানো চিকিৎসার কাগজ।
– হুম বলুন কতদিন সমস্যা?
– বহুত দিন ডাক্তার সাব। আপনার পিছে সে খুন নিকালতা হ্যায়।
আমি চমকে উঠলাম। সে কি রে বাবা! আমার পিছে কেউ জোঁক ঢোকায়নি তো আবার? বুঝলাম মুদ্রাদোষ ফের!
– তাজা খুন? দর্দ হোতা হ্যায়?
– হা ডাক্তার সাব। আপনার একদম তাজা খুন। অউর ও আপনার দর্দ ভি বহুত। কুছ বাহার ভি নিকাল যাতা হ্যায় আপনার।
আমার পিছে কেমন একটা অস্বস্তি হতে শুরু করে। খুন! দর্দ! কি বেরোচ্ছে? আর পারছি না !
শুনেই বুঝেছি আসলে অর্শ রোগের লক্ষণ এগুলো। অন্য কিছু আছে কিনা তাই সার্জেন পাঠিয়েছেন।
৯. এটা একটি বিখ্যাত ঘটনার পর ঘটেছিল এ ঘটনা। তখন হাসপাতালে ভর্তি হলেন একজন গুলিবিদ্ধ রুগী। আমরা ইন্টার্ন তখন। প্রাথমিক ইতিহাস কালেক্ট করতে হতো আমাদেরই। দাদাদের বা স্যারকে পড়ে বলতে হবে। ভয়ে ভয়ে গিয়েছি।
জিজ্ঞেস করলাম – কি করে হলো?
রোগী প্রায় অজ্ঞান। সাথে একজন আছেন। তিনি শুরু করলেন – সে আর কি বলবো। এই ধরুন আপনাকে প্রথমে পেছন থেকে লাথি মেরে ফেলে দিল। চার পাঁচ জন মিলে চোখ মুখ বেঁধে প্রচণ্ড …।তারপর মাঠের মধ্যে ফেলে আপনাকে ধরুন পা দিয়ে পাছায় মেরেছে।
(আমি শিউরে উঠছি আর ভাবছি আর ‘আপনাকে’ না বলে যেন! এই মারামারি জিনিসটা কোনদিন সহ্য হয় না!)
– হুম। লিখে রাখছি। তারপর কি হলো?
– তারপর ধরুন আপনার শ্বাস চলছে দেখে পুরো গলায় গুলি ….
মনে হলো একবার চিৎকার করে উঠি। কি নারকীয়! একটু জোরেই বললাম – আচ্ছা ঠিক আছে।
খানিকটা সময় লাগলো ধাতস্থ হতে। তারপর বুঝলাম – আমার এসবে রিঅ্যাকশন দেয়া মনে হয় ঠিক হয়নি। মাথা ফ্রেশ করতে হবে।
ডাক্তার হলে কত কি …
সিনিয়র দাদাকে গিয়ে ঠিক ওই ভাবেই কপি করে বললাম – সে আর কি বলবো। এই ধরুন আপনাকে প্রথমে পেছন থেকে লাথি মেরে ফেলে দিল …তারপর পাছায় …
(বলে রাখি, রোগীর ভাষায়ই আসল সমস্যাটা বলতে হতো আমাদের!)
সবাই হেসে ফেললো এটা জেনেও যে – কঠিন রোগী।
আমি একটু হালকা হলাম।
১০. আরো অনেকগুলো আছে। তবে এবার শেষ ঘটনা বলবো।
এই অল্প কিছুদিন আগের ঘটনা।একটি চব্বিশ বছরের মেয়ে, তাঁর মায়ের সাথে এসেছে ইউএসজি করাতে।
প্রেসক্রিপশন দেখলাম। গাইনিকোলজিস্ট polycystic ovarian disease সন্দেহ করে পাঠিয়েছেন।
আমি মেশিনে নাম বয়স ইত্যাদি লিখে রেডি করছি। সাথে সাথেই প্রশ্ন করলাম – সমস্যা কি?
মেয়েটা কিছু বলার আগেই মা বোমা মেরে শুরু করলেন- তা ডাক্তার বাবু, আপনার মাঝে মাঝেই মেনস হয় না!
(বলতে পারলাম না যে ওটা আমার কখনোই হয় না!!)
আমার যে এই ‘আপনার’ কথাটায় ঝটকাটা লেগেছে, সেটা যেন কেউ বুঝতেই পারেনি! মেয়েটা ও না! হয়তো সেও এমন শুনে শুনে অভ্যস্ত।
– তা কতদিন ধরে এমন চলছে?
– সে ডাক্তার বাবু, আপনার মাসিক শুরু হওয়ার পর কয়েক বছর ভালো ছিল। এখন আপনার বছর তিনেক ধরে মাঝে মাঝেই বন্ধ থাকে।
(ধুর বাবা ! আমার সবদিন ই …)
মেয়েটা চুপ করে আছে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললাম – আচ্ছা। আর কিছু সমস্যা হয়?
– হা হয়তো। এই ধরুন আপনার রাতে ঘুম হয় না!!
হুম! ফালতু কথা! কে ঘুমায় না কি করে, আমার মরার মত ঘুম দেখলে বুঝতে পারতেন ঘুম কাকে বলে!! ? অবশ্য যখন অন্য কারণে ঘুমাইনি, সেসব কথা বলতে খানিক শরমই লাগে!!
আজকাল একটা সমস্যা – হিন্দু ঘরের বিবাহিতারা ও অনেকেই শাঁখা সিঁদুর বা শাড়ি পড়েন না। ভালো কথা। কিন্ত আমাদের সমস্যা হয় – মাঝে মাঝে দেখে না বুঝতে পেরে সেটা জিজ্ঞেস করতে হয়।
যাঁর বিয়ে হয়নি, তেমন কেউ কেউ অফেণ্ডেড ও হন তাতে!
এবার বাচ্চা হবার না হবার ইতিহাস জানা আমাদের জরুরি হয়ে পড়ে কখনো কখনো। কোন অপারেশন হয়েছে কিনা সেটা ও জরুরি।
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম – বিয়ে হয়েছে?
মেয়ের মা মেয়েকে কথা বলতেই দেবেন না ঠিক করেছেন। এটা অনেক মাই করেন। সাধারণ বিষয়। তাঁদের কাছে ছেলে মেয়ে সবদিন বাচ্চাই!
– কি বলেন ডাক্তার বাবু ? আপনার পড়াশোনা চলছে তো! আপনার এখন ওসব বিয়ে বাচ্চা কি করে হবে ?
আমি চমকে উঠলাম! এই রে! বলে কি? পড়ালেখা তো কবে ডকে তুলে দিয়েছি! আর বিয়ে ও .. তবু বাচ্চা তো আমার কোনদিনই হবে না!! ?
কিন্ত এই মুদ্রাদোষের আঘাতে এবার একটু মাথা গরম হলো। বললাম- আপনি বাইরে বসুন। দরকার হলে ডেকে পাঠাবো।
মেয়েটাও যেন খানিকটা স্বস্তি পেল।
ইউএসজি করতে গিয়ে চমকে উঠলাম অন্য কারণে। সাধারণতঃ আমাদের দেশে এটা খুব কম হয় বলেই, আমাদের চমকে যেতে হয় বৈকি।
মেয়েটিকে বললাম – তুমি তো প্রেগন্যান্ট। জানতে না?
মেয়েটি এতোক্ষণে একটু সুযোগ পেয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলো। – ডাক্তার বাবু, এবার কি করা যাবে ? মা বাবা জানলে …
এই রকম সময়ে আমাদের সত্যি কিছু বলার থাকে না। বললাম – রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলো। এটা আজকাল বড় সমস্যা নয়। তুমি না চাইলে সরকারি হাসপাতালে নিয়ম মেনেই সবকিছু করা যায়। তবে সম্ভবতঃ বাবা মা বা গার্ডিয়ান হিসেবে কাউকে দরকার হয়। জেনে নিও।
ঘন্টাকয়েক পর বাড়ি ফিরবো। কাজ শেষ। হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। হঠাৎ সেই মেয়ের মা রিপোর্ট হাতে নিয়ে ঢুকলেন হন্তদন্ত হয়ে। বুঝলাম একটা প্রাথমিক শক খেয়েছেন।
এসেই চোয়াল শক্ত করে- আপনার এটা কি হলো ডাক্তার বাবু?
ওহ! আবার আপনার আপনার! আর আমার কি হবে রে বাবা? আপাতত মাথা ধরে আছে।
– কি হয়েছে বলুন?
– মানে … আপনার পেটে বাচ্চা কি করে হলো!
অজান্তেই নিজের পেটে হাত চলে যাচ্ছিল! ?
মনে হলো বলে ফেলি – আমার পেটে বাচ্চা নেই, আর এ জন্মে থাকারও কোন চান্স নেই!
শুধরানোর আশায় খানিকটা রেগেই বললাম- আপনার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করুন। রিপোর্ট পেয়েছেন তো! আসুন এবার!
মহিলা কতটা শক খেয়েছেন, কেন খেয়েছেন সেসব গবেষণা করা আমার কাজ নয়। কিন্তু এটা যে এখনো একটা সোশ্যাল ট্যাবু বা মারাত্মক চিন্তার বিষয় সেটা জানি। সমাজ এখনো এতো সহজে এসব মানতে পারে না।
ভদ্রমহিলা গেলেন না তবু। ফের বললেন- তা ডাক্তার বাবু, আপনার এই বাচ্চাটা নিয়ে এবার কি করবো আমি?
আমার বাচ্চা!! কি কেলেঙ্কারি!! বাড়িতে জানলে ডিভোর্স হবে তিন মিনিটের মধ্যে! আর লোকে জানলে তো … ?
এতো সিরিয়াস ব্যাপারে হেসেও ফেলতে পারি না। আবার তেমন কিছু বলা ও যায় না। কি ঝামেলা। অথচ পেটে যেন কেউ সুরসুরি দিচ্ছে!
– আপনার মেয়েকে সব বলে দিয়েছি! শুনে নিন।
মহিলা অতি দুশ্চিন্তায় কি বুঝলেন জানি না।
তবে বেশি পাত্তা দেব না বুঝেই হয়তো বললেন- ঠিক আছে ডাক্তার বাবু। আপনার বাচ্চাটা নষ্ট হলে হয়! হায় ভগবান!
আমি দেখলাম- তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি। ক’দিন আর আসবো না এখানে! না হলে হয়তো এসে বলবেন- ও ডাক্তার, দেখুন তো আপনার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে কিনা!! … ?
*************************
এই সব গল্পগুলো মাঝে মাঝে মনে পড়ে আর খুব হাসি পায়। তো এরকমই একবার একজনের সাথে এগুলো শেয়ার করছিলাম কাজের জায়গায়। অবসরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। পেট ফেটে যাচ্ছিল দু’জনেরই।
হঠাৎ একজন রোগীর বাড়ির লোক এসে বললো – ডাক্তারবাবু, আসুন জলদি।
বললাম- কি হয়েছে?
– আর বলবেন না! আপনার অণ্ডকোষ ফুলে গেছে!
কি বীভৎস দৃশ্য! আমি জানি না!!
– হুম। আর কিছু? বয়স কত? হেসে হেসে সত্যি ব্যাথা পেট করছে।
– সে আপনার সাত বছর হবে হয়তো!
– আচ্ছা! কি হয়েছে?
– ডাক্তার বলেছে আপনার হার্নিয়া হয়েছে।
এই রে! কবে থেকে? আমিই জানলাম না?
– বুঝেছি।
ইউএসজি করে বেরিয়েছি।
ভদ্রলোক এসে ধরলেন ফের। – তা আপনার ছেলেটার কি হয়েছে ডাক্তার বাবু?
আমার ছেলে!! হায় রে কপাল!
ভাবছি কি বলবো। আসলে অনেক বাচ্চাদের অণ্ডকোষ নিচে নামে না। কখনো কুঁচকিতে বা পেটের মধ্যে থেকে যায়। বাচ্চাটিরও সেটাই হয়েছে একদিকে। অন্যদিকে জল জমেছে। তেমন বড় সমস্যা নয়। অনেকের হয়।
দেখলাম এনার আজ মুদ্রাস্ফীতি করেই ছাড়বো। অভিনয় তো একটু আধটু জানি। মুখ গম্ভীর করে
বললাম- ধরুন আপনার একদিকে জল জমেছে।
আর একদিকে আপনার অণ্ডকোষ উপরে উঠে গেছে!
ভদ্রলোক ভাবলেন আমি ভুল বলেছি। বললেন – মানে আমার ছেলের তো?
– হ্যাঁ আপনার ছেলের! বারবার আপনার আপনার করছিলেন তো, তাই এভাবে বললাম!!