বয়স বড়জোর সাতাশ। তিন বাচ্চার মা।
আমার তিন মিনিটের আউটডোরের নড়বড়ে টুলে বসে চুপ রইলেন ক্ষণকাল।
পাশে দন্ডায়মান মা। শ্বাশুড়ি নয়, জন্মদাত্রী মা।
এক নাগাড়ে তিনিই বলে যাচ্ছিলেন রোগের বর্ণনা।
দুদিন বাদে বাদেই হাঁপায়।
কথা বললেও শোনে না, বুজলেন… পাঁচটার আগে স্নান করবে না ।
ঠাণ্ডা লাগবে না তো কি হবে!
উল্টে পাল্টে দেখছিলাম পুরোনো টিকিট।
লাস্ট ভিজিট দু হাজার বাইশ। তাঁর আগেরটা সতের সাল।
উপরে জ্বলজ্বল করে লেখা: পুওর কমপ্লায়েন্স।
ইনহেলার নাও, ঠিক ঠাক?
নেয় যে না সেটা বুকের আওয়াজ বলেই দিচ্ছে স্পষ্টই। কিন্তু তাঁর মুখে রা নেই।
গজ গজ করছেন মা।
আপনি এবার ঠিক করে লিখে দ্যান ডাক্তারবাবু। এখন আমার এইখানেই থাকবে। যেতে দেব না, শিগগিরই। ওরা কোনও চিকিৎসাই করায় না মেয়েটার..
ওরা, কারা সেটা না বোঝার কারণ নেই কোনও।
বিপি মাপতে মাপতে, ফুসফুস শুনতে শুনতে কানে আসে টুকরো টাকরা অভিযোগের সাতকাহন।
জামাই দেখেই না।
ওষুধ ও কিনে দেয় না ঠিকঠাক ।
বলে এসব নাকি কাজ না করার বাহানা।
ধান উঠেছে। এখন সেসব ঝাড়তে হবে কুলোর বাতাস মেরে।
এই শরীরে পারে?
টানের দোষ মেয়েটার…
মায়ের গজগজ কানে আসতে থাকে।
ধুলো, ধোঁয়া, ওসব ধানের গুঁড়ো টুরো একদম বারণ। বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
ইনহেলার নিতে হবে রোজ ।
আমি খস খস প্রেসক্রিপশন লিখি।
মেয়েটা চুপ করে বসে থাকে পুতুলের মত। যেন
তাঁর কিছু বলার নেই।
তাঁর নিজস্ব কিছু ইচ্ছেও নেই যেন ।
বিরক্ত লাগে।
কিছুটা রাগও।
রুগীর থেকে যদি বাড়ির লোক বকবক বেশি করে বরাবর আপত্তি আমার।
এতে রোগ বুজতে অসুবিধে হয়।
মরুগ্গে যাক।
তিন মিনিট পার পেশেন্টদ-এর ওপিডি-তে এত ভাবার সময় নেই ।
খচ খচ ওষুধ লিখে যখন গম্ভীর ভাবে নেক্সট বলব বলব ভাবছি তখনই মুখ খুললেন তিনি।
এই দাগগুলি ঠিক হবে বাবু?
কেমন যেন করুণ আর্তি।
অপাঙ্গে দেখি, দুই গাল ভর্তি মেচেতা, ডাক্তারি ভাষায় মেলাসমা।
যার বুক ভর্তি হাসফাঁস, যে কিনা মোটেও ইনহেলার নেয় না ঠিকঠাক, যার আস্থমা, সিওপিডির ঘরে পা ফেলেছে অ্যাদ্দিন, তাঁর কিনা চিন্তার কারণ অন্য কিছু নয়, নিখাদ মেচেতার দাগ!
রাগ, বিরক্তি, করুণা, হতাশা, নারীত্বের বোকামো টোকামো ইত্যাদি টিট্যাদি যখন হুরমুরচ্ছে মনে, তখনই, ঠিক তখনই,একটি অস্ফুট, মৃদু, প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে সে বলল: নইলে ও আর নেবে না বলে যে। ইনহেলার কিনে দেয় না। দাগগুলোতে বিচ্ছিরি লাগে…
চকিতে বাস্তবে ফিরি।
নিজের পৌরুষ, শিক্ষা, এতক্ষণের এলিটিসম ঝুরমুর ভেঙ্গে পড়ে লহমায়।
একজন ফিজিশিয়ান , শ্বাসকষ্টের রুগীর সামনে অসহায় বসে থাকে। স্থাণুবত।
কিসের ওষুধ লিখব এখন?
শ্বাসকষ্ট? ইনহেলার? না মেচেতার…
পার পেশেন্ট তিন মিনিটের সময় পার হয়ে যায় । নেক্সট বলতে ভুলে গেছি অনেক্ষণ…