শুধুমাত্র মঞ্চ বা রূপোলী পর্দার মার্কা মারা অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই অভিনয় করেন না। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে জীবনে কমবেশী অভিনয় করে চলতে হয়। দরিদ্র পরিবারের বাবা-মা ছেলেমেয়েকে ভালো রাখার জন্য আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে ভালো থাকার অভিনয় করে। আবার বহুগামী প্রেমিক বা প্রেমিকা সুচতুর অভিনয়ের মাধ্যমে একসঙ্গে একাধিক সম্পর্ক বজায় রাখে। এভাবে প্রতিদিন মঞ্চের বাইরেও জগতের প্রতিটি কোনায় ছোটবড় নাটক অভিনিত হয়ে চলে।
কারো পক্ষেই এত অসংখ্য নাটক ও তার কুশীলবের খবর রাখা সম্ভব নয়।
আমি চিকিৎসক। চিকিৎসাজগতের অভিনয়ের কিছু কিছু খবর রাখি। রোগীর চিকিৎসা সফলভাবে সম্পন্ন করতে, রোগীকে চিকিৎসায় রাজি করাতে বা অসন্তুষ্ট রোগী বা হিংস্র পরিজন দের আক্রমন থেকে বাঁচতে অনেক সময়েই চিকিৎসা কর্মীকে অভিনয় শৈলী প্রদর্শন করতে হয়। আবার অনেক সময় উল্টোটাও ঘটে। সুস্থ মানুষ রোগীর অভিনয় করে।
অভিনয়-১
অনেক অনেক বছর আগে আমি তখন মেডিক্যাল কলেজে অর্থোপেডিক্সের স্নাতকোত্তর ছাত্র। এমন সময় আমার স্কুলের এক প্রাক্তন শিক্ষক পা ভেঙে আমার তৎকালীন অর্থোপেডিক্সের শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ভর্তি হলেন। মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসককে যে ছাত্র-ছাত্রী পড়ানোর পাশাপাশি রোগীর চিকিৎসাও করতে হয়, অর্থ্যাৎ একই বেতনে দুটো কাজ করতে হয় – বেশীরভাগ সাধারণ মানুষের মত আমার স্কুলজীবনের সেই প্রাক্তন শিক্ষকও সেটা জানতেন না। জেনে অবাক হলেন এবং তাঁর বদ্ধমূল ধারণা জন্মালো যে এই ডাক্তাররা কিছুতেই তাঁর পায়ের অস্ত্রোপচার ভালো ভাবে করতে পারবে না। ডেভিড হেয়ার ব্লকের কেবিনের বন্ধ দরজার পেছনে একথা-সেকথার সাথে সেটা আমাকে বলেও ফেললেন। কিন্তু এছাড়া তাঁর আর কোনো উপায়ও ছিল না। ডেভিড হেয়ার ব্লকের সেই কেবিনের তুলনীয় রাজসিক ব্যবস্থা সেই যুগে বেসরকারী ক্ষেত্রে পাওয়া যেত বেলভিউ, উডল্যান্ড, ক্যালকাটা হসপিটাল আর পিয়ারলেসে। সেসব হাসপাতাল তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সুতরাং বিরস মুখে তিনি তৎকালীন ব্যবস্থা মেনে নিলেন। মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকরাই তাঁর অপারেশন করলেন। কালক্রমে তাঁর সেলাই শুকিয়ে গেল, হাড় জুড়ে গেল। তিনি ভালোও হয়ে গেলেন।
আসল ঘটনা শুরু হল এরপর। অপারেশন করা গোড়ালি নিয়ে দু-কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে তিনি স্কুলে যেতে থাকলেন। কিন্তু সঙ্গে থাকত বেশ সুন্দর হাতলের কারুকার্য করা কাঠের একটা লাঠি। স্কুলে তিনি সাইকেল থেকে নেমে লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘পা ভেঙে গেছে তো, তাই খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে।’
তিনি ছ’মাস বাদে মেডিক্যাল কলেজের আউটডোরে একবার চেক আপে আসতে আমি বললাম, ‘আপনার গোড়ালি তো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। হাড় ঠিকভাবে জুড়ে গেছে। কোনো ব্যথা নেই। গোড়ালি আগের মতই ভাঁজ-সোজা হচ্ছে। উবু হয়ে, আসনপিঁড়ি করে বসতে পারছেন- তাহলে লাঠি নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন কেন?’
‘বুঝলি না? এটা করলে স্কুলে কাজকর্ম কম দেয়। সিঁড়ি ভাঙতে হয় না। দোতলায় ক্লাস নিতে যেতে হয় না। তাছাড়া পাড়ায়, রাস্তায়, সংগঠনে বেশ খাতির পাওয়া যায়।’
‘সে কি? আপনি তো সুস্থ!’
কিন্তু তিনি আমার কথা শোনার মত মানসিকতায় ছিলেন না। বছরের পর বছর তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটার অভিনয় চালিয়ে গেলেন। আর আমি যতদিন ছাত্রাবস্থায় মেডিক্যাল কলেজে ছিলাম- আমার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, অন্যান্য শিক্ষক, বন্বুবান্ধব, পরিচিত জনের মুখে শুনে গেলাম, ‘মেডিক্যাল কলেজে তোরা যে কী অপারেশন করলি, স্যার তো পুরো খোঁড়া হয়ে গেল !’
‘মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তাররা স্যারকে তো পঙ্গু করে দিল!’
এদিকে স্যার তখন কিন্তু নিজের বাড়িতে কোনো লাঠি বা সাহায্য ছাড়াই একতলা-দোতলা করছেন। আমি নিজের চোখে তা দেখে এসেছি। তখন মোবাইল ফোনও ছিল না। ডিডিও-ও এখনকার মত এত সহজ ছিল না। নয়তো ওনার বাড়িতে ওনার চলাফেরার ডিডিও তুলে সবাইকে দেখাতাম।
এসব ক্ষেত্রে ভিডিও খুব সহায়ক হয়। সেকথায় এবার আসব।
অভিনয়-২
পরের ঘটনাটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা নয়। অন্যের মুখে শোনা। মেডিক্যাল কলেজের এক প্রাক্তন ছাত্র বিদেশে বিরাট প্রতিষ্ঠিত। অনেক বছর আমেরিকায় আছেন। ইদানিং বয়স হওয়াতে সার্জারি কমিয়ে দিয়ে ডাক্তারি আইনের পরামর্শদাতার কাজও করছেন। তিনি আমাকে তাঁর সমাধান করা একটি কেসের গল্প বললেন। অবশ্যই নাম-পরিচয় বাদ দিয়ে।
আমেরিকায় একজন অর্থোপেডিক সার্জেন মধ্যবয়সী এক একাকী মহিলার পায়ে অপারেশন করেছেন।
অপারেশন ভালো হয়েছে। এক্সরে ইত্যাদি একদম ঠিকঠাক দেখাচ্ছে। কিন্তু রোগীর বক্তব্য, তিনি ভালো নেই। তাঁর ব্যাথা রয়েছে, পা ছোট হয়ে গেছে এবং তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। তিনি ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আদালতে মামলা করলেন। আমেরিকায় যা হয়। বিশাল অংকের মামলা। কয়েক মিলিয়ন ডলারের। আদালতে প্রমাণ হল যে, তাঁর পা আদৌ ছোটো হয় নি। কিন্তু রোগীর ব্যাথা আছে এবং তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। তাই আদালত চিকিৎসককে দোষী সাব্যস্ত করে কয়েক মিলিয়ন ডলার জরিমানা করল। জরিমানা দিতে গিয়ে ডাক্তারকে বাড়িঘর বেচতে হবে এমন অবস্থা। তিনি উচ্চতর আদালতে আপিল করলেন এবং আমেরিকা প্রবাসী আমাদের এই বাঙালি সার্জেনের স্মরণাপন্ন হলেন। তিনি আদতে হাড়ের ডাক্তার। মেডিকো-লিগ্যাল বিশেষজ্ঞ হয়েছেন পরে। রোগিণীকে দেখে এবং কাগজপত্র, রিপোর্ট পড়ে তিনি বুঝতে পারলেন যে- রোগিণীর অভিযোগটি পুরোপুরি ভুয়ো। কিন্তু তিনি তা আদালতে প্রমাণ করবেন কি করে? রোগিণী তো আদালতে ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। ব্যথা একটা নৈবর্তিক বিষয়। কারো ব্যথা আছে কি নেই- তা প্রমাণ করা খুবই কঠিন। তাছাড়া রোগী হলেন উপভোক্তা। তদুপরি তিনি মহিলা এবং একলা মানুষ। আদালতের সহানুভুতি তার দিকেই থাকবে।
তখন আমাদের এই মেডিকো-লিগ্যাল বিশেষজ্ঞ সার্জেন বিষয়টা সমাধানের জন্য এক বেসরকারী গোয়েন্দা নিয়োগ করলেন। রোগিণী যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনবধানে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করে গাড়ির পিছনে গিয়ে জিনিসপত্র তুলছেন – গোয়েন্দা লুকিয়ে থেকে তার ভিডিও তুলে আদালতে পেশ করলেন। ভিডিওতে রোগীর হাঁটাচলা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তিনি ভারি জিনিসপত্র অবলীলায় গাড়িতে তুলছেন। কোনো ব্যাথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। ভিডিওটি দেখে আদালত অনুসন্ধান কমিটি বসাল। রোগিণীর কেস তো খারিজ হলই। উল্টে তার বিরাট অংকের জরিমানাও হল।