জীবনের বিভিন্ন স্বাদ। জিভেরও। টক-ঝাল-মিষ্টি-তেতো। জিভের উপরতলে সব স্বাদেরই স্বাদকোরক থাকে। জীবনের দীর্ঘ পথেও সব স্বাদেরই অভিজ্ঞতা হয়। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি। কখনো ধ্বংস, কখনো সৃষ্টি। কিন্তু বেশীরভাগ মানুষ শুধু একধরনের স্বাদই মূলতঃ পছন্দ করে- মিষ্টি। তবে ব্যতিক্রমও আছে। যেমন টক ও ঝাল-ও কেউ কেউ ভালবাসে বটে। তবে তেতো প্রায় কেউই পছন্দ করে না।
তেমনই সবাই পছন্দ করে সৃষ্টি। ধ্বংস শুনলেই সকলে আমরা শিউরে উঠি। এই রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে – একথা শুনলেই পরিবার খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে স্বাস্থকর্মীদের ওপর। সেই স্বাস্থ্যকর্মী চিকিৎসক বা নার্স হলে তো কথাই নেই। তিনি তখন ভগ্নদূত। অথবা গণশত্রু। আর সত্যি সত্যি মৃত্যু ঘটলে তো কথাই নেই। স্বাস্থ্যকর্মীরাই যেন খুনী। মারামারি, খুনোখুনি, বিষ্ঠালেপন, ধর্ষণের হুমকি, চিকিৎসকের এবং তার পরিবারের উপর গণ অত্যাচার।
যেন চিকিৎসা না হলে বা স্বাস্থ্যকর্মী না ছুঁলে সব মানুষ অমর হয়ে থাকত! একবার কেউ ভেবে দেখে না শরীরের ধ্বংস এবং মৃত্যু না থাকলে জগৎটাই ধ্বংস হয়ে যেত। নটরাজের প্রলয় নৃত্য হ’ত না। বিগ ব্যাং এবং মহাসংকোচন তত্ত্ব আসত না। বিগ ব্যাং, মহা প্রসারণ, ছায়াপথ, আলফা সেঞ্চাউরি, সৌরজগৎ, গলন্ত লাভাও গ্যাসের তৈরী পৃথিবী, জলের সৃষ্টি, জীবন বিক্রিয়া, এককোষী জলজ জীব, স্থল, উভচর সরীসৃপ, স্থলচর জীব, ডায়নোসর, ম্যামথ, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, নিয়ানডারথাল, অষ্ট্রালোপিথেকাস। শেষে হোমো স্যিপিয়েন্স- এরপর? যেতে তো হবেই বন্ধুগণ!!! ডাইনোসর গেছে, ম্যামথ গেছে, নিয়ানডারথাল গেছে- তুমি কে হে? এরপরেই কি মহাসংকোচন? কে জানে!
মৃত্যু আর ধ্বংসের অবশ্যম্ভাবিতা বোঝাতে অনেক বৃহৎ ক্ষেত্রে চলে এলাম।
অত বৃহৎ ভাবনা আমার মত সাধারণ চিকিৎসকের জন্য নয়। আমার ছোট ছোট ভাবনা। ছোট ছোট ঘটনা বা গল্প।
১
প্রথম গল্প
তেতো
কাট-১
সাত-আট বছর আগেকার কথা। এক অতি বৃদ্ধা মহিলা অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে, ট্রলিতে শুয়ে এসেছেন আমার চেম্বারে। ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি মিলিয়ে সঙ্গে অন্তঃত ন’জন। বাড়িতে ফুল পাড়তে গিয়ে পড়ে গিয়ে বৃদ্ধার হিপ জয়েন্টের বল (femoral neck) এবং কাঁধের হাড় ভেঙ্গে গেছে। বৃদ্ধা ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। তবে কাঁদবেন কি- তার থেকে অনেক জোরে কাঁদছে তাঁর ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনি-রা। যদি কিছু হয়ে যায়! স্বাভাবিক ঘটনা।
অস্বাভাবিক লাগলো তাদের বক্তব্য। ‘আমার মা-কে আপনি বাঁচিয়ে রাখুন ডাক্তারবাবু।’
‘চেষ্টা করব।’
‘চেষ্টা না, চেষ্টা না। আমাদের মা-কে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে চিরদিন।’
‘চিরদিন!!!’
ভাবলাম বলি, ‘মিশর বা মেক্সিকো থেকে ভালো এক্সপার্ট আনুন। মমি করিয়ে রাখুন।’
তাতো আর মুখে বলা যায় না। ভদ্রতায় এবং ডাক্তারি এথিকস-এ বাধে। তাই বললাম, ‘আসলে ওনার তো অনেক বয়স হয়েছে। তাছাড়া প্রেশার, হার্ট, কিডনি- প্রায় কোনো রোগ বাকি নেই। সোডিয়ামটাও নড়বড় করছে। শুধু সুগার লেভেলটা ভালো আছে। এমন অবস্থায় অপারেশন করতে হবে- বুঝতে পারেন তো!’
এক ছেলে বেশ এক রোখা হয়ে বলল, ‘ক্যানো? অপারেশন করতে হবে ক্যানো? প্লাস্টারে হবে না?’
এদের পরিবারকে আমি জানি। সাবেকি হার্ডওয়্যারের ব্যবসা আছে এদের। এদের ব্যবহারও খানিক লোহার পাইপ, লোহার শেকল, টিউবকল -এর মাথার মতই নীরস এবং নিরেট। এদের চিকিৎসার জটিল বিষয় বোঝানো খুব কঠিন। তবু বললাম, ‘হিপ জয়েন্টের হাড় বলের নীচ থেকে ভেঙে গেছে। এই বয়সে ওই হাড় সাধারণতঃ জোড়ে না। বলটা ফেলে দিয়ে কৃত্রিম জয়েন্ট লাগাতে হবে। একে বলে হিপ রিপ্লেশমেন্ট। অপারেশন না করলে রোগী আর কখনো দাঁড়াতে পারবে না। দাঁড়াতে আর হাঁটতে না পারলে এই বয়স্ক রোগীর বেড সোর হয়ে যাবে। সর্দি জমে বুকে ইনফেকশন হতে থাকবে। তবে এই অপারেশন অজ্ঞান বা অবশ করে করতে হবে। ওনার ক্ষেত্রে সেটা বেশ রিস্ক।’
কি বুঝল কে জানে! বলল, ‘আচ্ছা, দেখছি।’
বাইরে থেকে আর একটা দাদা গোছের লোক এসে বলল, ‘দাক্তাবাবু, ওপারেশন তো বলচেন। এত টাকা খচ্চা হবে। মার পা ঠিক হবে তো? গ্রান্টি?’
দেখলাম মুশকিল, ট্যারাব্যাঁকা লোকজন। বুঝলাম মেডিক্যাল হোষ্টেলের ভাষায় এবার ধোনি বা গিলক্রিষ্টের মত চওড়া ব্যাট নিয়ে মাঠে নামতে হবে! ‘গ্যারান্টি?!! কিসের গ্যারান্টি? মানুষ কি ফ্রিজ বা টিভি নাকি যে, খারাপ হয়ে গেলে বদলে দেওয়া যাবে? ভালো করারই চেষ্টা করব আমার জ্ঞান-বুদ্ধি আর টেকনিক দিয়ে। আন্তরিক ভাবে। কিন্তু খারাপ হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে। আর আপনি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবেন যে আমি আজ চেম্বার থেকে বাড়ি ফিরতে পারব?’
‘আপনার? কেন, আপনার আবার কি হতে পারে?’
‘এই চেম্বারেই মাথার উপর ছাদ ভেঙে পড়তে পারে। বাড়ি যাওয়ার পথে রাস্তায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করতে পারে। আরো কত কি হতে পারে- কে বলতে পারে?’
লোকটা মাথা চুলকে বলল, ‘তাহলে তো খুব ঝামেলা দেখছি। ঠিকাছে, আপনি যা পারেন করেন।’
‘আমি যা পারি করলেই হবে না। এই হাসপাতালে একটা নামকে ওয়াস্তে আইসিইউ, আর একটা ডায়ালিসিস আছে। খুব ভালো ইনটেনসিভ কেয়ার নেই। কলকাতার বড় হাসপাতালে নিয়ে গেলেই ভালো।’
‘ক্যানো, কলকাতায় ক্যানো?’
‘আমি তো এখানে অপারেশন করে দেব না হয়। তারপর হার্ট,কিডনি এসব খারাপ হলে কে সামলাবে? এখানে তো ওসবের ডাক্তার সব সময় পাওয়া যাবে না।’
‘আচ্ছা, কথা বলি।’
‘বলুন।’
কাট-২
প্রায় ঘন্টাখানেক অন্য রোগী দেখার পর আবার সেই দলের উদয় হল। ‘আপনিই যা পারেন করে দিন, ডাক্তারবাবু। আমাদের অতদূরে নিয়ে অপারেশন করানোর মত লোকবল নেই।’
‘কিন্তু রোগীকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখার মত বীজমন্ত্র কিন্তু আমি জানি না।’
‘ঠিক আছে। রোগীর অনেক বয়স হয়েছে। নব্বই পার হয়ে গেছে। আপনি চেষ্টা করুন। যাই ঘটুক আমরা মেনে নেব।’
অপারেশন হল। ভালই হল। আরো প্রায় চার-পাঁচ বছর রোগী ড্যাং-ড্যাং করে চলাফেরা করে বেঁচে রইলেন।
২
দ্বিতীয় গল্প
টক
আর এক রোগী। তার মেরুদন্ডে অপারেশন হয়ে গেছে। চামড়ার কাটা শুকিয়ে গেছে। স্কিন-স্টেপল বের করে দেওয়া হয়েছে। দেখাতে এসেছে।
রোগীর স্ত্রী বললেন, ‘এবার সবকিছু খেতে পারবে তো, ডাক্তারবাবু।’
‘হ্যাঁ। টক খেতে পারবে।’
‘টকও খেতে পারবে?’
‘কেন, টক খেতে সমস্যা কোথায়?’
‘টক খেলে তো ঘা শুকোয় না, সবাই বলে। তাই। এখন তো ঘা শুকিয়ে গেছে- তাই জিজ্ঞেস করছিলাম- টক খাওয়া যাবে কি না?’
এইসব কথা আমি বাঙালিদের মুখে গত তিরিশ বছর ধরে শুনে আসছি। ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। বেশীরভাগ প্রকৃতির টক ফল ও সব্জীতে ভিটামিন-সি প্রচুর পরিমাণে আছে এবং ঘা শুকানো ও হাড় জোড়ানোর জন্য ভিটামিন-সি দরকার। ভিটামিন-সি প্রোলিন ও লাইসিন নামক অ্যামিনো অ্যাসিড দুটোকে হাইড্রক্সিলেশন করিয়ে কোলাজেন নামক প্রোটিন তৈরী করে। আর ঘা শুকোনো আর হাড় জোড়ার প্রাথমিক কাজ কোলাজেন দিয়েই শুরু হয়। সুতরাং ঘা শুকোনো আর হাড় জোড়ানোর জন্য টক বেশী করে খাওয়া দরকার। অথচ বাঙালিরা ঠিক উল্টোটাই করে।
আগে এসব কথা শুনলে খুব রাগ হত। আজকাল আর হয় না। এখন ঠান্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করি। কতটা বোঝে জানি না! প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মনে গেঁথে যাওয়া গোঁড়া ধারণা দূর করা খুব কঠিন।
বললাম, ‘টক খেলে ঘা শুকোয় না- এই কথাগুলো কে বা কারা বলে?’
‘সবাই বলে।’
‘সবাই মানে- বন্ধু- বান্ধব, পাড়ার লোক, ঠাকুমা-দিদিমা, মা-মাসী? তারা কি বিষয়টা জেনে-বুঝে বলে? না কি আপনার মত্যই অন্যের থেকে শুনে বলে?’
তখন তাকে বিষয়টা বোঝালাম। কতটা বুঝল জানি না। কিন্তু বলল, ‘তাহলো তো আমরা ভুল জানি এবং করি।’
এইটা যে স্বীকার করল এবং ভাবল- এটুকুই লাভ।
নীচে রইল রেফারেন্স-
1. Hart A, Cota A, Makhdom A, Harvey EJ. The Role of Vitamin C in Orthopedic Trauma and Bone Health. Am J Orthop (Belle Mead NJ). 2015 Jul;44(7):306-11. PMID: 26161758.
2.Thevi, T., Abas, A.L. & Rajan, M. The Effects of Vitamin C on Wound Healing—Systematic Review. Indian J Surg (2023). https://doi.org/10.1007/s12262-023-03750-y
৩
তৃতীয় গল্প
মধুরেণ সমাপয়েৎ
সব শেষে একটা মিষ্টি গল্প বলি। ঝুম্পা নাথ (নাম পরিবর্তিত) নৈহাটির মেয়ে। আমার আত্মীয়া নয়- পুরোনো রোগী। মেরুদন্ডে স্লিপ ডিস্ক নিয়ে এসেছিল। ২০১১ সালে তার উনিশ বছর বয়সে তার মাইক্রো-ডিস্কেকটমি অপারেশন করি। ভালো হয়ে যায়।
কিন্তু তারপরেও প্রায় বছর বছর সে আসে। কখনো দাদাকে, কখনো বন্ধুকে, কখনো বাবাকে দেখাতে। আর প্রতিবার এসে আমাকে বকাঝকা করে। ‘আপনি মোটা হয়ে যাচ্ছেন।’ ‘আপনার চুল পেকে যাচ্ছে।’
কোভিডের মধ্যে অনলাইন কন্সাল্টেশনে বলল, ‘আপনি খুব রোগা হয়ে গেছেন।’
বললাম, ‘কি করব রে? কোভিড হয়ে একেবারে টেঁসে যাচ্ছিলাম যে! বেঁচে ফিরেছি- এই অনেক!’
‘ওসব অলুক্ষুণে কথা একদম বলবেন না। আপনার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হত!’
‘কি আবার হত, আরেকটা ডাক্তার খুঁজে নিতিস।’
বিয়ে করে সে এখন বড় গিন্নী। দু-বছর আগে তার স্বামীর পায়ে অপারেশন করলাম।
গত শুক্রবারে দেখি সে আবার এসেছে। বাইরে ওয়েটিং রুমে বসে আছে। ‘তাড়াতাড়ি দেখে দিন। কতদূর যাব জানেন তো !’
‘তোর আগে কত লোক বসে আছে। তোকে আগে দেখে দিলে তারা ছাড়বে আমাকে?’
কিছুক্ষণ পরে ভেতরে এল। হাতে আমারই লেখা গোয়েন্দা সংকলন, ‘গোয়েন্দা দম্পতির ডায়েরি।’
‘এই বই কে দিল?’
‘কে আবার দেবে? কিনলাম।’
‘এবারে আবার কি হয়েছে, বল।’
‘হাঁটুতে ব্যথা।’
তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘গল্প গুলো তো বেশ ভালো লিখেছেন। কিন্তু এতো বানান আর ছাপার ভুল কেন?’
‘পাবলিশার লাষ্ট প্রুফটা না দেখিয়েই ছাপিয়ে দিয়েছে। আমিও আর ব্যস্ততার মধ্যে দেখে উঠতে পারি নি।’
‘হ্যাঁ। সবকিছু পাবলিশারের দোষ! ডাক্তারি করতে করতে বাংলা ভুলে গেছেন- আর খালি অন্যের দোষ! পরের বার আমাকে বলবেন। আমি দেখে দেব।’
‘পয়সা নিবি, না কি ফ্রী সার্ভিস?’
‘ফ্রী না। আমার বাড়িতে আসতে হবে।”
সঙ্গে সঙ্গে ওর স্বামী বলল, ‘অনেক বার বলেছি-আসেন নি। এবারে নৈহাটি আসতেই হবে।’
ঝুম্পা বলল, ‘নৈহাটিতে আমাদের বাড়িতে আসবে কেন? নিজের দাদার বাড়িতে আসবে!’
ছুঁড়ি সব খবর রাখে!