বিভিন্ন অঞ্চলে একই রোগের রোগীদের, আর্থিক- সামাজিক- সাংস্কৃতিক- ভাষাগত- পেশাগত চরিত্র আলাদা হয়।
সাগরদিঘী-র এক গ্রাম্য বৃদ্ধার হাঁটু ব্যথা আর বালিগঞ্জের সুউচ্চ বহুতল বাসিনী মাঝবয়সী স্যোসালাইট মহিলার হাঁটুতে ব্যথা কি এক হতে পারে?
হ্যাঁ, এই দুই রোগিণীর রোগ এক। অষ্টিওআর্থ্রাইটিস অর্থ্যাৎ বাত। কিন্তু, এদের উৎপত্তির কারণ অনেকটা এক হলেও সবক্ষেত্রে একেবারে সমান নয়। প্যাথোফিজিওলজি এক হলেও রোগের গতিপ্রকৃতি, রোগীর জীবনশৈলী, চিকিৎসার ধরণ, চিকিৎসা নেওয়ার আর্থিক ও শারীরিক ক্ষমতা- এক হয় না।
ব্যথা সহ্য করার, মোকাবিলা করার মানসিকতা, দৃঢ়তা তো এক-এক জনের এক এক রকম হয়। আজকাল বলা হচ্ছে, যে কোনো পুরনো ব্যথা নিজেই একটা রোগ- শুধুমাত্র রোগের এক উপসর্গ মাত্র নয়।
এক-একজন রোগী সামান্য ব্যথাতেই প্রবল কাতর এয়ে পড়ে। তীব্র অবসাদ। মৃত্যু যেন একেবারে শিয়রে। কেউ কেউ রোগ হওয়ার অপেক্ষা না করে, আগে থেকেই বিভিন্ন কর্পোরেট মেডিক্যাল চেক আপের বলে বলীয়ান হয়ে রোগকে ধাওয়া করতে থাকে।
আবার গ্রাম্য ও দরিদ্র মানুষ দুবেলা খাবার জোগাড়ের পরিশ্রমে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, পেটে আলসার, ক্যান্সারের মত মারণব্যাধিই শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াতে বাধ্য হয়। সেখানে তাদের পক্ষে ছোটখাটো রোগব্যাধি ও ব্যথা কে পাত্তা ও গুরুত্ব দেওয়া সম্ভবই নয়।
এইসব কম গুরুত্ত্বপূর্ণ রোগব্যাধি গুলো জমতে থাকে, জমতেই থাকে। হাঁটু বেঁকে যায়। পিঠ বেঁকে যায়। পুরনো ব্যথা পুরাতনতর হয়ে অবসাদে ঢাকে। তবুও চিকিৎসার সুযোগ আসে না অনেক ক্ষেত্রেই।
উচ্চবিত্ত মধ্যবয়সী গাড়ীর ক্লাচ চাপতে বাঁ হাঁটুতে ব্যথা হলেই হাঁটু বদলানোর জন্য দৌড়য় চেন্নাই বা বেঙ্গালুরু। অথচ, বাদুড়িয়ার সত্তরের বৃদ্ধা ভাঙা কোমরের ব্যথা নিয়ে উবু হয়ে কাঠের উনুনে ধানসেদ্ধ করেই চলে। না করলে সারা বছরের চাল জুটবে না যে! ধানসেদ্ধ তো আর চেয়ারে বসে করা যায় না!
খাদ্যে অসাম্যের পরই পৃথিবীতে স্বাস্থ্যে অসাম্য কিন্তু ফল্গু ধারার মত বয়ে চলে।
অনেক গম্ভীর গম্ভীর কথা লিখে ফেললাম। এবার একটু হাল্কা চালের গল্প বলি।
গল্গ এক- সুইচ বদল
যেসব চিকিৎসকরা একই ভৌগলিক ও আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে আবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন জায়গায় প্র্যাকটিস করতে বাধ্য হয়- তাদের জীবনে অনেক মজার গল্পও তৈরী হয়।
মফঃস্বলের এক ছোট খুপরিতে রোগী দেখছি। রোগী আমার পুরোনো পরিচিত। তার মেরুদন্ডে যক্ষ্মার জন্য অপারেশন করেছিলাম। সে এখন অনেক ভালো আছে- তবু সুযোগ পেলেই ক্ষেতের কলাটা-মুলোটা, পুকুরের মাছটা দিতে আসে।
সে কথা বলছে। ইতিমধ্যে আমার মোবাইলে একটা ফোন এল, ‘ডক্টর সাব, আপকো এক ফর্ম ফিলাপ করনা হোগা।’
‘কিসকা ফর্ম?
‘মেডিক্লেম কা ফর্ম।’
‘আচ্ছা, এক কাম কিজিয়ে, আপ চার বাজে মেরা আউটডোর পে আনা।’
‘ম্যায় আভি আপকা আউটডোরকে সামনে বৈঠে হুয়ে হ্যায়।’
‘মরেচে!’
‘ক্যায়া বাতায়া স্যার?’
‘কুছ নেহী, কুছ নহী। আপ থোড়ি দের কে লিয়ে রুক জাইয়ে। ম্যায় জলদি হি আ রহা হুঁ।’
ফোন ছেড়ে সামনে বসে থাকা রোগীর দিকে তাকালাম। ‘আপকা ক্যায়া প্রবলেম?’
সে এতক্ষণ আমার দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে ছিল আর ফোনে আমার হিন্দিতে বাক্যালাপ শুনছিল। এবারে আমার হিন্দি প্রশ্নে তার হাঁ আরো বড় হয়ে গেল। ‘মা-মানে?’
আমিও থমকে গেলাম। এবার আমারও সুইচ বদল-টা ঠিকমতো হয় নি! সাধারণতঃ এরকম হয় না।
‘আপনার টিবির ওষুধ তো বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘হ্যাঁ।’
‘কন তো, কবে থেকি গাছে উঠতি পারব?’
‘কেন, গাছে উঠবেন কেন?’
‘না উঠলি খাব কি?’
তখন মনে পড়ল, এই লোকটা হল ‘গাছি’। খেজুর, তাল, সুপুরি, নারকেল – এইসব গাছের মাথা পরিস্কার করা, শীতকালে খেজুর রসের সময় গাছের মাথার নীচে চিরে স্যাপ লাগানো- এই এর পেশা।
‘সে এত তাড়াতাড়ি হবে না। আরো ছয় মাস দেরী হবে।’
এবারও সুইচ বদলটা মসৃণ হল না।
তখন নব্বইয়ের শেষদিক। আমরা ক’জন অর্থোপেডিক পোষ্টগ্রাজুয়েট ছাত্র কলকাতার হোষ্টেল থেকে মাঝেমধ্যে আধুনিক অর্থোপেডিক্স শিখতে ডাঃ শৈলেন ভট্টাচার্যের রাজারহাট- নারায়ণপুরের হাসপাতালে যেতাম। রাজারহাট তখন ঘুমন্ত গন্ডগ্রাম। স্যারের হাসপাতালে ধানক্ষেত, গরুর গোয়াল। স্যার বলতেন, ‘বুঝলে, সব-ধরণের রোগীকূলের চিকিৎসা একসাথে করা যায় না। সারা জীবন কলকাতায় প্রাকটিস করলাম। ওদের জন্য অনেক করেছি। তাই এখন হ্যারিংটনের পশ চেম্বার ছেড়ে শেষ বয়সে এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে হাসপাতাল করছি।’
কিন্তু, ডাঃ ভট্টাচার্য্য প্রবাদপ্রতিম মানুষ ছিলেন। তাঁর পক্ষেই সেভাবে একদিকের প্র্যাকটিস ছেড়ে আসা সম্ভব ছিল। সবাই ওঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে না।
গল্প দুই- ওয়ার্ক ফ্রম বেড
গতদিন নিউটাউনের চেম্বারে আটজন রোগী। তার মধ্যে ছয়জন আই টি বা কম্পিউটার সংক্রান্ত কাজ করেন। সকলের সমস্যাই এক ধরণের। কারো ঘাড়ে ব্যথা, কারো পিঠে বা কোমরে ব্যথা। এইসব রোগী দেখা ভাবনা চিন্তার খোরাক জোগায় না।
এমনই একজন রোগীর বেখাপ্পা উচ্চতা। প্রায় ছয় ফুট তিন ইঞ্চি। অফিস বা বাড়ির আসবাবগুলো তো সব গড় উচ্চতার হয়! সুতরাং এই রোগীকে কম্পিউটারের উপর প্রায় ঝুঁকে পড়ে কাজ করতে হয়। এভাবে করে করে তার স্লিপ ডিস্ক হয়েছে।
সব শেষে এল বছর পঁচিশের এক তরুণী। রোগা, জিমচর্চিত, একদিকে কাৎ। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনমতে চলন।
‘এ কি? কবে থেকে এই অবস্থা?’
মেয়েটির মা ব্যথাতুর গলায় বলল, ‘তিনদিন।’
‘কোমরে ব্যথার সঙ্গে পায়েও কি ব্যথা হচ্ছে?’
‘না।’
‘কোন চোট লেগেছিল?’
মেয়েটির বাবা বলল, ‘না না, ওসব কিছু হয় নি। আপনি ভাল করে একটু দেখুন। মেয়েটা একেবারেই সোজা হতে পারছে না।’
পরীক্ষা করে দেখছিলাম। কিন্তু জানি এই সব আই টি রোগীদের কোমরে ব্যথার কারণ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এক।
‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম?’
‘হ্যাঁ’
সারাদিন ঘরে, সোফায়, বিছানায় শুয়ে, বসে অস্বাভাবিক পজিশনে ল্যাপটপ কম্পিউটারে অফিসের কাজ। কাজের সময়ের ঠিক-ঠিকানা নেই। কখনো রাত দশটা, কখনো বারোটা অবধি। চুড়ান্ত শোষণ। দু-দশক আগেও এই ধরণের রোগ ও রোগী অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু এখন চরম বাস্তব।
মেয়েটির মা বলল, ‘হবে না? সকাল থেকে সারাদিন বিছানায় শুয়ে লেপের উপর ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করবে। ব্যথার আর দোষ কি? সকালে সময়মত দাঁতও মাজে না!’
আৎকে উঠলাম, ‘এই গরম কালে লেপ?!’
‘সারা বছর লেপ। ঘরে এসি চালিয়ে লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকে।’
রোগিণী লজ্জায় মুখ ঢাকল। ঠাট্টা করে বললাম, ‘শোন, তোকে তুই বলছি -কিছু মনে করিস না। একটা বিয়ে করে ফেল। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মা গর্জে উঠলেন। ‘তুই নয় তো কি, আপনি বলবেন নাকি! তুই-ই তো বলবেন। আপনার মেয়ের বয়সী।’
মনে মনে বললাম- নাতনির বয়সীও হতে পারে।
মেয়েটি এবার লজ্জা লজ্জা মুখে বলল, ‘সামনের জানুয়ারিতেই বিয়ে।’
‘সে দেরি আছে। তার আগে ব্যথা সেরে যাবে।’
‘কি করে সারবে? জামাইও একই কোম্পানীতে কাজ করে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে।’
‘খাওয়া-দাওয়া?’
‘সে সবও বিছানাতেই।’
‘সর্বনাশ! বলেন কি? তাহলে তো খুবই মুস্কিল।’
পাশেই এক চশমা পরা গোবেচারা ছেলে দাঁড়িয়েছিল। এই-ই সম্ভবতঃ সেই ভাবী অপরাধী।
দুজনেই এক কোম্পানীতে!
তাহলে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ তো ‘ওয়ার্ক ফ্রম বেড’ হয়ে গেছে।’
সেরেচে!