১৯৬৭।
রক্ষণশীল পরিবারের কর্ত্রী লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। হাসপাতালে নিয়ে যাবার প্রশ্ন নেই, তাই বাড়িতেই তাবড় চিকিৎসক ডেকে এনে, নার্স রেখে, রক্ত সঞ্চালন করে, স্যালাইন দিয়ে ও সেই সময়ে লভ্য ওষুধপত্র দিয়ে চিকিৎসা চলছে। একদিন সব ওষুধের কার্যক্ষমতা সাঙ্গ হোলো। প্রথমে জ্বর, তারপরে রক্তচাপ কমছে, শেষে তাপমাত্রা কমতে লাগল। তরুণ ‘পাড়ার ডাক্তার’ এর খোঁজ পরল কারণ বড় ডাক্তার অসময়ে আসবেন না। তিনি এলেন৷ তখনকার চিকিৎসার প্রথা অনুযায়ী শেষ চেষ্টা হিসাবে কোরামিন ইঞ্জেকশন দিলেন।
Septicaemic Shock এ যা কোনো কাজে আসার কথা নয়। এলও না। পারতপক্ষে ৫২ বছর আগে সেপ্টিসেমিয়ার কোনো চিকিৎসাই থাকার কথা নয়। যা হওয়ার তাই হল। রোগিণী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
সেদিনের সেই তরুণ চিকিৎসক আজ অশীতিপর। সেই পরিবারে আজও কান পাতলে শোনা যায়, ঐ ডাক্তার রুগীকে ‘ভুল ইঞ্জেকশন’ দিয়ে ‘মেরে ফেলেছিল’।
রুগিণী আমার পিতামহী, কাহিনীটি আমার পিতৃদেবের কাছে শোনা। রোগলক্ষণ মিলিয়ে Septicaemic Diagnosis টি আমার করা। জ্ঞান বয়স থেকে এ কাহিনী শুনে আসছি।
জাম্পকাট টু ২০১৩।
ভাইফোঁটার সকাল। সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারবাবু গাইনিকোলজিস্ট হলেও নিয়ম অনুযায়ী একটি করে জেনারেল এমারজেন্সি ডিউটি করেন। তাতে তাঁর অবশ্য আপত্তি নেই – MBBS এ পাঁচ বছর পড়া বিদ্যাগুলো সপ্তাহে একদিন ঝালিয়ে নেওয়া যায়। বিপত্তি এল সেদিন সকালে। নাইট ডিউটি শেষ হব হব – একজন ৬৩ বছরের রুগীকে আনা হল। আক্ষরিক অর্থেই খাবি খাচ্ছেন। অক্সিজেন এর অভাবে নীল। রক্তচাপ প্রায় আকাশছোঁয়া। বুকে স্টেথো বসাতেই যেন একগামলা জলে মোটা পাইপ দিয়ে বুড়বুড়ি কাটানো হচ্ছে। হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষিত – সব রক্তরস গিয়ে জমা হচ্ছে ফুসফুসে। অক্সিজেন চালিয়ে, Nebuliser চালু করে কাগজপত্রে চোখ বুলিয়ে দেখা গেল আগেকার ডায়াগনোসিস – Biventricular Failure with ejection fraction 21℅ with advanced interstitial lung disease with uncontrolled insulin dependant diabetes. অর্থাৎ হৃদযন্ত্র, ফুসফুস দুটিরই একেবারে শেষ অবস্থা, সোনায় সোহাগা ডায়াবেটিস। জানা গেল এটি তাঁর এরকম অবস্থায় উনিশতম বার ভর্তি হওয়া। Injection Lasix দেওয়া হল। বাড়ির লোককে ডাক্তারবাবু বুঝিয়ে বললেন সঙ্গীন অবস্থা এবং এই হাসপাতালে কোনও ICCU, ITU, কিছু নেই যা এই রুগীর একান্ত প্রয়োজন। তাঁদের একটাই কথা – ও আগেও এরকম ১৮ বার
হয়েছে, ওসুদ-ফসুদ, গ্যাস-ট্যাস দিলে সব ঠিক হয়ে যায়।
ডাক্তারের দুর্ভাগ্য, এবারে পালে বাঘ পড়ল। অচল হার্ট আর ঝুরঝুরে ফুসফুস আর সাড়া দিলনা – রুগী আধঘন্টা পরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
শুরু হল গোলমাল, মোবাইলে স্থানীয় বিধায়ককে ফোন করে লোক ১০০-২০০ লোক পাঠানোর আবেদন। ‘সালা ডাক্তার, ভুল ইঞ্জেকশন দিয়ে রুগীকে মেরে ফেললি?’
প্রথমে গালিগালাজ, তারপরে মাথায় বাঁদিকে পরপর ঘু্ঁষি। ভাগ্যিস হাতের কাছে ইঁট ছিলনা, তাহলে ডাক্তারবাবুর হয়ত সেদিনই ভবলীলা সাঙ্গ হত।
পরে পুলিশ, কাউন্সিলর সবাই আসেন। এ রাজ্যের দস্তুর অনুসারে ডাক্তারবাবুকে সযত্নে হুমকি দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়। যাওয়ার সময় একজন পুলিশ SI জনান্তিকে চিকিৎসককে বলে যায়- ‘ডাক্তারবাবু, ইঞ্জেকশনগুলো একটু ঠিকঠাক দেবেন, আমরা কি সবসময় আসতে পারব! ‘
সেদিনের সেই ডাক্তারটি আজও বুঝতে পারিনি, ঠিক কোন ইঞ্জেকশন টা “ভুল” দেওয়া হয়েছিল।
কাট টু ২০২৩।
আমার অতি নিকটাত্মীয় দেহ রেখেছেন সদ্য। বয়স ৭৬। কৈশোর থেকে শুরু হয়েছিল ধূমপান যা ছাড়েন প্রৌঢ় বয়সে, COPD যখন থাবা গেড়েছে দুটি ফুসফুসে। বাড়িতে নিয়মিত Nebulizer, অক্সিজেন চলত। ফুসফুসে অক্সিজেনএর পরিমাণ তা সত্ত্বেও কখনও নেমে আসত ৩০ -৪০ শতাংশে। অবধারিত Type 2 Respiratory Failure যেখানে CO2 দেহ থেকে নির্গত হয়না, বেশী অক্সিজেন দিলে বরং ক্ষতি হতে পারে। পারতপক্ষে কোনো Cure নেই। ওঁর মৃত্যু হয় পরিচিত নার্সিংহোমে, অতি পরিচিত চিকিৎসকের তত্বাবধানে ভর্তি হয়ে।
তাঁর চার সন্তান সকলেই আমার অনুজ। প্রত্যেকে শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, সংসারে স্থিত। মৃত্যু পরবর্তী শোকের পরিবহে, এমনকি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অতি মার্জিত ভাবে, একটিই প্রশ্ন, ” সত্যি বলত, ভুলভাল ইঞ্জেকশন কি কখনও দেওয়া হয় না? এত যে শুনি, সবই কি মিথ্যে?” আমার উত্তর দেবার প্রবৃত্তি হয়নি৷ আত্মমর্যাদায় বড় বেজেছিল।
আমাদের কথা
যেকোন হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে জেনেরাল এমারজেন্সি ইঞ্জেকশন ট্রে টা পারলে কেউ দেখতে পারেন। আমার হাসপাতালের কেউ দেখতে এলে যেকোন সময় স্বাগত। যেগুলি থাকে, তার তালিকা দিই –
- Rantidine – গ্যাস্ট্রিক সমস্যার ওষুধ
- Drotaverine / Dicyclomine / Hyoscine – পেট ব্যথার ওষুধ।
- Ondansetron/ Metoclopramide – বমির ওষুধ।
- Pethidine/ Pentazocine/ Tramadol – মরফিন জাতীয় ব্যথার ওষুধ।
- Diclofenac – হাড় ভাঙা বা ওইরকম তীব্র যন্ত্রণায় দেওয়া হয়।
- Deriphylline – সাধারণভাবে শ্বাসকষ্টের ওষুধ। আজকাল nebulizer সহজলভ্য হওয়াতে কমই ব্যবহার করা হয়।
- Adrenaline – কিছু cardiac arrest এ বা মারাত্মক অ্যালার্জির অব্যর্থ ওষুধ।
- Promethazine – অ্যালার্জির ওষুধ
- Diazepam – ঘুমের ইঞ্জেকশন, মৃগীরোগেও ব্যবহার হয়।
- Phenytoin- মৃগীর ওষুধ
- Tranexamic Acid – রক্তপাত কমানোর ওষুধ
- Lasix – হার্ট ফেলিয়োর এর ব্রহ্মাস্ত্র। দিলেও রুগী মারা যেতে পারেন, তবে না দিলে মারা যাবেন, এটা নিশ্চিত।
- সবশেষে -Hydrocortisone / Dexamethasone – এগুলি স্টেরয়েড। Asthma বা COPD বা মারাত্মক অ্যালার্জিতে ব্রহ্মাস্ত্র।
যেটা বলার বিষয়, একেবারে মুমূর্ষু রুগীকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসাবে এটি এবং Deriphylline এর ব্যবহার বহুদিন ধরে চলে আসছে খানিকটা empirically বা রীতি হিসাবে। যে রুগীর মৃত্যু অন্য কোন রোগ-আঘাতের কারণে অনিবার্য, সেখানে প্রায় কোন ক্ষেত্রেই এগুলি কাজ করে না। চিকিৎসকরা খানিকটা নিজেদের সান্ত্বনা হিসাবে এদুটি দেন বা দিতেন।
রুগীর মৃত্যু হলে প্রায় সবক্ষেত্রেই “ভুল ইঞ্জেকশন” এর মিথ্যা আসামী হিসাবে এই দুটিকে দাগানো হয় এবং চিকিৎসকের জোটে লাঞ্ছনা আর হাসপাতালের আসবাব ভাঙে। আক্রমণকারীর দল নিজের সমাজে হিরো হয় ‘ডাক্তার কেলিয়ে’।
বিশ্বাস করুন, উপরে বলা এই ইঞ্জেকশনগুলির একটিরও এমন ক্ষমতা নেই, যাতে তারা তৎক্ষণাৎ রুগীকে মেরে ফেলতে পারে। এগুলি এতটাই বেসিক ওষুধ, সদ্য MBBS পাশ করা চিকিৎসকও এগুলি ভুল করবেন না।
সিনেমা বা সিরিয়ালে যেমন দেখানো হয়, সেরকম কোন Poison লেখা কোনো বিষ ইঞ্জেকশনও হাসপাতালে কোথাও থাকে না, মানে এরকম কোন কিছুর অস্তিত্বই নেই।
তাহলে? হাসপাতালে রুগী নিয়ে গেলাম, ডাক্তারের কথায় নার্স পটাপট দুচারটে ইঞ্জেকশন দিল, পাঁচ-দশ-পনেরো মিনিট পরে রুগী মরে গেল। আমার বাবাকে জ্যোতিষি বলেছিলেন আরও দুবছর বাঁচবেন!
বন্ধু, আপনারা বয়স অনুযায়ী একটু পরিণত হোন। কেউ অমর নয়, তাহলে আমরা ডাক্তাররা সকলে অমর হতাম। অনেক ডাক্তারের সন্তান অকালে চলে যায়- এরকম ঘটত না। সব কালান্তক রোগেরই একটা স্বাভাবিক পরিণতি বা natural hisrory থাকে। যদি হার্ট- ফুসফুস একেবারে পাল্টে ফেলতে না পারেন – Asthma, COPD, cardio-myopathy র রুগীর একদিন না একদিন শ্বাসকষ্টেই মৃত্যু হবে – একটা সময় কোনো ওষুধই আর কাজ করবে না – ওই অঙ্গটি তার কার্যক্ষমতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাবে।
মাঝখানে থেকে কি হয় জানেন? আমরা, অধিকাংশ ডাক্তাররাই আর মরিয়া উপায় হিসাবে কোনো ইঞ্জেকশন দিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করার কথা ভাবিনা। এই রোগের চিকিৎসা আমার জ্ঞানের বাইরে- সত্যি না হলেও নিজেকে বাঁচাতে একথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো, কিন্তু ভুল ইঞ্জেকশনের অভিযোগের দামটা বড্ড বেশি পড়ে।
ক্ষতি কার? ভাবুন, ভাবা প্র্যাক্টিস করুন।