এক দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পরিপ্রক্ষিতে র্যাগিং নিয়ে লিখেছিলাম কদিন আগে। তারপরের কয়েকদিনে দেখলাম ঘোলা জলে ল্যাঠা, শোল ইত্যাদি মাছ ধরা শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার সেখানে ব্যারাকুডা, স্যামন, টুনা, পিরানহা ইত্যাদিও খুঁজে পাচ্ছেন দেখছি। অর্থাৎ, রাজনীতির লোকেরা যা সাধারনতঃ করে থাকেন তার চেয়েও এক কাঠি ওপরে করছেন।
তাঁরা গল্পের গোরুকে শুধু গাছেই তোলেন নি, তাকে আকাশে তুলে তাকে দিয়ে একেবারে প্লেন চালাচ্ছেন!
অথচ, যাঁরা কোনোদিন হোষ্টেল জীবন কাটিয়েছেন, তাঁরাই জানেন র্যাগিং-এর সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একটা সাময়িক মানসিক ব্যাধি। কখনো বন্ধুবান্ধব বা জুনিয়রদের কাছে হিরো হওয়ার চেষ্টা, কখনো হীনমন্যতা, হতাশা, রাগ ইত্যাদি এর কারণ।
যারা র্যাগিং করে, তারা মূলতঃ দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রী। দেখা গেছে যে, প্রথম বর্ষে যারা সব চেয়ে বেশী র্যাগিংয়ে অত্যাচারিত হয়, তারাই দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর র্যাগিং করে। ব্যাপারটা সেই গ্যাস সিলিন্ডার (ই)রানীর বহুদিন আগে অভিনয় করা ‘সাঁস ভি কভি বহু থি’ সিরিয়ালের মত ব্যপার। দেখা গেছে, যে বউমা তার শাশুড়ির দ্বারা যত বেশী অত্যাচারিত হয়, পরবর্তীকালে শাশুড়ি হয়ে সে তার বৌমাকে তত বেশী অত্যাচার করে। এর সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যা সাইকোলজিষ্টরা দিতে পারবেন।
ঠিক তেমনি, যে ছেলে বা মেয়েটি প্রথম বর্ষে যত বেশী ভয়াবহ র্যাগিং এর শিকার হয়, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে উঠে নতুন ছেলেমেয়ে-দের র্যাগিং-এর নামে সে তত বেশী অত্যাচার করে। এটা সম্ভবতঃ ‘Sadism psychology’। গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচানো টিভি অ্যাঙ্কর, বা নতুন উড়তে শেখা চিড়িয়া-রা টিভি বুম হাতে নিয়ে যা খুশি বলতে পারেন- কিন্তু তাতে সত্যিটা বদলায় না।
সত্যি কথা বলতে কি- এদের কলেজ, ইউনিভার্সিটি, র্যাগিং সম্বন্ধে হয় কোনো আইডিয়া নেই অথবা জেনেশুনে আকাট মিথ্যা কথা বলছে।
সরাসরি কতগুলো কথা না বললেই নয়।
১। র্যাগিং-এর সঙ্গে রাজনীতি বা নিদেন পক্ষে ছাত্র রাজনীতিরও কোনো রকম সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার্থে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য কায়েম করতে অক্ষম হয়ে গায়ের জ্বালা মেটানোর চেষ্টা করছেন- তাঁদের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যত দূরে থাকেন, ততই মঙ্গল।
২। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং হয়। কিন্তু যাদবপুর কখনই র্যাগিং-এর কুখ্যাত-তম কেন্দ্র ছিল না। বরঞ্চ ভারতে র্যাগিং-এর কুখ্যাত-তম কেন্দ্র ছিল কানপুর আইআইটি। আমাদের ছাত্রজীবনে কানপুর আইআইটি পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের দিক থেকে ছিল ভারত সেরা। তবুও অনেকেই কানপুর আইআইটি-তে সুযোগ পেয়েও স্রেফ র্যাগিং-এর ভয়ে অন্য আইআইটি তে ভর্তি হয়েছে- এরকম ঘটনাও আছে।
বস্তুতঃ সমস্ত আইআইটি গুলো ছিল র্যাগিং-এর জন্য কুখ্যাত। খড়গপুর আইআইটি-তে র্যাগিং-এ মৃত্যুর ঘটনা কথা আগের লেখায় লিখেছি। ২০০০ সালে মুম্বাই আইআইটি-র হোষ্টেলে র্যাগিং-এর ছবি দেখে ভয়ে শিউরে উঠেছিলাম। এমনকি ছোট ছোট সরকারি ও প্রাইভেট টেকনিক্যাল কলেজ,পলিটেকনিক ইত্যাদিতে এত ভয়াবহ র্যাগিং হয়- সেসব সাধারণ মানুষ ও ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা টিভি অ্যাঙ্করদের কল্পনার অতীত। এই সব প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং-এ আঘাত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে- কিন্তু সেগুলো ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়।
৩। র্যাগিং যারা করে, আমার মনে হয় তারা সাময়িক কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু এরাই আবার বাড়িতে, পাড়ায়, বন্ধুদের মধ্যে, স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নিপাট ভালোমানুষ। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। তাদের কোনটা যে মুখ, আর কোনটা মুখোশ- কোনটা সত্যি আর কোনটা যে অভিনয়- কে জানে! মেয়েরাও র্যাগিং করে। ভিন রাজ্যে স্নাতোকোত্তর পড়তে গিয়ে র্যাগিং-এর শিকার হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয় অনেকে।
৪। বিদেশে, বিশেষ করে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের আলাদা হোষ্টেলে রাখা হয়। বিশেষ অনুমতি ছাড়া অন্য কোন বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের সেই হোষ্টেলে প্রবেশাধিকার থাকে না। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা হোষ্টেল বা বাসস্থান। সেটা ঐচ্ছিক বা optional. কারণ তাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে বাড়ি ভাড়া করে থাকে। সেটা অনেক সস্তা হয়। র্যাগিং রুখতে এটা একটা মোক্ষম দাওয়াই।
৫। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসিটিভি না লাগানোর বা না লাগাতে দেওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে সিসিটিভি লাগিয়ে হাত ধুয়ে ফেললে হবে না (যেটা সাধারণতঃ হয়ে থাকে)। হয় সিসিটিভি চলে না- খারাপ হয়ে পড়ে থাকে। নয়তো তার রেকর্ডিং খুঁজে পাওয়া যায় না।
সিসিটিভি-র রেকর্ডিং দেখে র্যাগিং-এর ঘটনার তদন্ত করতে হবে। তারপর সেই তদন্ত রিপোর্ট দোষী ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে পাঠাতে হবে। যাতে পরিবারের লোকেরা তাদের আদরের দুলাল বা দুলালীর আসল চরিত্রটা বুঝতে পারে। এছাড়াও সেই তদন্ত রিপোর্ট দোষী ছাত্রছাত্রীর বাড়ির কাছের স্থানীয় থানায় পাঠাতে হবে- যাতে পরবর্তীকালে সরকারি চাকরী বা পাশপোর্ট পেতে তাদের পুলিশ ভেরিফিকেশনে সমস্যা হয়।
৬। র্যাগিং বাদ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কে মদ্যপান করবে আর কে ধূমপান করবে – তা নিয়ে কোনো টিভি অ্যাঙ্কর বা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর জ্ঞান দেওয়ার কোনো অধিকারই নেই। কারণ এই দুটো যদিও স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ- কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক-দের পক্ষে এগুলো আইনতঃ বারণ নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মোটামুটি সকলেই প্রাপ্তবয়স্ক। নিষিদ্ধ নেশার বস্তু নিঃসন্দেহে বারণ। তবে কিনা এই সব জ্যাঠামশাই বা জেঠিমা-র নিজেরা কি কি নিষিদ্ধ বস্তু নেন- সেসব মাঝেমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
তাই র্যাগিং রুখতে প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের আলাদা হোষ্টেলে রাখতে হবে। সেখানো কোনো সিনিয়র ছাত্রছাত্রীর প্রবেশাধিকার থাকবে না (ওসব ইন্ট্রো-ফিন্ট্রো-র কোনো প্রয়োজন নেই)। বিশ্ববিদ্যালয় এবং হোষ্টেলের কোনায় কোনায় সিসিটিভি লাগাতে হবে। সেগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষন করতে হবে এবং কার্যক্ষম রাখতে হবে। প্রতিদিন সকালে তার ফুটেজ পরীক্ষা করতে হবে। প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সত্যিকারের নিরপেক্ষ র্যাগিং প্রতিরোধী কমিটি তৈরি করতে হবে- নামকে ওয়াস্তে নয়।
র্যাগিং এর অভিযোগ প্রমানিত হলে দোষীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করতে হবে।
আর একটা কথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাইরের লোক, রাজনৈতিক নেতা, মিডিয়া- সে গলার শিরা ফোলানো মোটা কোলা ব্যাং হোক বা নয়া চিড়িয়া- সবার মাথা গলানো এবং অনধিকার চর্চা বন্ধ হোক।