ওপেনহাইমার’ হুজুগের বাজারে অন্তত দুখানা বাংলা বইয়ের বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। নারায়ণ সান্যালের ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘নির্বাপিত সূর্যের সাধনা’। দুটিই অনেক বছর আগে লেখা। প্রথমটি প্রায় কিশোর বয়সে পড়েছিলাম। বেশ মনে পড়ে, বইখানার পড়ে উঠে রীতিমতো আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় বইখানা পড়িনি। এই হুজুগের সুবাদে বইটা কিনে ফেললাম, এবং পড়তে শুরু করলাম।
কিন্তু কিছুদূর এগোতে না এগোতেই একটা ঘটনার বিবরণ পড়ে একেবারে চমকে গেলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেকার জার্মানির ঘটনা। বক্তৃতা করতে উঠেছেন আইনস্টাইন। বাইরে বার্লিনের রাস্তা পুরু তুষারে ঢাকা। হলের প্রতিটি কোণা ভিড়ে ঠাসা। আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে বক্তৃতার মাঝেই একটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল – ‘এই সব বস্তাপচা ইহুদিপ্রচার আর কতদিন চলবে?’ জনাপঁচিশেক ছেলেমেয়ে সমস্বরে স্লোগান তুলল – ‘দুনিয়াকে ধাপ্পা দেওয়ার জন্য তৈরি করা ইহুদি আপেক্ষিকতাবাদ – নিপাত যাক।’ ‘নব সমাজ, আসছে – আসবে।’ ‘জার্মান বিজ্ঞান দীর্ঘজীবী হোক।’ খানিকক্ষণের মধ্যেই সভাস্থলে চিৎকার-চেঁচামেচি হাতাহাতি চেয়ার ছোঁড়াছুড়ি শুরু হয়ে গেল। সভাস্থল ছেড়ে পালাতে শুরু করলেন আতঙ্কিত জনতা। জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনায় “যখন পিস্তল ছোঁড়ার শব্দ শোনা গেল, স্টেজের একপাশে দাঁড়িয়ে হতভম্ব আইনস্টাইন, তখনও একহাতে তাঁর মেটে রঙের টাই এবং অন্য হাতে মাইকটা ধরে বিড়বিড় করে বলার চেষ্টা করছেন…”
না, অতীতের আইনস্টাইনের কথা ভেবে নয়, শিউরে উঠলাম রোমিলা থাপারের কথা ভেবে। অবশ্য তাঁর বক্তৃতা এমন করে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে এখনও খবর পাইনি। কিন্তু আজকাল তো হরবখতই শুনি – যারতার মুখেই শুনি – রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব প্রমুখ নাকি কোনও ঐতিহাসিকই নন, তাঁরা নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইতিহাস লিখে মানুষকে বিভ্রান্ত করে এসেছেন, ‘আসল ইতিহাস’ দেশের মানুষকে জানতেই দেননি। চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া এহেন বার্তার সঙ্গে আইনস্টাইনের সভায় ওঠা স্লোগানের দূরত্ব কতটুকু!
শুধু কি ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান? বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-উপশাখার খবরও কি আলাদা করে ভালো?
নতুন গড়ে ওঠা একটি মেডিকেল কলেজে চাকরি করি। নতুন করে কলেজ লাইব্রেরি গড়ে উঠছে। নতুন নতুন বই কেনা হচ্ছে। আবার দেশীয় প্রকাশকরা তাঁদের নতুন প্রকাশিত বই ‘স্পেসিমেন কপি’ হিসেবে অধ্যাপকদের কাছে রেখে যাচ্ছেন, যদি তা ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যতালিকায় ঠাঁই পায়, এই আশায়। আমার অধ্যাপনার বিষয়টি যেহেতু এমবিবিএস কারিকুলামে নেই, অন্য বিভাগের বইপত্রই উল্টেপাল্টে দেখি। এক সহকর্মী-বন্ধুর টেবিলে একখানা নতুন বই নিয়ে পাতা উলটে দেখছিলাম। দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস বলতে গিয়ে – হ্যাঁ, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার একটি পাঠ্যবইয়েই – লেখক একেবারে শুরুতেই জানিয়েছেন ধন্বন্তরির কথা। ধন্বন্তরির জন্মদিন উপলক্ষে ‘ধনতেরাস’ উৎসবের গুরুত্বের কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি। সুশ্রুত-এর কথা উল্লেখ করতে গিয়ে – শ্রদ্ধা ও বিস্ময় সামলাতে না পেরেই, সম্ভবত – তাঁকে নিয়ে চলে গিয়েছেন খ্রিস্টজন্মের দেড় হাজার বছর আগে!
আবার ‘Doctor’ বলতে কে, এর উত্তর দিতে গিয়ে শুরুতেই বলেছেন, দর্শনগত দিক থেকে বলতে গেলে ডাক্তার হলেন তিনিই, যিনি ঈশ্বরের সহায়ক। অর্থাৎ রোগবালাই থেকে মানুষকে সারিয়ে তোলার ব্যাপারে চিকিৎসক ঈশ্বরকে সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকেন।
স্বাভাবিকভাবেই এই বইয়ে আর বেশি এগোতে পারিনি। মেডিকেল শিক্ষার কারিকুলামের বাকি অংশের বিবিধ অদ্ভুত ভাবনাচিন্তা, বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতিকে মেলানোর অর্বাচীন ধ্যানধারণা – সেসব প্রসঙ্গ না হয় এই আলোচনায় বাদই রাখছি, কিন্তু একেবারে ‘কোর সাবজেক্ট’-এর পাঠ্যপুস্তকের শুরুর অধ্যায়েই এরকম ‘ইতিহাস’! নতুন কারিকুলামে ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের একেবারে শুরুতেই – চিকিৎসাশিক্ষার প্রবেশিকা হিসেবে – কিছু কিছু বিষয় পড়ানোর কথা ভাবা হয়েছে। তার মধ্যে একদম শুরুতেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস। এবং সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান (ওরফে অ্যালোপ্যাথি) বাদে চিকিৎসাবিদ্যার বাকি ধারাগুলোর ইতিহাসও পড়াতে হবে। সেটা ভুল কিছু নয় – উপনিবেশকালে আমাদের অতীত ভুলিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা, পশ্চিমা পদ্ধতিকেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে মানতে বাধ্য করার যে ধারা, তা বহন করে চলা কোনও কাজের কথা নয়। কিন্তু এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে, আয়ুর্বেদের কথা বলতে হলে পৌরাণিক ধন্বন্তরি দিয়ে শুরু করতে হবে?
না, ডাক্তারি পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে বার্লিনের সেই বিকেলের কোনও সম্পর্কই নেই। কিন্তু ইতিহাস বলতে এইসব শিক্ষায় আলোকিত হতে থাকলে ওই ‘নব সমাজ, আসছে – আসবে’ স্লোগান তোলার মত ‘শিক্ষিত’ ছাত্রগোষ্ঠী তৈরি হতে পারাটা খুব দূরেও নয়। নিজের পেশার বিষয় বলে ডাক্তারি পাঠ্যক্রম ও বইয়ের উদাহরণ দিলাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত, বিজ্ঞানের বাকি শাখার ক্ষেত্রেও সমতুল্য উদাহরণ পাওয়া যাবে। এবং একটু ‘ফিউচারিস্টিক’ হয়ে যদি ভাবেন, এমন শিক্ষা জারি থাকলে, এদেশের মাটিতে আইনস্টাইন পুনর্জন্ম গ্রহণ না করলেও তাঁর সভার দৃশ্যটির পুনরভিনয় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।