বাড়ি ফিরেই আবার নেমে পড়লাম আন্দোলনে। এমন অভ্যেস নেই বহুকাল। মিছিলে হেঁটে মাঝে মাঝে পায়ে ব্যথা হয়। অনভ্যাসের কাঁটা শতগুণ হয়ে ফোটে পায়ে। কিন্ত বিচার পাওয়া অবধি থামলে চলবে না। যুদ্ধের সময় এক সেনানীর পতন হলে পরের সেনানী সঙ্গে সঙ্গে তার অবস্থানে চলে আসে। জায়গা খালি থাকে না।
এই আন্দোলনও একরকম যুদ্ধ। এতে এক-একজন আন্দোলনকারী অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, আক্রান্ত হতে পারে, গ্রেফতার হতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু আন্দোলন জারি রাখতে হবে। সঠিক বিচার না পাওয়া পর্যন্ত থামলে চলবে না।
গত ১লা অক্টোবর এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল।
কলেজ স্কোয়্যার থেকে রবীন্দ্র সদন পর্যন্ত মহামিছিলে হেঁটে তারপর ফিরছি। প্রচন্ড গরম ও গুমোটে ঘামে জবজবে ভিজে। জামা নিংড়োলে হয়ত ১০০ মিনিট বা ৫০ ফারেনহাইট জল বেরোবে।
তার উপরে মেডিক্যাল কলেজের চত্বরে গাছের উপর থেকে কাঁধের উপরে পক্ষী বাবাজীর আশীর্বাদ বর্ষিত হল। সেই আশীর্বাদ ধুতে গিয়ে পুরোই ভিজে গেলাম।
কি করি? তখনো কাজকর্ম বাকি আছে। ওয়ার্ডে কয়েকজন রোগীকে দেখতে হবে। তারপর স্পাইন সোসাইটির মিটিং আছে। এই অবস্থায় কি করে সেসব জায়গায় যাওয়া যায়। হয়তো সিকিউরিটিরা ঘাবড়ে গিয়ে ঢুকতেই দিল না!
শেষে স্ত্রীর পরামর্শ মত গাড়িটি তাঁর হাতে দিয়ে বিধান সরণীতে একটা জামাকাপড়ের দোকান খুঁজে ভয়ে ভয়ে ঢুকলাম একটা জামা কিনতে। ভাবছিলাম ঝাঁ চকচকে দোকান থেকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে না দেয়!
কিন্তু দোকানে ঢুকে জামার খোঁজ করতেই দেখি দোকানের একজন কর্মচারী আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। আর একজন আমার বুকের বাঁদিকে বেশ খুঁটিয়ে কি একটা দেখছে! পরনের প্রায় ন্যাতা হয়ে যাওয়া জামার পকেটের কাছে ‘We demand justice for Abhaya’ লেখা ব্যাজটা তখনো চকচক করছে।
‘আপনি কি প্রতিবাদ মিছিলে গেছিলেন?’
মিনমিনে সুরে বললাম ‘হ্যাঁ, এই কলেজ স্কোয়্যার থেকে রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত।’
‘পুরোটা কমপ্লিট করেছেন?’
‘প্রায়।’
‘দারুন ব্যপার!’
দোকানে খদ্দের বেশী নেই। তিন-চার জন মাত্র। সবাইকে ছেড়ে কর্মচারীরা পড়ল আমাকে নিয়ে। একজন অনেক রঙের ও সাইজের জামা ও টি-শার্ট নিয়ে আমাকে দেখাচ্ছিল। ‘এইটা আপনার ঠিক হবে।’
আর একজন বলল, ‘আমরা ছাড়ব না। শেষ অবধি লড়তে হবে। আমরা সাথে আছি, দাদা।’
একজন বলল, ‘দোকানে কাজ করি। পুজোর বাজার ছেড়ে মিছিলে যেতে পারছি না – খারাপ লাগছে।’
‘আমরা সবাই কিন্তু আপনাদের দিকেই তাকিয়ে আছি।’
আর একজন এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি সোদপুরের ছেলে। আরজিকরের মেয়েটার বাড়ি ছেড়ে একটা গলি পরে আমার বাড়ি। আমরা গোটা পাড়া রাতে ঘুমোতে পারছি না জানেন। কি নৃশংস ঘটনা! আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব।’
টি শার্ট পছন্দ করা হল।
‘জামাটা পুরো ভিজে গেছে। এখানেই চেঞ্জ করে নিন।’
মাঝারি সাইজের দোকান। চেঞ্জিং বা ট্রায়াল রুম কিছু নেই।
বিহ্বল হয়ে বললাম, ‘এখানে? কি ভাবে?’
‘ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
দোকানের এক কোনায় কাপড় দিয়ে ঘিরে অস্থায়ী ট্রায়াল রুম তৈরি করে দিল। জামা বদলালাম।
অন্য খরিদ্দাররা ততক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
‘চুলটা আঁচড়ে নিন।’ একজন অভিভাবকের মত বলল।
‘এক গ্লাস জল খেয়ে যান।’
সবাই মিলে বলা হল, ‘WE WANT JUSTICE’
জল খেয়ে সবার সাথে হাত মিলিয়ে নতুন টি শার্ট গায়ে বেরিয়ে এলাম সেই দোকান থেকে, যেখানে একটু আগেই ঢুকতে দ্বিধা হচ্ছিল।
#justiceforRGKar
#justiceforabhaya
#jointplatformofdoctors