সে অনেকদিন আগেকার কথা। মোবাইল ফোন তখনো হাতে গোনা কয়েকজনের হাতে। আর স্মার্টফোন ভবিষ্যতের গর্ভে। জরুরী ক্ষেত্রে এমার্জেন্সী বা ওয়ার্ড থেকে রাতবিরেতে জুনিয়র ডাক্তার বা ‘রেসিডেন্ট ডাক্তার’দের-দের ডেকে পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল “কল-বুক”। “কল-বুক” একটা খাতা। তাতে সময়, তারিখ দিয়ে হাতে লেখা একটা বার্তা থাকত প্রাপকের জন্য। সিষ্টারদের কাছ থেকে সেই খাতা নিয়ে ওয়ার্ডের একজন পুরুষ বা মহিলা কর্মী হানা দিত ইন্টার্ন, হাউজস্টাফ বা পিজিটিদের হোষ্টেলে হোষ্টেলে বা আরএমও কোয়ার্টারে। এই সব ‘কল-বুক’, তাতে লেখা বার্তা ও তার বানান এবং ভাষা নিয়ে অনেক বিচিত্র গল্প আছে।
আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারের পোষ্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনি। স্বভাবতঃই জরুরী ক্ষেত্রে প্রথম ‘কল-বুক’ আমার কাছেই আসার কথা। আর সেদিন ছিল আমাদের ইউনিটের ‘অ্যাডমিশন ডে’। মানে সেদিনের আউটডোর আমাদের এবং এমার্জেন্সী দিয়ে কোনো রোগী ভর্তি হলে সে আমাদের ইউনিটেই ভর্তি হবে ভিজিটিং শিক্ষক-চিকিৎসকের অধীনে। তবে বকলমে জরুরী চিকিৎসা শুরু করবে সবচেয়ে জুনিয়র ডাক্তার। তার পরে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুসারে সিনিয়র পিজিটি, ‘আরএমও’ এমনকি প্রয়োজন হলে সিনিয়র শিক্ষক-চিকিৎসক কে-ও রোগীর চিকিৎসায় যুক্ত হতে হয়। এমনকি রাত বিরেতেও। এই হল ব্যবস্থা।
সেদিন আউটডোরে প্রচুর রোগী। তারপর রাউন্ড। আর সব শেষে সন্ধ্যায় এমার্জন্সী সার্জারি। জেনারেল সার্জারির পিজিটিদের সাথে প্রচুর ঝগড়াঝাটি ও অনুনয়-বিনয় করে অপারেশনের সময় আদায় করে কাজ শেষ করে মাঝরাতে হোষ্টেলে ফিরেছি। তখন মেডিক্যাল কলেজের এমার্জেন্সীতে অপারেশন থিয়েটার সাকুল্যে একটা। স্বভাবতঃই সেখানে জেনারেল সার্জারি বিভাগের আধিপত্য। আর তখন অর্থোপেডিক্স হল কোনায় পড়ে থাকা দুয়োরানী।
তাই নিতান্ত জরুরী কোনো অ্যাক্সিডেন্টের রোগীর অপারেশন করতে হলেও সার্জারির ‘পিজিটি’ আর ‘আরএস’ দের অনুগ্রহের অপেক্ষায় বসে থাকতে হত। আর নয়ত ঝগড়াঝাটি করে সময় আদায় করতে হত। আমরা অর্থোপেডিক্সের ‘পিজিটি’ রা বেশীরভাগ-ই ছিলাম দ্বিতীয় পন্থায় বিশ্বাসী।
সেদিন সন্ধ্যায় কড়া একপ্রস্থ ঝগড়াঝাঁটির পরে ঘাম ঝরানো হাড় ভাঙা অপারেশন। দুই অর্থেই। তারপর মাঝরাতে হোষ্টেলে ফিরে ডাঁটার চচ্চড়ি আর জলের মত ডাল দিয়ে ঠান্ডা ভাত খেয়ে একটু ঘুমিয়েছি। আর স্বপ্ন দেখছি সার্জারির যন্ত্রপাতি নিয়ে জেনারেল সার্জারির পিজিটি-রা আমাকে তাড়া করেছে!
এমন সময় দরজায় প্রবল আওয়াজ। বাইরে হইচই। তড়াক করে জেগে উঠে ভাবলাম, ওরা কি হোষ্টেল অবধি আমায় মারতে চলে এল নাকি?
দরজা খুলে বুঝলাম, অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিরীহ ‘কল- বুক’। পা ভেঙে এক রোগী ক্যাজুয়াল্টি ব্লকে অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে।
জামাকাপড় পাল্টে জুতো গলিয়ে অন্ধকার ইডেন থেকে নামলাম। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে শেষ রাতে কুকুর তাড়াতে তাড়াতে ওয়ার্ডে পৌঁছে যা দেখলাম তাতে চক্ষু চড়কগাছ! ভুল দেখছি না তো? ঘুম-টা ঠিকমত ভেঙেছে তো? আরো একবার চোখ কচলে দেখলাম সত্যিই জেগে আছি। সামনের ট্রলিতে শুয়ে আছে বিরাট বপুর ধপধপে ফর্সা এক মাঝবয়সী রোগী। বেশভুষা ও পোষাক-আষাক অনুযায়ী রীতিমতো ধনী। হাতে লাল, নীল, সবুজ পাথর বসানো বেশ কয়েকটা সোনার আংটি।
শুধু তাই নয়। সঙ্গে তিন মহিলা। একজন মাঝবয়সী, একটু মোটা, ফর্সা। বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। দুজন তরুণী। একজন পনের-ষোল, অন্যজন একটু বড়। দুজনেই সুন্দরী। তখন তো মোবাইল ফোন তত প্রচলিত ছিল না। তবে পোষাক ও গয়নাগাঁটি রীতিমতো ধনাঢ্য পরিবারের পরিচয় বহন করে। অত রাতে তাদের অত সেজেগুজে সরকারী হাসপাতালে আসার কারণ বুঝলাম না।
রোগীর পায়ে চোট। উরুর হাড় ভেঙে গেছে। শোনা গেল ভদ্রলোক জানলা গলে পড়ে গেছেন। মানুষ জানলা দিয়ে কি করে পড়ে যায় তা বোধগম্য হল না। আমাদের বাড়ির জানলায় তো, হয় গরাদ না হলে লোহার গ্রীল থাকে!
সেটা বলতেই ভদ্রলোক বেশ রাগতঃ স্বরে বললেন যে, আজকালকার ছোটখাটো বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে ওরকম থাকে। উত্তর কলকাতায় তাদের দুশো বছরের বিশাল প্রাচীন বাড়ি। এইসব বাড়িতে জানালাগুলো বড় বড় এবং তাতে গরাদ থাকে না। মাঝ রাতে জানলা দিয়ে ময়লা ফেলতে গিয়ে সে নাকি দোতলা থেকে পড়ে গেছে। আমি রোগীকে পরীক্ষা করতে করতে বললাম, জানলায় তো গরাদ লাগানো উচিত। না হলে চোর ঢুকে যাবে যে!
রোগী আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো, যেন আমি একটা গেঁয়ো ভুত। নিতান্ত ঘটনাচক্রে মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তার হয়ে বসেছি।
রোগীর মুখ থেকে ভকভক করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। ফোলা মুখ, ফর্সা লালচে গাল। নেয়াপাতি ভুঁড়ি। পাকা মদ্যপের মত চেহারা। জানলা গলে পড়ে যাওয়া এবং তারপর মেডিক্যাল কলেজের মত আমজনতার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কারণ খানিকটা আন্দাজ করা গেল।
পায়ের ভাঙাটায় অপারেশন লাগবে। আপাততঃ ট্র্যাকশন দিয়ে, স্যালাইন চালিয়ে, ওষুধ-ইঞ্জেকশন দিয়ে এমার্জেন্সী সামাল দিলাম। এইটুকুর জন্য সিনিয়র পিজিটি-কে ডাকলে গালাগালি শুনতে হবে। অন্য ইউনিটের একজন সিনিয়র তখন ওয়ার্ডে উপস্থিত ছিল। তার পরামর্শে এবং দুজন সিষ্টারের সাহায্যে সব কাজ করে ফেললাম। অপারেশনের ব্যপারে পরদিন সকালে বড় ডাক্তাররা এসে সিদ্ধান্ত নেবে।
এটুকু কাজ ছিল সহজ। কঠিন কাজ যেটা ছিল, সেটা হল তিনজন তিন বয়সের অভিজাত সুন্দরী মহিলার বোকাবোকা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আর তাদের উদ্বেগের নিরসন করা। সেইসব করতে করতেই রাত ভোর হয়ে গেল!
(এরপর পরের পর্বে)
ছবি: অন্তর্জাল