-‘ডাক্তারবাবু অপারেশনটা করবেন না।’
এ এক অন্য ধরনের পার্টি মিট।
চারজন ডাক্তার গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন মাত্র পেসেন্ট পার্টিকে মিট করতে এসেছে।
অনিমেষের মনে পড়ে যাচ্ছে আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আর জি কর হাসপাতালে মেটার্নিটি ওয়ার্ডে পার্টি মিটের কথা। ইভনিং রাউন্ড সেরে সিনিয়র হাউস সার্জেনকে পার্টি মিট করতে হবে। নিজেকে বেশ কেউকেটা মনে হতো। নীচে এসে সিঁড়ির ওপর দাঁড়াতেই দারোয়ান হাঁক পাড়ত –প্রফেসর অমিয় মুখার্জীর সাথে কথা বলতে ডানদিকের কোনায় যান। রোগা প্যাংলা ছেলেটা তখন অমিয় মুখার্জী ভূমিকায় যথাসম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রেখে রুগীদের অবস্থা ও আশু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার বিষয়ে বাড়ির লোকজনদের সাথে কথা বলে চলেছে। পাশেই শিবু, প্রফেসর পূর্ণিমা চ্যাটার্জির ভূমিকায়, আরো দূরে এক বড় জটলার মধ্যে অলকা, এইচওডি স্যার শ্রীমন্ত ব্যানার্জী সামলাচ্ছে।
সে বড় সুখের সময়। নিজেদের মনে হতো আমরাই তো হাসপাতালের মাথা। পার্টি মিটের পর ভোলার চায়ের দোকানে সব মাথা একসাথে।
তো আজকের প্রেক্ষিতটা অনিমেষের কাছে সম্পূর্ণ অন্যরকম। কোভিড মহামারীর আবহে এক আসন্ন-প্রসবা মা কোভিড পজিটিভ। হাসপাতালের তিন চারজন ডাক্তারের সাথে অনিমেষও চিন্তিত। বুকের এক্স-রে জানান দিচ্ছে একদিকের ফুসফুসের অবস্থা খুব খারাপ। কোভিড নিউমোনাইটিস প্রায় পুরোটাই গ্রাস করেছে। হবু তৃতীয় সন্তান যে অবস্থায় আছে, সিজারিয়ান করে তুলে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। চার ডাক্তার মাথা এক হওয়ার পরেই মুখ চাওয়া-চাইই। কাজটা কিন্তু যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ।
জুনিয়র রেজিস্ট্রার ছেলেটিই বলল, স্যার, একবার পার্টি মিট করে হাই-রিস্ক কনসেন্ট নিতে হবে।
একদম সঠিক কথা। কিন্তু পার্টি কোথায়?
-আসুন স্যার।
জুনিয়র ডাক্তারটি হাসপাতালের বাইরে অনেক দূরে গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষকে দেখাল।
মফস্বলের কোভিড ছাপ মারা হাসপাতালের আশেপাশে রুগীর বাড়ির লোকজনের থাকার কথা নয়।
দৃশ্যটা অনিমেষের বেশ উলট-পুরাণ লাগছিল।চারজন চিকিৎসক চলেছেন হাসপাতাল ছেড়ে দূরে এক এবং একমাত্র পেসেন্ট পার্টিকে মিট করতে।
অনিমেষই প্রথম শুরু করেছিল- শোনো বাবা, তোমার বউ এর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এই অবস্থার মধ্যেও সিজার করে বাচ্চা বার করে নিতে হবে। তুমি রাজী আছো তো?
এবার অ্যানাস্থেটিস্ট এগিয়ে এলেন, এছাড়া উপায় নেই আর এর পরেও, মা বা বাচ্ছা বাঁচবে কিনা নিশ্চিত নই। আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
ঠিক কথা, স্যার। এরপর উপরওয়ালা। হাতজোড় করে ওপরে তাকাল মানুষটি। এরপরই হঠাৎ সেই আকুতি, -স্যার, অপারেশনটা করবেন না।
অনিমেষ হতবাক। এতো বোঝানোর পরেও—
জুনিয়র রেজিস্ট্রার ছেলেটি মুচকি হেসে বলল, স্যার, ও বোধহয় বাচ্ছা বন্ধের অপারেশনের কথা বলছে।
লোকটির মুখে উজ্জ্বল হাসি, হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার। ঐ টা করবেন না।
অভিনব পার্টি মিটের পর ডাক্তারের দল এগিয়ে চলেছে হাসপাতাল অভিমুখে। অনিমেষের মনে হচ্ছে ওরা যেন পিছন দিকে এগিয়ে চলেছে।