ছিয়াসি সালে হাউসস্টাফ কালের কথা।
অনেক মাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছে ছেলেটা। ছাত্রদের জন্য আইডিয়াল কেস। রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ– একদম ধ্রুপদী মাইট্রাল স্টেনোসিস– হার্টের ভালভের গন্ডগোল। বাড়িতে রাখলে যখন তখন শ্বাসকষ্ট বাড়ে, এই বুঝি ডাক্তার ডাকতে হয়। হাসপাতালে থাকলে চিকিৎসা পায়, একটু ভালো মন্দ খেতেও পায়। বাবা মায়ের অরাজী হবার কারণ নেই। মাসের পর মাস একটা দশ বছরের ছেলে হাসপাতালে একটা বেডে থাকে। সিস্টার দিদি হেঁকে যায়– “বিজয়, তিন নম্বরের স্যালাইন ফুরালে ডাকিস তো–“। পাশের বেডের দাদুর বাড়ির লোক ভিজিটিং আওয়ার শেষে বলে যায়–“একটু দেখো, বাবু”। সন্ধ্যায় কোণ থেকে চীৎকার আসে –“উফ আফ, পেটে কি ব্যথা গো, বিজয় ভাইটি, একটু দিদিকে ডাকো না গো-একটা ইনজেকশন দিতে বল –”
এনবিএম ওয়ার্ডের দোতলায় বিজয় ছিল পার্মানেন্ট সদস্য। প্রতি ব্যাচের ছেলেমেয়েরা ওর বুকে নল লাগিয়ে ডায়াস্টোলিক মারমার শেখে। লাব ডুব ছাড়া অতিরিক্ত হিস হাস ফুস ফাস টগবগ বগবগ –সব শব্দগুলো বোঝার জন্য কান তৈরী করতে হয়। স্টুডেন্টদের কাছে শুনে শুনে ওর সব মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষার ছাত্রর লঙ কেস পড়ল। ওয়ার্ডে ঘোরাফেরা কম কিনা— ছাত্রের হাত পা ঠান্ডা। বিজয় বলল– কিচ্ছু চিন্তা নেই, এক্সটারনাল এলে, আমাকে সামনের দিকে ঝুঁকে বসতে বলবেন, আর বুকের বাঁ দিকে এইখানটায় নল বসিয়ে বলবেন– শুনুন স্যর, ডায়াস্টলিক মারমার। যদি অনার্স পেতে চান– পালমোনারি হাইপারটেনসন আর ওপেনিং স্ন্যাপের কথাও বলে দেবেন। আর চিকিৎসা হল—
এইসব জটিল ডাক্তারি টার্ম শুধু নয়– ও ছাত্রদের পুরো রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ পড়িয়ে দিতে পারত। সব শুনে শুনে শেখা। নিজে একটা ক্লাস ফোরের ভূগোল বই খুলে বসে থাকত। দুলে দুলে মালভূমি আর উপত্যকার সংজ্ঞা মুখস্থ করত। এবার বাবা বাড়িতে নিয়ে যায় নি, সামনের বার পরীক্ষা দেবেই। হাউসস্টাফ স্বপনদা একটা খাতা কিনে দিয়েছিল, ওকে বাংলা ইংরেজি ট্রানশ্লেশন দিয়ে যেত রোজ, চেক করত। আমিও মুখে মুখে একটু ইংরেজি গ্রামার পড়াতাম। প্রতিদিন রাউন্ডের পর স্যর একটু দাঁড়িয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। স্যর ডাঃ আর কে দত্তরায়! আমার সারাজীবনের গুরু। এক পলক থেমে বলতেন- কি অপচয় –!
মেধা না জীবন– অপচয় কোনটা ও কতটা তা ভাবতে ভাবতে পরের বেডের পেশেন্টের দিকে পা বাড়াতাম।
সেদিন সকালের রাউন্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে দেখলাম–বিজয়ের বেডটা ফাঁকা। বাথরুমে গেছে হয়তো। আগের দুজন পেশেন্ট দেখে ওর বেডের দিকে এগোতেই সিস্টার বললেন– স্যর, কাল রাতে তো —
— কাল রাতে, কি?
— বিজয় মারা গেল।
মাঝে মাঝে কিছু খুব সোজা কথাও আচমকা মস্তিষ্ক নিতে জানে না– মানেটা বুঝতে পারে না। কাল রাতের রাউন্ডেও দেখে গেছি ঠিক আছে। পাস্ট পারফেক্ট টেনস বুঝিয়ে গেলাম।
শুনে যা বোঝা গেল থ্রম্বোএমবলিক কিছু হয়েছিল। হঠাৎ হার্ট থেকে এক রক্তের ঢেলা বয়ে গিয়ে কোনো ধমনীকে আটকে দেয়। এই রোগীদের সে আশঙ্কা থাকেই। চিকিৎসার সময় পাওয়া যায় না, আধুনিক পরীক্ষার যন্ত্রপাতিও তখন হাসপাতালের মুখ দেখেনি।
আমার আর পা সরে না। স্যরও থমকে দাঁড়ালেন। মুহূর্তের জন্য। পর নিমেষেই স্যর গতরাতে ভর্তি হওয়া পাশের বেডের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। এক বিন্দু বাতাসের জন্য মুখ হাঁ করে ছটফট করছে একজন। নিউমোথোরাক্স। যে হাওয়া ঢুকছে তা একটা ফুটো দিয়ে ফুসফুস থেকে বেরিয়ে গিয়ে, চেপে ধরে ফুসফুসকে কাজ করতে দেয় না। বিষয় অন্য, রোগের বিশদে যাব না–আজকাল অত দেখাও যায় না। রুগীকে সেই মুহূর্তে “ওয়াটার সিল ড্রেনেজ” না দিলে মারা যাবে। সিস্টার সেই চিকিৎসার সেট নিয়ে রেডি।
অক্সিজেন নল নাকে লাগানো থাকলেও তা ফুসফুসে যাচ্ছে না– অক্সিজেনের অভাবে রুগীর মুখ ক্রমশ নীল হয়ে আসছে। বুকে দুই পাঁজরের মাঝখানে একটা মোটা ছুঁচওয়ালা নল ঢুকিয়ে, নলের অপর প্রান্ত নীচে রাখা স্যালাইন বোতলে গুঁজে দেওয়া। একাজ প্রায়ই করতে হত তখন। অভ্যাস ছিল। তবু ছুঁচ ফোটানোর জায়গা নির্বাচনে ছুঁচ পরিমাণ ভুল হলে সমূহ বিপদ। সতর্কতার সঙ্গে করে ফেলা হল। ম্যাজিকের মতো কাজ দেয়। পাঁচ মিনিটেই রুগী ফুরফুরে।
বিজয়ের জন্য মনখারাপ যে আমাদের কতখানি ছিল– আজও আছে, আরো কত “বিজয়”-এর চলে যাওয়া মনে গিরিখাত এঁকে রাখে— কিন্তু ডাক্তারের জীবনে এক নিমেষ থমকে দাঁড়িয়ে শোক সহনীয় করার পরিসরটুকুও নেই। পরবর্তী রুগী যে অপেক্ষা করছে– সে এখনো শ্বাস নিচ্ছে –তাঁর বাঁচার আশা আছে, তাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন। সে যে শতকরা একশোভাগ মনঃসংযোগ দাবী করে। এক রোগীর মৃত্যুশোক অন্য রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আবেগ বিহ্বলতা গ্রাস করলে, পরবর্তী রোগীর চিকিৎসায় সম্পূর্ণ মনোযোগ না দিতে পারলে– সেখানে কিছু ভুলচুক হলে যে বড় ভুল হয়ে যাবে।
সেদিনের পরিস্থিতি শিখিয়েছিল– ডাক্তারের জীবনে প্রিয় রোগীর মৃত্যু শোকও ফল্গুধারার মতো গভীরে পাঠিয় দিতে হয়। সে মুহূর্তে নির্লিপ্ত ভাবে কাজ করে যেতে হয়। শোকের বীজ অন্তরালে লালিত হতে থাকে– পরে কোনো অবসরের পরিসরে ডালপালা মেলে।
যন্ত্র নয়, কিন্তু যন্ত্রের মতো হতে হয়– এ বড় কষ্টের। এক অধ্যয়নও বটে।
Potrait of Doctor Gachet by Vincent Van Gagh