সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে এসেছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে এসেছে। একটা দুটো ফাঁকা মিনি, টিমটিমে আলো জ্বালা প্রাইভেট ঝিমন্ত যাত্রীকুল নিয়ে বাড়ি ফিরছে। লরির সংখ্যা বাড়ছে। রাস্তা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে। খাবারের দোকানে কিছু লোক বসে খাচ্ছে। একটা দোকানে মা রুটি করছে। বাবা হিসেব করছে, পরিবেশন করছে। কিশোর ছেলেটা খাবার প্যাকেট করে’ খরিদ্দারকে দিচ্ছে। দোকানটার পাশের রাস্তাটা পুকুর পাড় দিয়ে পেছনের গলিতে চলে গেছে। সামনে বড়ো রাস্তা। কোনাতে রয়েছে দোকান।
পেছনের গলিতে আমরা একজন ভদ্রলোককে আসতে দেখছি। পরনে লৎপতে পায়জামা, একটা ফতুয়া, গায়ে একটা চাদর, এলোমেলো জড়ানো। কাবলি জুতো টেনে টেনে আসছে এই খাবার দোকানে। আজ যেন একটু ক্লান্ত। একটু ফ্যাকাশে। এসে পৌঁছতেই কিশোর বললো “গুড ইভেনিং দাদু। বাবা দাদু এসে গেছে”
ছেলেটার মা বললো “কাকু বসো। কি খাবা?”
“ভাত হবে? গরম?”
“সঙ্গে কি দেবো? মাছ আছে, মুরগির মাংস, ডিমের ঝোল…”
বুড়ো একটু দম নেয় “শুধু ডিমের ঝোল, ভাত”
দু মিনিটের মধ্যেই কিশোর একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় ভাত, নুন, লঙ্কা আর একটা বাটিতে করে’ ডিমের ঝোল নামিয়ে দেয়। বুড়ো চাদর সরিয়ে হাতে একটু জল দিয়ে খেতে আরম্ভ করে।
কিশোরের মা জিগ্গেস করে “কাকু, আন্না ঠিক আছে তো?”
বুড়ো ঘাড় নাড়ে “হ্যাঁ রে মা, ভালো হয়েছে”
তারপর যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়।
একটু পরে কিশোরের বাবা প্রশ্ন করে “তুমি কি আজ তরকারিতে বেশী নঙ্কা দেছো নাকি? কাকু বড্ড ঘামছে”
“না তো, কী কাকু ঝাল হয়েছে আন্না?”
বুড়ো মাথা নেড়ে না বলে। আজ যেন একটু অপরিষ্কার করে’ বুড়ো তার খাওয়া শেষ করে। তারপর যেন বড়ো শ্বাসকষ্টে হাত মুখ ধুয়েই তাড়াতাড়ি পকেট থেকে সিগারেট বার করে’ ধরায়। ঘাম বুড়োটার কপাল বেয়ে বেয়ে নেমে আসে। দম খোঁজার চেষ্টায় সিগারেটে টান দেয়, কিন্তু তার মধ্যেই বেঞ্চির ওপর গড়িয়ে পড়ে। হাতের সিগারেট মাটিতে ধোঁয়া ছড়ায়। বুড়োটার জ্ঞান চলে গেছে। কিশোর প্রথমে এগিয়ে আসে। তারপর বাকি দুজন। ফাঁকা রাস্তা কাঁপিয়ে লরি যায়।
“বুড়ো কোথাত্থে আসে জানিস?”
ছেলে উত্তর দ্যায় “না তো”
তারপর সবাই মোবাইল ফোন ঘেঁটে দ্যাখে একটা ফোন নম্বরও সেভ করা নেই। একটা মেসেজও নেই। একটা ফোনও আসেনি। খুব সাধারণ একটা ফোন। হয়তো খারাপ হয়ে গেছে।
একটু পরে একটা অটো দাঁড় করিয়ে, কাছের সাবডিভিশন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।
“ওগো কাকুর বুকের মদ্যি কেমন ঘড়ঘড় করতিছে। অটোওয়ালা জোরে চালাও।” সময় বয়ে যায়।
তারপরে নিষ্প্রাণ হাসপাতাল। তার হ্যালোজেন আলোর তোরণ। আর যান্ত্রিক কথাবার্তা।
“নাম?”
দোকানদার জানে না। নিজের মরা বাবার নামটা বলে।
“আপনার সঙ্গে সম্পর্ক?”
কিন্তু ওয়ার্ডে দেওয়ার আগেই বুড়ো শেষবার নিঃশ্বাস নিয়ে ফেলেছে।ওরা কাগজপত্র নিয়ে মাঝরাতে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।
“আসো, একটু চা খেয়ে নি,আয় রে”
ভ্যানওয়ালা ভ্যানে বডি বাঁধে। কিশোরের কাছে ফোনটা ছিলো। ওটা সে পকেটে ভরে। নির্বাক পরিবার বুড়োর সঙ্গে চলে।
তারপর কাজকর্ম শেষে, ভোরের আলো ফোটে। ছেলেটার বাবা শ্মশানের পুকুরে দেহাস্থি নিবেদন করে।
“খরিদ্দারের কাছেও দোকানির বোধহয় কিচু দেনা থেকে যায়” ছেলেটার মা বলে।
এমন সময় কিশোরের পকেটে ফোনটা বেজে ওঠে। বুড়োটার ফোন। কোনও নম্বর দেখাচ্ছে না। সস্তার ফোন খারাপ হয়ে গেছে। ছেলেটা বাজতে থাকা ফোনটা মুঠোয় ভরে দেহাস্থির সঙ্গে জলের গভীরে ছুঁড়ে দ্যায়।