১ স্বপ্ন অমঙ্গল কাব্য ।
আমাদের আধা পাগল আধা বুড়ো ডাক্তার সদ্য ঘুম বটিকা আর হৃদয়ের ওষুধ খেয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। ওনার স্বপ্নে ঘুরে আসে বাঁকুড়ার সব চরিত্ররা। শৈশব কেটেছে বাঁকুড়ার লাল মাটির দেশে। যেখানে রাস্তা মানেই কাঁকড়। এদিকে ওদিকে ছড়ানো বাবলা আর খেজুরের গাছ। পুকুরের পাড় মাটি ফেলে উঁচু করে রাখা হয় যাতে বর্ষার জল পুকুরে জমে থাকে। বড়ো জলহীন শুকনো জায়গা তো। শীতকালে উত্তুরে হাওয়ায় হাড় কাঁপিয়ে দ্যায়।ছুটির দুপুরে পাড়ার সবাই মিলে সামনের লাল রাস্তায় পাটি পেতে কমলা ছাড়াতে ছাড়াতে রোদ্দুর মাখার পালা – বেলা দুটোয় আকাশবাণী কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের গান আর তারপর সুগম সঙ্গীত।
তখন ডাক্তার সদ্য বালক, তখন ডাক্তার পাঁচ বছর। ঐ পাড়ায় বছর তিনেকের এক নীল চোখের বালিকা ছিলো। যার চুলে ছিলো চাইনিজ কাট। গাবলু গুবলু গাল ফোলা। সেই নীলনয়না শিশু তার সেই অবোধ শৈশবেই ঘোষণা করে দেয় ডাক্তারকেই সে বিয়ে করবে। দু তরফের মায়েরাও সহাস্যে রাজি। অবশ্য তখনও শৈশব প্রবিষ্ট ছেলেটার ডাক্তার হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেখা দেয় নি। বরং মেয়েদের দলে দিব্য নাচ গান করে নাম অর্জন করেছিলো।
তারপর সরকারি চাকরিতে বদলির পরে বদলি । নীলনয়না টোবা গাল আর আমাদের হবু ডাক্তার এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরতে ঘুরতে কে কোথায় গেছে আর জানা নেই। তবু টাকে পাকা চুলের ডাক্তারের স্বপ্নে এখনো তার আনাগোনা। রহস্যময় ভাবে সেই শিশু আজও ডাক্তারের স্বপ্নে কিশোরী আর তন্বী – যদিও ডাক্তার এখন জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত এক বৃদ্ধ। সেই রাতেও ঘুমের বড়ির ঘোরের মধ্যে সেই তণ্বী এসে হাজির। এলো চুল আর সাদা দোপাট্টা বাতাসে উড়িয়ে সেই চিরতণ্বী মেঘ কুয়াশা পায়ে দলে যেতে যেতে কাকে যেন ফোন করছে। কিন্তু কিছুতেই লাইন পাচ্ছে না। তণ্বী ঘেমে যাচ্ছে। ধনুক ভুরুতে ভাঁজ পড়েছে। অবশেষে ফোন বাজলো। ডাক্তার চোখ মেলে অন্ধকার ঘরে ফোনের নীল আলোয় ফোনটা কোনোক্রমে খুঁজে পেলো। আধো জাগরিত তন্দ্রার ঘোরে ডাক্তার বললো “ওরে আমার গুলগুলি, ওরে আমার ফুলকলি – কতো দিন মাস বছর এই ফোনের আশায় বসে আছি।”
ওপ্রান্তে উত্তর এলো “এ্যাঁ? ওনার না একদম ঘুম আসছে না। কি করবো?”
“চলে আয় আমার কাছে। তোর মাথায় চাঁদের আলো মাখিয়ে তোকে ঘুম পাড়াবো – গান শোনাবো তুঁহু মম সন্ধ্যার মেঘমালা … আমার পিয়ারি বনবালা”
হঠাৎ একটা হেঁড়ে চিৎকারে ডাক্তারের ঘুম বটিকার নেশা কেটে গেলো। টাকে ঘাম জমলো। বুঝলো এই ফোনটা স্বপ্নাদ্য নয়। কোনও সুন্দরীর স্বামীর আজ রাতে ঘুম আসছিলো না তাই মাঝরাতে ফোন।
পরের দিন সকালে যখন ডাক্তার চা বিড়ি পান করতে দোকানে যাবে তখন একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। সোওজা থানা – সেখান থেকে হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা (নৈলে জেলে ভরা যায় না)। ডাক্তার বহু চেষ্টা করলো কিন্তু কেউ এই স্বপ্নের কথা বিশ্বাস করলো না। আদালতও এই স্বপ্নিল কাহিনী বিশ্বাস করে নি। সুতরাং ডাক্তার এখন একটা লক আপে বন্দী, যার ছাতের কাছে একটা ঘুলঘুলি মার্কা জানালা। সঙ্গী বহু রকম দাগী আসামী। মুশকিল হচ্ছে পুলিশ ডাক্তারের ফোন, মাইনেব্যাগ আর পকেটে পাওয়া একটা ঘোড়ামুখো দেশলাই বাজেয়াপ্ত করেছে। কারাগারের শিক ধরে ডাক্তার একশো তেত্রিশবার প্রতিজ্ঞা করেছে আর কোনোদিন মাঝরাতের ফোন ধরবে না।
দ্বিতীয় ভাগ
আসলে এটাই পুরোনো ঘটনা। তখন ডাক্তার যুবক। শীতের রাত। ক্ষ্যাপাটে শ্রাবণ এসে শীতের মধ্যে পাগলামি করছে। গাছের মাথা নামিয়ে – জানালা কাঁপিয়ে। একটু রাত বাড়তেই মেঘ থমথম করতে লাগলো। সেই সময়– সহসা ডাক্তারের ছেলে বায়না করলো – কোনদিন পিৎজা খাই নি। আঁমি পিঁৎজা খাঁবো।
তখন কলকাতায় সদ্য লাতিন খাবারটি পৌঁছেছে। সুতরাং চা মুড়ি খেয়ে শীতপোশাক মুড়ি দিয়ে বাপ ব্যাটা স্কুটার ভটভটিয়ে ঢাকুরিয়ার দোকানে চললো। সবে মাত্র যাদবপুর। ডাক্তারের পকেটে ফোনবাদ্য বেজে উঠলো। ডাক্তার মহাকষ্টে তিনটে জামার ভেতর থেকে ফোনটা বার করে কানে দিলো “ডাক্তারবাবু আপনি কি কাল সকালে বসবেন?”
এবং স্কুটার সমেত হুড়মুড়িয়ে পুরো অভিযানের অন্ত্যাক্ষরী হয়ে গেল। স্কুটার রাস্তায় চাকা উল্টে পড়ে রইলো। রাস্তা ভরিয়ে তেল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ছেলেকে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ডাক্তার ভোরের অপেক্ষায় রইলো। কেন না ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে আর কোনও যানবাহন নেই। আসলে তখনই প্রতিজ্ঞা করা উচিত ছিলো আর ফোন ধরবো না।