‘আমার লুঙ্গিটা আবার কোথায় গেল?’ উপরের ঘর থেকে গর্জন করছে মণিমামা।
নীচে রান্নাঘর থেকে শান্তিমাসী পাল্টা গর্জে উঠল। “জানলা দিয়ে উড়ে গেছে। খুঁজে নাও।”
আমি নীচের তলায় বসার ঘরে গতকালের ফুটবল খেলার রিপ্লে দেখছি। ক্রিকেটের দাপটে হোষ্টেলের টিভি রুমে অন্য কোনো খেলা দেখা হয়েই ওঠে না। ফুটবলের রিপ্লে দেখার সুযোগ পাওয়া তো স্বপ্ন। মামাবাড়ির রিমোটটা হোষ্টেলের মত ভাঙা আর রবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা নয়। তবে ভালো মত চিবোনো। মণি মামার পেয়ারের কুকুর রণির কাজ।
মণিমামা ভিজে গায়ে গামছা পরে দপদপিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। গরগরে রাগে নাক দিয়ে প্রায় ধোঁয়া বেরোচ্ছে। চোখদুটো গনগনে লাল। “সামান্য জামাকাপড় গুছিয়ে রাখতে পারো না! সারাদিন খালি রান্নাঘরে। বাড়িতে যে ছুঁচোর কেত্তন চলছে সে খেয়াল আছে! বলি, এটা বাড়ি, না হোষ্টেল?”
হোষ্টেল সম্বন্ধে শান্তিমাসীর বিন্দুমাত্র ধারনা থাকার কথা নয়। ছোটবেলায় চারটে বিভিন্ন শহরের গার্লস স্কুলে পড়ার পরে হাওড়ায় ফিরে এসে সেই বিজয়কৃষ্ণ গার্লস। মিলিটারি মেজর ফণীভুষণ সমাদ্দার তাঁর মেয়েদের হোষ্টেল তো দূরস্থান, কো-এড স্কুল বা কলেজে পড়তে দেন নি ! সুতরাং হোষ্টেলের ভেতরে যে কি চলে সে অভিজ্ঞতা শান্তিমাসীর না থাকাই স্বাভাবিক।
কিন্তু মণিমামার সাথে ঝগড়ায় পিছিয়ে পড়লে চলবে না।
তাই শান্তিমাসীর ঝাঁঝালো উত্তর এল রান্নাঘর থেকে। “বাড়ির প্রতি কোনো দায়দায়িত্ব নেই। আবার বলছে- বাড়ি না হোষ্টেল? বলি বাড়িটা গুছিয়ে রাখে কে? তোমার পেয়ারের অপদার্থ নেড়ি?”
“খবরদার! রণি নেড়ি নয়, অ্যালসেশিয়ান। অত্যন্ত শিক্ষিত কুকুর।”
“হ্যাঁ। বোঝা গেছে। তোমার কুকুর, তোমার মতই শিক্ষিত। ভীতুর ডিম। এর জায়গায় সত্যিকারের একটা নেড়ি থাকলে বাড়িটা অন্ততঃ পাহারা দিত।”
শান্তিমাসীর বচন শেষ হতে হতে বাগানের দিক থেকে চোরের মত নিঃশব্দে মুখ বাড়ালো রণি। খালি মুখে নয়। ছিঁড়ে ফালাফালা করা মণিমামার কাচা লুঙ্গী মুখে নিয়ে।
“নাও, পেয়ারের অ্যালশেসিয়ান মনিবের লুঙ্গী নিয়ে এসেছে। পরে ফেলো। আমি কেবল লুঙ্গী কিনে আর কেচে মরি। কপাল আমার!”
মণিমামা সুড়সুড় করে দোতলায় উঠে গিয়ে একটা ধুতি দুভাঁজ করে পরে ফেলল।
“কুকুরটার একটা ব্যবস্থা কর পলু। তোদের যাদবপুরের দিকে ছেড়ে দিয়ে আয় না হয়।”
কুকুর কি হুলো বেড়াল নাকি,যে ট্রেনে করে কোনো অচেনা স্টেশনে নামিয়ে আসা যাবে!
রান্নাঘরে গিয়ে আস্তে আস্তে ফিসফিস করে মাসীকে বললাম,
“বাবাকে বলে দেখি, কিছু ব্যবস্থা করতে পারে কি না।”
শান্তিমাসী মুখ বেঁকিয়ে চোখ তেরছা করে এমন একটা দৃষ্টি হানলো, যার অর্থ হয়, “বাইরের লোককে আবার এর মধ্যে জড়ানো কেন?”
বাবা যে জনান্তিকে এই বাড়িকে পাগলা গারদ বলে, সে খবর মাসীর কাছে আছে।
আজ রবিবার নয়। কিন্তু জন্মাষ্টমী। ইউনিভার্সিটি ছুটি। তাই চলে এসেছি মামার বাড়ি। শান্তিমাসী জন্মাষ্টমীর পুজো করে। প্রসাদে লুচি,মিষ্টি,তালের বড়া,তালের ক্ষীর ইত্যাদি সুখাদ্যের লোভে আমিও হোষ্টেল ছেড়ে পৌঁছে যাই শিবপুর। খাবারগুলো সব এতটাই ভালো হয় যে, মণিমামার পাগলামো, শান্তিমাসীর ঝগড়া- কোনকিছুই গায়ে লাগে না।
ছোলার ডাল আর বেগুনভাজা সহযোগে গোটাদশেক লুচি, দুটো দরবেশ বেশ সাঁটিয়ে সবে তালের ক্ষীরের বাটিটা ধরেছি, ওমনি মণিমামার বাজখাঁই গলা ভেসে এল। “খাইয়ে খাইয়েই ভাগ্নেটাকে মেরে ফেলবে! ওসব ছাইপাঁশ খাসনে পলু- মোটা হয়ে যাবি। তুই বরং আমার সাথে চল।”
“কোথায়?”
“চেম্বারে?” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল মণি মামা।
শান্তি মাসী মণিমামা আর আমাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল।
“একদিন ছুটিতে এসেছে! ছেলেটাকে তোমার গোয়ালে না নিয়ে গেলেই নয়?”
“গোয়াল? কিসের গোয়াল? হাসপাতাল, চেম্বার হল ডাক্তারদের কাছে পবিত্র মন্দির- ওসব তুই বুঝবি না। সংসার নিয়ে আছিস, তা নিয়েই থাক।”
“হুঁ, পবিত্র! যত্তসব মল, মুত্র, কফ,রক্ত,কাটা-ছেঁড়ার ব্যপার। জন্মষ্টামীর দিন ছেলেটাকে না ওর মধ্যে না ফেললে চলছে না।”
“শোন পলু চেম্বারে দুয়েকদিন কাজকম্ম শিখলে একটা ওষুধের দোকান দিতে পারবি। তোর যা হাল, যাদবপুরে পড়ে তো আর চাকরি-বাকরি জুটবে না। তার চেয়ে এই ভালো।”
মণিমামা আমাকে প্রায় বগলদাবা করে তার সাদা অ্যাম্বাস্যাডারে তুলল।
(চলবে)