আমার বাবা আমার হিরো বা আমার মা পৃথিবীর সেরা মা – আঁকাবাঁকা, ছোট-বড় অক্ষরে, ভুল বানানে, সঙ্গে দুটো ফুলের ছবি, একটা বড় হার্টের ছবি-এমন কার্ড আমি পেয়েছি। আপনিও নিশ্চয়ই পেয়েছেন। সব মা,বাবাই পেয়েছেন। শিক্ষক, পুলিশ, সরকারী কর্মচারি বা দোকানদার- সবার বাচ্চার কাছে তার বাবা, মা ই সেরা। তাদের জীবিকাই পৃথিবীর সেরা জীবিকা।
আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিল বিশু। বিশুর বাবা সুমন কাকু সরকারি বাসের কন্ডাকটর। বিশু ছোটবেলায় আমাদের একটা নতুন খেলা শিখিয়েছিল। আমরা জানলার রড ধরে ঝুলতাম আর চেঁচাতাম ‘টিকি্ট, টিকিট’ বলে। আমাদের দু হাতের আঙুলের মাঝখানে কাগজ ভাঁজ করে রাখতাম, যেমন কন্ডাকটররা টাকা রাখে সেভাবে। একদিন হল কী, পাড়ার বিভূতি জেঠু সাইকেল রিকশা করে বাজার থেকে ফিরছিলেন। রিক্সাওয়ালা ঠিক করে ধরে না রাখার জন্য রিকশাটা নড়ছিল। আর জেঠু নামার সময় ব্যালান্স রাখতে পারছিলেন না। এমন অবস্থায় বিশুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘আস্তে লেডিজ কোলে বাচ্চা’। পরদিন সকালে সুমন কাকু পাড়ার মুচির কাছে চপ্পল্টা নিয়ে গেছিল পেরেক মাড়তে।
তখন স্কুল বাস ছেড়ে পাবলিক বাসে করে যাতায়াত শুরু করেছি। বাস আস্তে চললে ড্রাইভার, কন্ডাকটরদের বাবা, মাকে নিয়েও কিছু ‘ভদ্রলোক’ গালাগাল দিত। আমার শুনতে খারাপ লাগতো। কারণ সব কন্ডাকটরই তো আমাদের কাছে সুমন কাকু। একদিন বাসে যাওয়ার সময় একজন যাত্রী কন্ডাকটরের মাকে নিয়ে গালাগাল দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেলেন, ‘দেখুন আমরা দুজনেই ভারত মায়ের সন্তান। আপনি নিজের দেশকেও গালি দিলেন আর নিজেকেও’। সেই লম্বা, রোগাটে ছেলেটা আমার কাছে আজও হিরো।
তনুর বাবা দমকলে কাজ করতেন। তনুর কাছ থেকে আমরা শুনতাম ওর বাবার কাজের কথা। একবার উঁচু বাড়িতে কার্নিশে মই বেয়ে উঠে ওর বাবা কীভাবে একটা বাচ্চাকে নামিয়ে এনেছিলেন। কাকু ছিলেন আমাদের ছোটবেলার অরণ্যদেব। তনুও দমকলে কাজ করার স্বপ্ন দেখত। একদিন দেখি আমাদের সেই অরণ্যদেব মাথায় আর চোখে ব্যান্ডেজ বেধে ফিরছেন। আমরা ভাবলাম কাকু বিশাল অ্যাডভেঞ্চার করেছেন। আমরা গল্প শোনার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। কিন্তু তনু পরদিন খেলতে এল না। বেশ কয়েকদিন পরে জানাল, দমকলের গাড়ি দেরি করে যাওয়ার জন্য এলাকার লোকেরা ইট ছুড়ে মেরেছিল। কাকু এখন চোখে ভালো দেখতে পাচ্ছেন না। দশ বছর বয়েশেই তনুও ঠিক করে নিল কোনদিন দমকলে কাজ করবে না আর বুঝে গেলো ‘ শালা পাবলিকের ভালো করতে নেই । ‘
আর আমার পাশের বাড়ির নাড়ু কাকু পুলিশে চাকরি করতেন। বাড়ির সবাই ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক হলেও কাকু একা ছিলেন মোহনবাগানের সমর্থক। ১৯৮০ সালের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের সেই কলঙ্কিত খেলা যেখানে ১৬ টা তরতাজা প্রাণ চলে গেছিল সেদিন মাঠে ডিউটি পড়েছিল কাকুর। দর্শকের ছোড়া পাথরে নাক ভেঙে গেছিল। অল্পের জন্য বেঁচে যায় চোখ। কাকুর দুই ছেলে যারা বাবার মতো পুলিশে চাকরি করার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়ে উঠছিল তাঁরা সেই স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দেয় চিরদিনের জন্য।
আমাদের সহপাঠী রঞ্জনার স্বপ্ন ছিল মায়ের মতো কলেজে পড়ানোর। কিন্তু যেদিন দেখলো কলেজ কমিটির সবচেয়ে অশিক্ষিত সদস্য তার অধ্যক্ষ মায়ের দিকে টেবিলে রাখা জলের গ্লাস ছুড়ে মারলো সেদিন থেকে শপথ নেয়, জীবনে আর যাই করুক কলেজে পড়াবে না।
এইভাবেই আমরা যখন বেড়ে উঠছিলাম তখন আমাদের মধ্যে কেউ বড় হয়ে নার্স, কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষক বা কেউ পুলিশ হতে চাইতাম বা কেউ বাবার মতো দোকান চালানোর কাজটাকেই নিজের পেশা করার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু যখন সেই পেশার লোকেদের অপমানজনক বা শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হতে দেখতাম তখন মনে মনে ভীষণ দুঃখ পেয়ে তার থেকে সরে আসতাম।
আমাদের বাচ্চারা যদি আর শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স দমকল কর্মী হতে না চায় তাহলে সমাজটা চলবে কী করে? আমরা বাসের গায়ে ‘আপনার ব্যবহার আপনার পরিচয়’ পড়েই বড় হয়েছি। কিন্তু একবারও ভাবতে শিখিনি ওই ‘আপনি’ টা হলাম আমি। ‘আমার ব্যবহারই আমার পরিচয়’।