প্রায় সাতাশ বছর আগের কথা। এক হেমন্ত সন্ধ্যায় কুড়ি-পঁচিশ বছরের একটি তরুণী আমার কাছে ভর্তি হলো। তার কোমরের নীচে থেকে দুটি পা সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে সবচেয়ে নীচুতলার কর্মী, তার স্বামী আদিবাসী যুবকটি, আমায় জানালো যে প্রায় দু সপ্তাহ হলো তার স্ত্রীর এই অবস্থা হয়েছে।
তৎকালীন বিহার, অধুনা ঝাড়খণ্ডের এক প্রত্যন্ত গ্রামে তার বাড়ি। বাড়ি থেকে স্ত্রীকে, খাটিয়ায় বয়ে নিয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে, তারপর ট্রেন বদল ইত্যাদি, অনেক ঝক্কি পুইয়ে অবশেষে এই হাসপাতালে সে আসতে পেরেছে।
রোগিনীকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখি, অপুষ্টিতে ভোগা শরীর, রক্তাল্পতাও রয়েছে। দুটি পা সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত, সেই সঙ্গে মল ও মূত্রত্যাগের সমস্যাও বতর্মান। তার শীর্ণ নাবালক দুটি সন্তান, তাদের বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
পরদিন রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে দেখলাম, রক্তাল্পতা রয়েছে, ই.এস্.আর. খুবই বেশি। মেরুদণ্ডের এক্স-রে-তে দেখা গেল ওর লাম্বার দুই বা তিন (সঠিক মনে নেই) নম্বর কশেরুকাটি (vertebra) সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত। সম্ভাব্য ডায়াগনসিস, মেরুদণ্ডের যক্ষ্মা। সেই সময় সি. টি. স্ক্যান বা এম. আর. আই. এসব বহু দূরের স্বপ্ন। আমাদের দৌড় ঐ এক্স-রে অবধি। মেরুদণ্ডের যক্ষ্মায় সাধারণত সেই ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় একটি ফোঁড়া দেখা যায় যাকে ‘শীতল ফোঁড়া’ (cold abscess) বলে। এই রোগিনীর সেটি দৃশ্যমান ছিল না।
ওর জন্য যক্ষ্মার ওষুধের পুরো রেজিম চালু করা গেল। সমস্যা হচ্ছে শুধু মাত্র ওষুধ দিয়ে এই ধরনের সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর চিকিৎসা অসম্ভব।
সেই সময় আমাদের ‘বেড সোর’ প্রতিরোধী কোন শয্যা ছিল না। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একবার খুব কুণ্ঠিতভাবে এই ধরনের শয্যার আবেদন করেছিলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিলেন তা মতি নন্দীর ভাষায় ‘মন্দিরে জুতো পরে কাউকে ঢুকতে দেখেছেন’। অতএব সে আবেদনের সেখানেই ইতি। মল ও মূত্রত্যাগের সমস্যাযুক্ত, সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত এই ধরনের রোগীর ভবিতব্য, সাধারণত বেড সোর, জীবাণুর সংক্রমণ ও অন্যান্য জটিলতা যা ক্রমশ বেড়েই চলে। চোখের সামনে এই তরুণীটির অন্তিম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়াটা মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিল।
শল্য চিকিৎসা একটি উপায় হতে পারে, কিন্তু আমাদের কোন স্নায়ু শল্য চিকিৎসক নেই, এমনকি কোন ভিজিটিং অস্থিশল্যচিকিৎসকও নেই। রোগিনীকে কোথাও রেফার করারও কোন উপায় নেই। যদি কিছু করতে হয় আমাদেরই করতে হবে। আমি জীবনে এই ধরনের একটি মাত্র কেসে, শল্যচিকিৎসকের প্রথম সহকারী ছিলাম। কিন্তু সেটি ছিল থোরাসিক কশেরুকার যক্ষ্মা, যেখানে ‘কস্টোট্রান্সভার্সেকটমি’ অপারেশন করা হয়েছিল। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত কশেরুকাটির ট্রান্সভার্স প্রসেস এবং সেই সঙ্গে জুড়ে থাকা পাঁজরের হাড়ের অংশ কেটে যক্ষ্মা আক্রান্ত কশেরুকাটির মরে যাওয়া অংশ, পূঁজ ইত্যাদি পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। লাম্বার কশেরুকার এই ধরনের অস্ত্রোপচারের কোন অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। আমার কাছে অস্থিশল্যচিকিৎসার যে প্রামাণ্য পুস্তকটি ছিল সেও এই অস্ত্রোপচার সম্পর্কে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। যাই হোক সিদ্ধান্ত নিলাম এই তরুণীটিকে বাঁচানোর চেষ্টা আমি করব।
আমার সৌভাগ্য যে আমার অ্যানাস্থেটিস্ট সহকর্মী আমার সিদ্ধান্তে মান্যতা দিয়েছিলেন। উনি এই রোগিনীর অ্যানাস্থেসিয়া দিতে রাজি হয়েছিলেন। যেহেতু আমাদের কোন ইমেজ ইন্টেন্সিফায়ার ছিল না, অস্ত্রোপচারের সময় ক্ষতিগ্রস্ত কশেরুকার সঠিক লেভেল চিহ্নিতকরণের জন্যে আদ্যিকালের মার্কার এক্স-রে ফিল্ম ব্যবহার করেছিলাম। অস্ত্রোপচারের জন্য রোগিনীকে অ্যানাস্থেসিয়া দিয়ে উপুড় করে শোয়ানো হল। যদি এই রোগিনীর খারাপ কিছু হয়ে যায়, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বদান্যতা এবং কর্মী ইউনিয়নগুলির অসীম অনু্রাগে, আমার জন্য যে রাস্তা খোলা থাকবে, তা খুব কুসুমাস্তীর্ণ হবে না। তাই শরীরে যে পরিমাণ স্ট্রেস্ হরমোন ক্ষরণ হচ্ছিল তা সহজেই টের পাচ্ছিলাম। একটা ভালো জিনিস ছিল, রোগিনী শীর্ণ হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত কশেরুকাটির ট্রান্সভার্স প্রসেস সহজেই হাতে অনুভব করা যাচ্ছিল, সেটিকে কেন্দ্র করে অর্ধচন্দ্রাকার ভাবে চামড়াটি কাটলাম, একে একে চর্বি, ফ্যাশা, মাংস, লিগামেন্ট, স্নায়ুর জঙ্গল সরিয়ে হাড়ে পৌঁছলাম, বোন নিবলার্ দিয়ে অল্প অল্প করে ট্রান্সভার্স প্রসেসটি কাটতে থাকলাম। হঠাৎ গলগল করে পূঁজ বেরিয়ে এল। পূঁজ ফ্যাঁকাশে সাদা, একদম ‘কোল্ড অ্যাবসেস’-এর পূঁজ। আমার অ্যাড্রেনালিন ক্ষরণ কিছু কমলো। ভালো করে সব পূঁজ, মরে যাওয়া হাড়ের টুকরো পরিষ্কার করলাম। তারপর স্তরে স্তরে সব কিছু সেলাই করে দিলাম।
দুদিন পরেই আমার রোগিনী পায়ের আঙুল নাড়াতে পারলো। ফিজিওথেরাপি শুরু করা হল। আস্তে আস্তে মল ও মূত্রত্যাগের সমস্যাও মিটলো। শীর্ণ শরীরের ওজন কিছু বাড়লো। আমাদের লিম্ব সেন্টার থেকে একটি স্পাইনাল ব্রেসের ব্যবস্থা করা গেল। রোগিনী এখন নিজে নিজে বসে সব কাজ করতে পারে। প্রায় দু মাস বাদে ওকে ছুটি দিলাম, ও নিজেই হেঁটে বাড়ির পথে রওনা হল। যখন আমার দিকে একবার তাকালো, সাঁওতাল রমণীর সেই মুখ ছিলো অশ্রু ঝলোমলো, কিন্তু তা মোনালিসার হাসির চেয়েও উজ্জ্বল।
17 Responses
দারুন ,অসাধারণ
অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন ।
অপূর্ব!
☺️
কুর্নিশ আপনাকে 🙏 ।
Thank you very much.
মোনালিসা মন কেড়েছে, ধন্য “দ্য ভিঞ্চি”।
সেলাম সাহেব,এলেম বটে, ছাতি 56 ইঞ্চি ।।
সমাজের cold abcess, যত পচা হাড়।
ধুতাম যদি,সততাকে করে গলার হার।।
পরতে পরতে সেলাই দিতাম,অবিচারের ক্ষত।
সুস্থ সমাজ,দামী হাসি,দেখতাম আপনার মত।।
ভালো থাকুন,আলো জ্বালুন,দাড়িয়ে সবার পাশে।
প্রশাসকের কাজ জুটেছে,আমরা কিন্তু আশে।।
well done Aniruddha
🙏 sir.আপনি সত্যি ই ম্যাজিসিয়ান
আপনার অভিজ্ঞতা গুলি পড়তে খুব ভালো লাগে। যে কোনো প্রাইজ পাওয়ার থেকেও, এইসব কাজ কর্ম আপনাকে অনেক আত্মতুষ্টি দেয় নিশ্চিত। ভালো থাকবেন। আমার প্রণাম নেবেন।
Darun, tomar jhulite arokom onek ghotona achhe, amader r o sonao pl.
Bhison bhalo laglo pore, dr, babu wish you all the best , I dream of my son being an able dr
চারপাশের এত অবক্ষয়ের মাঝে এই লেখাগুলিই বিশ্বাস ফেরায়। মনে হয় বলে উঠি ‘প্রাণ আছে!’ ধন্যবাদ আপনাকে।
জড়িয়ে ধরে আদর করি!
কুর্ণিশ!
অসাধারণ লেখনী। ভালো থেকো। অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই।
Apnake Pranam janai sir🙏
আমাদের দেখা হয়নি তবে টেলিফোনে কথা হয়েছে । আমি পল্লবের সিনিয়র বন্ধু ১৯৯৬ সালে কলকাতায় ফিসটুলা জাতীয় কিছুর চিকিৎসা নিয়ে আলাপ করেছিলাম । তার আগে আমি বড় বড় ক্লিনিকের ডাক্তারদের অপারেশনের খরচ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম । আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম ফিরে আসব । আপনার ইচ্ছের কথা আমার এখনো মনে পড়ে । আমি ভাল আছি । আপনি কি এখনো প্রাকটিস করছেন ?
ভাল থাকবেন ।