Shampa Shuchismita Ray তাঁর সদ্য রিটায়ারমেন্টের অভিজ্ঞতা ভারি মেদুর কলমে লিখেছেন। রিটায়ারমেণ্ট ব্যাপারটা পুরোনো চেনা খোলস ছেড়ে নতুন জীবনে যাওয়া।
আমি রিটায়ার করেছি সেই কবে। কিন্তু এখনও সেভাবে কিছু লেখা হয়ে ওঠেনি।
তা বাপু, কুঁজোরও তো মাঝে মধ্যে চিত হয়ে শুতে সাধ হয়, না কি? আজ্ঞে হ্যাঁ, আমারও অ্যাদ্দিনে সে সাধ হয়েছে। মনে পড়ে গেছে, আমিও, এই মাত্রই সে’দিন বিশ সালের মে মাসের শেষে রিটায়ার করেছি, সেই কথা।
সেই ভাবে ধরলে, আসলে মনে প্রাণে কিন্তু আমি রিটায়ার করেছি, ২০১৭র অক্টোবরেই। ওই সময়েই আমি সাসপেন্ডেড হই। ভীষ্মের যেমন ছিল স্বেচ্ছামৃত্যু বর, চাকরির শেষদিকে আমিও ভাবতাম, স্বেচ্ছাঅবসর বর চাই আমার। যেন তেন প্রকারেণ। সেই বর আমি অর্জন করেছিলাম।
যদি বিরক্ত না হন, আমার চাকরির গল্পটা খুলে বলি। ডাক্তারি পাশ করার পর, প্রাইভেট প্র্যাকটিসের শখ মোটেই ছিল না, তা নয়। তবে কিনা এই সরকারি কেরানির ছেলের অতি সতর্ক দৃষ্টি ছিল, লোভও ছিল সরকারি চাকরির জন্যেই। নতুন ডাক্তারদের জন্য এখনকার মত বেসরকারি ঘণ্টাপিছু হিসেব তখন ছিল না। কিম্বা ছিল হয় তো। কেরানির ছেলে অত কিছু জানত না।
আসলে আমরা পারিবারিক ভাবেই মূর্খ। নইলে ১৯৭১এ কংগ্রেস অধিবেশন হওয়া বালি-সমুদ্র সল্ট লেক দেখে বাবা-কাকা-জ্যাঠারা কেউই কেন আন্দাজই পাননি, ওইখানে একখণ্ড জমি সংগ্রহের উপকারিতা। তাঁরা অযথাই শিকড় গেড়েছেন বারাসত-সোনারপুর-ফরাক্কায়। বাবা না হয় কেরানি ছিলেন, ধনকাকু তো তখন মিলিটারির মেজর। সেই ঊষর সল্ট লেকের বালির দানায় ঝিকমিক করা স্বর্ণরেণু দেখতে পাননি তাঁরা। দেখতে হয়তো চানওইনি। মায়োপিক দৃষ্টির সেই পূর্বপুরুষের জন্য করুণা করার যোগ্যতা আমারও নেই। আমিও তো অনেক পরের নিউ টাউনে জমি বিলির সময়ে উদ্যমহীন ছিলাম।
যাক গে, যা বলছিলাম। হ্যাঁ, চাকরি জোগাড় করার কথা। এমবিবিএসএর পর চেষ্টে ডিপ্লোমা করলাম। তারপর আবার এক ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হলাম। ডিটিএম অ্যান্ড এইচ। ট্রপিক্যাল স্কুল অফ মেডিসিনে। বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলল, – অসুখ করেছে তোর। রোগটার নাম মালটিপল ডিপ্লোম্যাটোসিস।
আসলে এই ভর্তি হওয়াটা নিছক পড়ার জন্য নয়। তখন আমি পূর্ণ বেকার। বাবা, মা এবং গিন্নি, তিনজনেই কর্মরত। চুঁচুড়ার ভাড়াবাড়ি থেকে সকালে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হতাম। বাড়ির লোকেরা জানত ক্লাস করতে যাচ্ছি। বেকার ছেলেকে সবাই আলগোছে আড়ালে ডেকে দৈনিক ভাতাটি দিত। অম্লান বদনে তিনজনেরই কাছ থেকে প্রাপ্য বুঝে নিয়ে বেরোতাম। ক্লাসে না, আসলে যেতাম রাইটার্সে। পিএসসির ফার্স্ট লিস্ট, সেকেন্ড লিস্টে নাম নেই। তখন ঘোরাঘুরি করতাম পিএসসির থেকে আসা প্যানেল লিস্ট যাতে ক্যানসেল না হয়ে যায়। এখনকার মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটদের মত চাইলেই চাকরি অবস্থা তখন ছিল না।
তো, কিছুদিন পর সেই থার্ড লিস্টে চান্স পাওয়া সাত রাজার ধন এক মাণিক চাকরিতে ঢুকলাম। আটান্ন বছর অবধি দাসত্ব করতে হবে এই জেনে।
দিন গেল দিনের নিয়মে। চুল পাকল। শেষে ভুরুও। কপালে বলিরেখা। কিন্তু কোথায় কী, আটান্নর মেয়াদ বেড়ে ষাট হল। মধ্যবিত্ত মন প্রতিবাদ সহকারে উল্লসিত হল। ষাট থেকে বেড়ে আবার বাষট্টি। এক তরফা সরকারি সিদ্ধান্ত। এবারে আর উল্লাস নয়। বিরক্তির একশেষ। এবং তারপরেই এল শেষ আঘাত… বাধ্যতামূলক পঁয়ষট্টি।
বিধান সভায় বিল এনে স্বেচ্ছা অবসর আটকে দেওয়া হল। বাষট্টির পরই আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, রিটায়ার নইলে তার কাছাকাছি কিছু একটা পেতেই হবে। মধ্যবিত্ত মনের গতি অতি কুটিল ও জটিল। ইংরেজিতে সে আমায় বোঝালো, হয় পেনশন নয় সাসপেনশন কিছু একটা আদায় করতে হবে। পেনশনে মাইনের আদ্ধেক পাব, সাসপেনশনেও তাই। ক্ষতি নেই কোনও।
সেই মত চেষ্টা করে আপনাদের এই ফেসবুকেই কিছুমিছু একটা লিখে, তবে পেলাম সেই শান্তির খোঁজ। শুয়োরের বাচ্চারা বুঝতেই পারল না টোপ গিলেছে। সাসপেন্ড করল আমাকে। বিনা কাজে হাফ মাইনের ব্যবস্থা করে ফেললাম ব্যাটাদের বুঝতে না দিয়েই। বন্ধুরা কেউ কেউ সঙ্গোপনে ঈর্ষাটা প্রকাশও করে ফেলল, – মাইরি, আমাকেও ওইরকম লিখে দিবি দু’ছত্তর?
গালাগালি ব্যবহার করলাম বলে, এইখানে আমার ভ্রুকুঞ্চিত সংস্কৃতিমান পাঠিকা ও পাঠকদের কাছে মাফ চাইছি।
আমার স্বর্গীয় পিতৃদেব নিজে কখনওই গালাগালি দিতেন না। ক্রুদ্ধ আমি আমার দুই সন্তানকে কখনও কখনও সাব-অল্টার্ন শব্দে গালি দিলে, উনি বলেছিলেন, – শোন, খারাপ গালি দিতে খুব ইচ্ছে করলে নিজের ছেলেদের শুয়োরের বাচ্চা বলবি।
অবাক আমি, জিজ্ঞেস করেছিলাম, – কেন?
বাবা বুঝিয়ে বলেছিলেন, – ও রে, ওদের ওই গালি দিলে তো তুই তো নিজেই নিজেকে শুয়োর বললি। নিজেকে গালাগালি দিলে দোষ হয় না। উপনিষদে বলেছে আত্মানং বিদ্ধি।
তো মানুষের মানে আমাদেরই ভোটে নির্বাচিত সরকারও তো একরকম আমাদের সন্তানতুল্যই। তাকে শুয়োরের বাচ্চা বললে নিজেকেই শুয়োর বলা হয় আজ্ঞে! আত্মানং বিদ্ধি!
এই ভাবে, ঠিক বাষট্টিতে না হলেও সাড়ে বাষট্টিতে অবসর গোছের কিছু একটা জোগাড় হয়ে গেল। সেই সঙ্গে পেয়ে গেলাম, সাসপেনশনের দরুন একটা সিউডো-শহিদ ইমেজ। খুব মিছিল টিছিল হল আমার চাকরির স্মৃতিতে। মিছিলের সামনে থাকা অন্তত একজনের এখন যদিও, শুয়োরছানাদের সঙ্গে বেজায় ইয়ে…। যাক সে কথা।
ইতিমধ্যে আমার বয়স বেড়েছে। বয়স আর অসুস্থতা বেড়েছে আমার বাবা মায়েরও। তাঁদের দেখাশুনো করলাম মাঝের বছরগুলোতে… যেটুকু পারি। আমার বয়স পঁয়ষট্টি হবার মাস চারেক আগে হুঁস ফিরল বাবুদের। আমাকে জানানো হল, পুনর্বহাল হতে হবে। ওই অতি বুদ্ধিমান গাধাদের হাতে অস্ত্র বলতে একটাই। এরা জানে রাশিয়া হলে পাঠাতে হত সাইবেরিয়ায়। আর সেই রাশিয়ান ভাষায় অর্ডারটির বাংলা অনুবাদ হচ্ছে, এক্ষুনি উত্তর বাংলায় যাও, পাহাড়ে। ব্যাস, রাজু বন গয়া কালিম্পংইয়ান।
সে এক স্বর্গে পোস্টিং হল আমার যেন বা। যদিও বাবা, যাঁর হাত কালের নিয়মে আমায় ছাড়তেই হত, চলে গেলেন এই অবকাশেই। কিন্তু, তবু বলি, ওই ইয়ের বাচ্চাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
কালিম্পং নামের প্রায় স্বর্গীয় পোস্টিংয়ের জন্য আমার এই কৃতজ্ঞতা।
যেমন ভালো আর সহানুভূতিশীল সুপারিন্টেন্ডেন্ট তেমনই চিকিৎসক-অচিকিৎসক সহকর্মীরা আর পরিবেশ। সমতলের অনেক জায়গার চেয়ে গড় উচ্চতায় অনেক ওপরে।
এতদিনে আমি সরকারি ভাবে চাকরি থেকে চিরকালীন সেই রিলিজঅর্ডার পেলাম। সেই সঙ্গে পে কমিশনের পালিশ পেয়ে কিঞ্চিৎ চকচকে পেনশনও। পেনশনটা বেশ একটু ঝামেলায় ফেঁসে যাচ্ছিল এই কোভিডের বাজারে। প্র্যাকটিক্যালি গেছিলও।
কিন্তু আমার এমনই ভালো ভাগ্য, এক সহোদরাপ্রতিমা মেয়ে, মেয়ে বলছি বটে, আসলে মস্ত সরকারি অফিসার, একসময় প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলও ছিলেন, তিনি পরম মমতায় পুরো ব্যবস্থা করে দিলেন। এই সেদিন অবধিও, আমি পুরো পাওনা না পাওয়া অবধি তাঁর উদ্বেগ কাটেনি। আক্ষরিক অর্থেই।
জীবনের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। যদিও প্রথামত ফেয়ারওয়েল পাইনি কালিম্পং থেকে বিদায়ের সময়ে। একে মাত্র মাস চারেকের জন্য গেছি। সেই ভাবে জানাশোনাই হল না। তায় কোভিডের বাজারে রিলিজ্ড। কিন্তু পরে আমার সেই আক্ষেপ ষোলো আনা মিটিয়ে দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস। আমাকে সেখানে রীতিমতো ফেয়ারওয়েল দিয়েছে রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আমার সহকর্মীরা।
যে কথাটা বলার জন্য এই লেখাটা লিখতে প্রলুব্ধ হলাম সেই কথাটা এ’বারে বলি? শম্পা শুচিস্মিতা লিখেছেন, তাঁর নিজের রিলিজ অর্ডার তাঁকে নিজেই টাইপ করে নিতে বলেছেন ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার। আমি কিন্তু এর চেয়েও অনের উঁচু মানের… বস্তুত ক্ষমার অযোগ্য বেয়াদবি করেছি চাকরি জীবনে।
সার্ভিস কোটায় এম.ডি.তে চান্স পেলাম ১৯৮৯ সালে। তখন আমি স্বয়ং একটা হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্ট। হেলথ সার্ভিসে এই রকম সিচুয়েশনে রিলিভার পাওয়া খুব কঠিন, তাও আবার সুপারিন্টেন্ডেন্ট। এ দিকে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।
কী করা। অতএব নির্বোধ সাহসী অরুণাচল নিজেই নিজেকে একটা রিলিজ অর্ডার বানিয়ে রিলিজ করল,
– অরুনাচল দত্ত চৌধুরী ইজ হিয়ারবাই রিলিজড… ইত্যাদি। তলায় তার নিজেরই সই।
সুপারদের সার্ভিস বুক থাকত জেলা সদরে সিএমওএইচের কাছে। তখন সেই পোস্টে ছিলেন সোমনাথ কী যেন। নতুন জায়গায় জয়েন করার পর সার্ভিসবুক উদ্ধার করতে তাঁর কাছে গেছি। তিনি তো চোখ কপালে তুলে অবাক।
গর্জন করে বললেন,
– ক্ষী কাণ্ড! তুমি নিজেকে নিজেই রিলিজ করেছ! এ সার্ভিস বুক আমি কিছুতেই ছাড়ব না। এ’টা মিউজিয়ামে যাবে। নইলে জাতীয় মহাফেজখানায়, ফর ফিউচার রেফারেন্স!
পরের সপ্তাহে কোনও কারণে সাহেব ছুটি নিয়েছিলেন। তখনকার অতি স্নেহপরবশ এ.ও. মানে অ্যাকাউন্টস অফিসার দাদা দয়া করে সেই সার্ভিস বুকটি মুক্ত করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী চাকরি জীবনে আমার এই অপকীর্তি কাউকে জানতে দিইনি।
আমার অতুল কীর্তির সাক্ষ্যবাহী সেই সার্ভিসবুকটি কালিম্পং জেলা হাসপাতালে অন্তিম বিশ্রামে রয়েছে।