গত কয়েক দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ছবি খুব ঘুরছে। একজন প্রৌঢ়া নাকে অক্সিজেন নল নিয়েও রান্না ঘরের কাজ সামলাচ্ছেন। ছবির ক্যাপশনের লেখা দেখে বোঝা যাচ্ছে, করোনা আক্রান্ত হয়েও তিনি পরিবার, সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন।
মা তো এমনি হন। তিনি মৃত্যুর পরে চিতাতে উঠেও সন্তানের খাবারের চিন্তা করবেন। ব্যাপারখানা এমনি হবে। ভারতে মাতৃত্ব এমনি এক গৌরবের খামে মোড়া অধ্যায়। যেখানে মায়ের রোগ নেই, মন খারাপ নেই, ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই। মা হলেন ‘সব করতে পারি’ দেশের মানুষ। মা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার হাতে মার খেতে পারেন। আবার সেই মা প্রয়োজনে ত্রিশুল হাতে সন্তানের রক্ষায় অন্যকে বধ করতে পারেন। মানে, বলিউড সিনেমায় এমনি মা দেখানো হয় আরকি! আসলে আমরা তো মনে মনে এমন মা চাই। যে নিজের অসুখের কথা বলবেন না। নিজের অসুবিধা নিয়ে ভাববেন না। সারাক্ষণ শুধু তুই খেয়েছিস, তুই ঘুমিয়েছিস। আহা রে! বাছা করে যাবেন। তার নিজের জগত, নিজের আলাদা অস্তিত্ব বলে কিছু থাকবে না।
তবে, এই যে মাতৃত্বের একখানা গৌরবান্বিত অধ্যায়, যে সামাজিক পাঠ মেয়েদের মননে গুঁতিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে, তা কি আর এমনিই! এই পাঠের সুবিধা অনেক! আর তার সবথেকে বড় সুবিধা হচ্ছে ‘মেয়েদের প্রাণ কই মাছের জান’ এই প্রবাদ বাক্যটি!
মেয়েরা কি ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনো প্রাণী? সব কষ্ট রোগ ভোগের বাড়তি সহ্য শক্তি নিয়ে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সংসার সামলে যেতে হবে, এই দায় কেন চাপিয়ে দেওয়া হবে? নাকি এই চাপিয়ে দেওয়ায় সহজেই মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে চাপ মুক্তির রাস্তা প্রশস্ত হয়?
মায়েরা সবাইকে খেতে দিয়ে তবে খাবেন। যতটুকু পরে থাকবেন, সেটুকুই তাদের প্রাপ্য। না হলে ঘরে চিড়ে মুড়ির তো অভাব নেই। আর সেই জন্য হয়তো এ দেশের ৫২ শতাংশ মহিলা রক্তাল্পতায় ভোগেন। কারণ, ফি-দিনের খাবারের তালিকায় পর্যাপ্ত মাছ, মাংস, ডিম, তরকারি থাকে না। তাছাড়া গর্ভবতী না হলে অবশ্য এ দেশে মহিলাদের খাওয়া নিয়ে বিশেষ নজরদারির রেওয়াজ নেই। বাচ্চা পেটে থাকলে তবেই নিয়ম করে ফল দুধ জোটে।
এ দেশে মেয়েদের স্বাস্থ্যবিধি ব্যাপারটাই একটা বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। তাই ২৩ মিলিয়ন মেয়ের ঋতুস্রাব হলে স্কুল থেকে ড্রপ আউট হতে হয়। কারণ, অধিকাংশ স্কুলে আজকেও ছাত্রীদের জন্য আলাদা শৌচালয় নেই। এখনো দেশের ৪৩ শতাংশ মহিলা স্যানিটরি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ পান না। এর থেকে লজ্জার আর কিছু আছে নাকি। সাধারণ মানুষ থেকে সরকার, এ নিয়ে কোনও মাথা ব্যথা নেই। অধিকাংশ মেয়ে ঋতুস্রাব হলে কাপড় ব্যবহার করেন। কারণ, স্যানিটরি ন্যাপকিন তো বিলাসবহুল পণ্যের তালিকায়।
মহিলাদের ইনটিমেট হাইজিন! তা এ দেশের অধিকাংশ মেয়েরও ধারণাই নেই! স্কুল-কলেজ হোক বা স্বাস্থ্য কর্মশালা কোথাও এ নিয়ে বিশেষ কথা হয় না। কেউ হয়তো প্রয়োজন মনে করে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, এ দেশের পঞ্চাশ শতাংশের বেশি মেয়ে ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন সহ একাধিক সমস্যায় বছরভর ভোগেন।
পোস্ট পার্টোম ডিপ্রেশন, সে তো একখানা হাস্যকর ব্যাপার! মা হলে আবার অবসাদ হয় নাকি! এ কি কথা! এখন তো পিঠে লাল শালু বেঁধে সুপার ম্যানের মতো উড়ে যাওয়া উচিত। ব্রেস্ট ক্যানসার সে তো ফিসফিসিয়ে বলার জিনিস। পরিচিত কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে অস্ত্রোপচার করতে হলে, তার স্বামীর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক স্থাপন করছেন, শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ পরছেন কীভাবে ইত্যাদি ইত্যাদি রসালো গল্প করতেই আমরা বেশি পছন্দ করি।
অবহেলার তালিকাটা দীর্ঘ। আর দারুণ প্ল্যান করেই হাজার হাজার বছর ধরে খুব সহজেই মেয়েদের স্বাস্থ্যের বিষয়টাকে গুরুত্বের তালিকার বাইরে রাখা হচ্ছে।
সামাজিক পরিকাঠামো এমনি, যে আমরা মেয়েরাও এই কাজে খুব সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছি। অনেক সময় খুব গদগদ হয়ে আমরা নিজেরা বলি, বিশ্রামের সময় নেই। নিজের জন্য সময় নেই। আমি সংসারে অপরিহার্য। যেন আমি মারা গেলে সংসার অচল হয়ে যাবে। আমার শরীরের দিকে তাকানোর সময়। মনের অবসাদ ঢাকতে নানান অজুহাত সাজিয়ে চলি। আসলে আমি যে গায়ে গৌরবের বর্ম চাপিয়ে ফেলেছি। আমাকে যে সমাজের চোখে ভালো মা, সুগৃহিনী হয়ে উঠতে হবে। এ যে এক কঠিন ব্রত! তাতে প্রাণ গেলেও ক্ষতি নেই!
এই অভিশাপ থেকে কি আমাদের মুক্তি নেই?