ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেসটা বহুদিন গেছে। এই শীতে ঘড়ির কাঁটা আরও পেছোচ্ছে। অ্যালার্ম বন্ধ করে ‘আর পাঁচ মিনিট… আর তিন মিনিট…’ ভাবতে ভাবতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকি। অবশেষে যখন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে পড়তেই হয় তখন বাইরে ঝলমলে রোদ। অতঃপর দাঁত মাজা, হাল্কা ব্যায়াম, প্রাতঃরাশ আর ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের বারংবার বেগ সামলাতে সামলাতে ঘন্টা দেড়েক। তারপর হন্তদন্ত হয়ে কাজে যোগ দেওয়ার তোড়জোড় উসেইন বোল্টকেও ‘চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা’ বলার ক্ষমতা রাখে!
ফুটপাথে নামলেই অবনী ঘোষের ইঁদুর মারা বিষের প্রচার। শেষ দেড় দশকে জগৎ ও জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই এসেছে কিন্তু অবনী ঘোষ অবিচল! পরশুরাম হয়ে তিনি ইঁদুরকে ঝাড়ে-বংশে শেষ করেই ছাড়বেন। সেই এক গলা… এক কথা… আদি ও অকৃত্রিম- “আপনার ধানক্ষেত-গমক্ষেত নষ্ট করছে। কাগজপত্র কেটে টুকরো টুকরো করছে। রাত আটটার সময় তিড়িং তিড়িং করে লাফ মারছে চালাক ইঁদুর। অনেক পাতাবিষ, সেঁকোবিষ ব্যবহার করে ফল হয়নি। স্যার, আমি অনুরোধ করবো- একবার অবনী ঘোষের এই বিষ ব্যবহার করুন। কেনার আগে অবনী ঘোষের নাম-ঠিকানা…”
ফুটপাথ ধরে দ্রুতপায়ে হাঁটছি। ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে ইঁদুর মারা বিষের বিজ্ঞাপন। হঠাৎ দেখি, রাস্তার পাশের গর্তে চারটে ইঁদুর একসাথে বেরিয়ে এসে আবার ঢুকে গেল। অবনী ঘোষকে ভেংচি কেটে গেল কিনা কে জানে!
রাস্তার পাশের ঝুপড়িতে রোদে পা মেলে তরকারি মেখে মুড়ি খাচ্ছে ন-দশ বছরের ছেলেটা। বাঁদিকের গালে একটা মুড়ি চিটিয়ে আছে। পাশে একজন মাঝবয়েসী লোক নারকেল দড়ি দিয়ে চটের বস্তা বাঁধছে। ছেলেটা জিভ বের করে গালের মুড়িটা সুড়ুৎ করে গলায় চালান করতে করতে বললো– বাবা?
– হুঁ
– সবাই কত ঘুরতে যাচ্চে। মোরা যাব নি?
– যাব তো… বোম্বে, দিল্লি…
– ধুর! সে তো অনেক দূর… কত টাকা লাগবে জানঅ? অতদূর যাব নি। একবার নিউ ইয়ার দ্যাখাইতে লিয়ে যাবে?
দূরদেশ ভ্রমণ নয়। বেলুন-কেক-লাল টুপি নয়। উজ্জ্বল পৃথিবীর নতুন বছরের ঝলমলে উদযাপন শুধু দূর থেকে দেখতে চায় ছেলেটা।
ততক্ষণে বাস এসে গেছে। বেশ ফাঁকাই। উঠেই সিট পেয়ে গেলাম। বাসে বেশ ঝাঁঝালো আলোচনা চলছে। যাত্রীরা দুই রাজনৈতিক দলের সমর্থক। একে অন্যের উদ্দেশ্য সুমধুর সম্ভাষণ চালাচালি চলছে। আলোচনা তখন প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে যাবো যাবো করছে এমন সময় শেষ সিট থেকে আধখোঁচা দাড়ি, ময়লা চাদর, পানের পিক শোভিত লালদেঁতো লোকটার আওয়াজ পাওয়া গেল– আমিও কিচু বলবো দাদারা…
গলার স্বর আর মুখনিঃসৃত গন্ধে কারণসুধার প্রভাব স্পষ্ট। উত্তেজিত জনতা খানিক থমকে লোকটার দিকে ঘুরে তাকালো।
– আমি মাল খেয়েচি বলে মাতাল ভাব্বেন না য্যানো। টাল পুরো খ্যাঁচাখ্যাঁচ আছে। আপনারা অনেক তক্কো তো কোল্লেন… এইবার আমার একখানা সরোচিতো কোবিতা সুনুন…
হঠাৎ তাল কেটে যাওয়া জনতা হতবম্ব। একজন গুজগুজ করে বললো– কী শালা! সক্কাল সক্কাল মাল গিলে চলে এসেছে!
– উঁহু! মালকে গাল দিবেন না দাদা। মাল ছাড়া দুনিয়া অচল। ওসব ছাড়ুন। কোবিতাটা সুনুন- “সব সালারাই চোর, কালীঘাট থেকে কাঁথি। পোঁদে দিতে হয় টার্গেট করে সাড়ে তিনখানা লাথি।”
এতক্ষণ রাজনৈতিক আলোচনার যে টানটান উত্তেজনাটা চলছিল সেখানে এখন হাসির ঢেউ। প্রশ্ন এলো– তিন নয়, চার নয়… সাড়ে তিন কেন ভাই?
– তিনখানা লাথ এমন দিব যে সালা চার নম্বরটা দিব বললেই দৌড়ে পালাবে। ওটাই ‘সাড়ে লাথ’।
আবার বিচিত্র সুরে সম্মিলিত হাসি।
– তা টালওয়ালা ভাই, তুমি কী এমন ধম্মোপুত্র যুধিষ্ঠির সবাইকে চোর বলে দিচ্ছো? তুমি কাকে ভোট দাও শুনি?
– আমি শালা মালকে দিই। যে বেশি খাওয়াবে তাকেই…
গাড়ি আটকে গেছে। রাস্তার ওপরে নিউ ইয়ার পুজো চলছে। তারস্বরে মাইক বাজছে। উদ্দাম নাচে মত্ত জনতা কিংবা উৎসুক দর্শক কারো মুখে মাস্ক নেই। এমনিতেই সবাই অতিমারীর ভয়টা হজম করে ফেলেছেন। নিউ মার্কেট কিংবা পার্ক স্ট্রিটের ভিড় দেখে করোনা পরিস্থিতি বোঝার উপায় নেই। নিউ ইয়ারের অজস্র মেসেজ দেখে মনে হচ্ছে পুরোনো বছরের শেষ দিনটা কাটিয়ে ফেললেই করোনা শেষ। কোনোরকমে খাতায়-কলমে অভিশপ্ত বছর শেষ হলেই নিউমেরোলজিক্যাল মুক্তি। কেউ কেউ ভ্যাক্সিন এসে গেছে এই আনন্দে চুড়ান্ত মশগুল। দু’হাজার কুড়ির শেষ শূন্যে করোনা আর দু’হাজার একুশের শেষ একে ভ্যাক্সিনের সিরিঞ্জ বসিয়ে বানানো মেসেজ ভাইরাল হয়েছে। আশায় বুক বাঁধতে ক্ষতি নেই। আমরা সবাই আশায় দিন গুনছি কিন্তু ভ্যাক্সিনের সর্বসাধারণের উপযোগী হয়ে বাজারে আসতে এখনো বেশ খানিকটা পথ চলা বাকি। পুরোপুরি সফল হবে তারও নিশ্চয়তা নেই। কাজেই এখনো ব্যক্তিগত সতর্কতাগুলো মেনে চলা দরকার। আশা থাক, আনন্দ থাক, নতুন বছরের শুভেচ্ছা থাক। সেইসাথে মাস্ক-স্যানিটাইজার-হাত ধোওয়াও থাক।
মারীর দেশে নতুন বছরের উদ্দাম উদযাপনের মাঝে এসব তেতো কথা বলার লোক ক্রমশ কমছে…
ছবি: গুগল