গত কয়েকদিন ধরেই ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে তুমুল। বিশেষত, রাতের দিকটাতে। রাত বারোটা বাজল কি বাজল না , অস্ফুট চাপা গুমগুম ধ্বনি আর ভেজা-ভেজা ভাব বাতাসে। আর তার খানিক বাদেই, সহস্র ঘোড় সওয়ার। ঝলকে ঝলকে বিদ্যুৎ। দাপুটে তুফান।
আজকেও বিরাম নেই সে সবের। মধ্যরাত্রে, এই যে যখন একলা সোফায় বসে বসে লিখছি আমি, তখনও আশমানের দক্ষিণ পূর্ব কোণাটাকে নীলচে শিরার মতো চিরে দিচ্ছে কেউ। রাস্তাঘাট থমথমে। কুকুর ডাকছে দূরে। জানলার কাচে ফট ফট করে শব্দ হানছে বরিষণ দূত।
এসব ঘটনা যদি মাসখানিক আগেও ঘটতো, নিশ্চিত ভাবে শুনতে পেতাম বেয়াড়া গতিবেগে বাইক নিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে কেউ। শুনতে পেতাম রাত্তির করে বাড়ি ফেরা কিছু মানুষের বেখাপ্পা রকমের জোরালো বাক্যালাপ। এ জগত, এই সংসার যতই শহুরে হয়ে উঠুক না কেন, মনের ভিতরে শিকড় গেঁড়ে বসে থাকা কিছু কিছু ভয় এখনও টিঁকে রয়েছে দিব্যি। এখনো অনেক রাতে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরে যেসব মিস্ত্রি মজুররা, তারা গান গায় বিদঘুটে গলাতে। চিৎকার করে ডাকে একে অন্যকে—“বাবুয়া… কাল হাটে যাবি নাকি…।” বাবুয়ার উত্তর আর শোনা যায় না সুস্পষ্ট যদিও। ততক্ষণে ওরা ঝড়ের বেগে পেরিয়ে গেছে সামনের পথটুকুকে। শুধু, অস্ফুটে শোনা যায় উচ্চকিত হাসির হররা। বোঝা যায়, অন্ধকারের অস্বস্তি কাটেনি মানুষের এখনো।
এখন যদিও সেসবের আর উপস্থিতি নেই। এখন লক ডাউনের চক্করে রাত্তির আটটা বাজলেই সমস্ত তল্লাট শুনশান। মানুষের যত হম্বিতম্বি, সবটাই ওই দিনের আলোতে। তারপর সূর্য ডুবল যেই, ওমনি প্রাগৈতিহাসিক মানবের মতো একে একে সেঁধিয়ে পড়ছে বাসাতে। মৃত্যুভয়টাও সম্ভবত রাতের বেলাতেই চেপে ধরে বেশি। সোডিয়াম আলোতে একলা শুয়ে থাকা পথটাকে জানালা দিয়ে দেখলে এখন তাই দেখলে মনে হয়– দুঃস্বপ্ন। মনে হয় ‘কালরাত্রি নেমেছে’ এই অঞ্চলে।
এসব সময়ে কোল বালিশ টেনে, জমিয়ে ভূতের গল্প পড়াটাই দস্তুর। কিংবা ঘরের আলো নিভিয়ে, চাদর মুড়ি কথাবার্তা। এইসবই তো করে আসছে মানুষ দীর্ঘ দী-র্ঘ দশকের পর দশক ধরে। বিজ্ঞানের কল্যাণে সত্যিকারের ভয় তো আর সেভাবে ধরা দেয় না কিছুতে। সবটাকেই তাই গড়ে নিতে হয় কল্পনাতে। রোমাঞ্চিত হতে হয় এই ভেবে যে– বেশ গা শিরশিরে আমেজ হচ্ছে তো!
আর সেই আমেজই আজ বহু বৎসর পর এবার জাঁকিয়ে বসেছে পৃথিবীতে। কষ্টকল্পিত বীভৎসরসের প্রয়োজনটুকুও পড়ছে না মোটে। ভয়াল,অদৃশ্য এক রাক্ষুসে শমন হাজির হয়েছে চুপিসারে। চতুর্দিকে মড়কের কটু গন্ধ। চারিপাশে থাবা চাটা হানাদার।
এই যে এইরকম একটা আশ্চর্য্য পরিস্থিতি, যখন প্রকৃতির একটা টুসকিতে সমগ্র সদম্ভ মানবজাতির প্রায় কোনঠাঁসা অবস্থা, তখন একমাত্র মুক্তি হলো কল্পনার জগত। বা, ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। অর্থাৎ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, ফেসবুক। সমস্ত মানবসমাজের যাবতীয় ঢক্কানিনাদের একমাত্র মুক্তিপথ। আর, বাস্তবের এই নৈঃশব্দ এবং ফেসবুকের এই পল্লবগ্রাহী শোরগোলের মধ্যেই আমার আচমকা আজ দিন দুয়েক হলো, কেবলই মনে পড়ছে দুটো মুখের কথা।
নাম যাদের লাদেন আর রাইফেল। আমার চাকরি জীবনের এক্কেবারে শুরুরদিকের দুই রুগি। কান ধরে যারা আমাকে শিখেয়েছিল সাধারণ ডাক্তারি আর পাবলিক হেল্থের মধ্যেখানের তফাৎটাকে। এদের সাথে পরিচয় হওয়ার আগে অব্দি আমি ছিলাম স্রেফ একজন চিকিৎসক। রোগ হলে রুগি আমার কাছে আসবে আর আমি তাকে নিদান দেব। ব্যাস। এইটুকুই হলো আমার তাবৎ দায় এবং তামাম দায়িত্ব। চিকিৎসক হিসাবে আমার গণ্ডী ওইখানেতেই শেষ।
লাদেন এবং রাইফেল সেই গণ্ডীর দাগে জল ঢেলে দিয়েছিল। প্রমাণ করে ছেড়েছিল যে, ওষুধ এবং পত্তর দেওয়াটা আমার কর্তব্যের স্রেফ শুরুয়াৎ মাত্র। আমার প্রকৃত কাজের পরিধিটির বস্তুত এইখান থেকেই সূচনা। ধীরে ধীরে সেই পরিধি ভেদ করে এরপর আমাকে পৌঁছতে হবে কেন্দ্রে। রোগের গোড়াতে। ব্যধির মূলে। তবেই, চিকিৎসা সম্পূর্ণ হবে। আর সেই অসম্ভব কাজটিকে সম্পূর্ণ করতে হলে, কেবলমাত্র আমাকে অর্থাৎ চিকিৎসককে সচেষ্ট হলেই চলবে না। সচেষ্ট হতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরের পরিষেবা প্রদানকারীকে।
যাক সেসব কথা। গল্পে প্রবেশ করা যাক। তো… রাইফেল। রাইফেলের পুরো নাম ছিল রাইফেল টোপ্পো। চা বাগানের একটা লাইনের কুলির সর্দার। এই সা জোয়ান, তাগড়া পেটাই চেহারা। চোখমুখ পাথুরে। আর তেমনি সাংঘাতিক সাহস। একবার একা একটা টাঙি হাতে নিয়ে মা চিতাবাঘের মহড়া নিয়েছিল ভর সন্ধ্যাতে। বাগানের নালায় বাচ্চা দিয়েছিল চিতাটা। ন্যাংটা ছেলেপুলের দল সেই বাচ্চাগুলোকে পোষ মানাবার মতলব করছিল। হঠাৎ… মা এসে হাজির। রাইফেল সেবার একাই বাঁচিয়ে দিয়েছিল ন্যাংটার দলকে। ভাগিয়ে দিয়েছিল হিংস্র চিতাকে। এই রকমেরই আরো কত কি! চা বাগানের হিরো ছিল রাইফেল। বাগান-ওয়ার্কারদের চোখের মণি।
তারপর, লোকটার টিবি ধরা পড়ল হঠাৎ। তখন সদ্য সদ্য এই টিবি হাসপাতালে যোগ দিয়েছি আমি। ভালো করে বুঝেও উঠতে পারিনি দায়-দায়িত্ব। আর তারই মধ্যে একদিন বাগান থেকে গাড়ি ভর্তি লোকজন এসে রাইফেলকে ভর্তি করে দিয়ে গেল। গোড় করে বলে গেল–” এ হামাদের লিডর আছে ডক্টরসাব। বাঁচায় দিবেন দয়া করে।”
প্রবলেম সেরকম কিছু ছিল না। এমনিতেই তো রাইফেলের ওই তাগড়া মার্কা চেহারা। তার উপরে, হয়েছেও মামুলি টিবি। দিন কয়েকের মধ্যেই তাই ছুটি করে দিলাম ওষুধ পত্র বুঝিয়ে। রাইফেলের চেলা চামুণ্ডারাও খুশ, আমিও চিকিৎসক হিসাবে তৃপ্ত।
গণ্ডগোলটা বাঁধলো ঠিক তার মাস খানিক পর থেকে। স্থানীয় এক স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে টেলিফোন মারফত খবর পেলাম– রাইফেল ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে পুরোপুরি। বহুবার বুঝিয়েও লাভ হয়নি এতটুকুও। খাবে না মতলব খাবেই না হরগিজ। বললাম– লেগে থাকুন। বোঝান। দরকার হলে মেডিক্যাল অফিসার বা ‘বি এম ও এইচ’কে সঙ্গে নিয়ে বাগানে ভিজিট করুন। আসপাশের লোকজনের সাথে কথা বলুন। চেষ্টা … ছাড়বেন না।
দিন কতক বাদে খবর পেলাম, সেই চেষ্টায় ফল হয়েছে। আর তারও দিনকতক বাদে খবর পেলাম, আবার ওষুধ খাওয়া বন্ধ। স্থানীয় বি এম ও এইচ ভদ্রলোক যদিও লেগে রইলেন। এবং তাঁরই লাগাতার চাপাচাপিতে রাইফেল দিনকতক ওষুধ খেতো, তারপর আবার যেই কে সেই। এই করে করেই রাইফেল বছর খানিকের মাথায় মারাই গেল একদিন দুপুরে। আসল গল্পটার… ঠিক এইখান থেকেই শুরু।
রাইফেল খ্রিষ্টান। কবর দেওয়ার কথা তাই সংলগ্ন গোরস্থানে। এবং সেই নিয়েই বখেড়া। রাইফেলের বডিতে হাত দেবে না কেউ। গোর দেওয়া তো দূরস্থান, বডিটাকে বাড়ির বাইরে পর্যন্ত বের করতে দেবে না। কারণ একটাই। ওই যে একবছরের স্বাস্থ্যকর্মীদের মুহুর্মুহু যাতায়াত, এতে সক্কলে এটুকু বুঝেছে যে, রাইফেলের বেমারিটা ভয়ঙ্কর। এবং সেটা ‘ছোঁয়াচে’। অতএব… হই হাল্লা, ঝামেলা ঝঞ্ঝাট, সড়কি টাঙি। ম্যাগাজিন, পেপার, লোকাল মিডিয়া। শেষমেশ পুলিশ এবং বি ডি ও র হস্তক্ষেপে ওই অঞ্চলে, একটা ছোট্ট সভার আয়োজন করা হল। স্থানীয় বি এম ও এইচ বুঝিয়ে বললেন সকলকে। টিবি কী? টিবি কিভাবে ছড়ায়? কবরে পোঁতা বডি থেকে এই রোগ ছড়াতে পারে কি না …ইত্যাদি।
ওই একটা রাত আশ্চর্য অস্থিরতায় কেটেছিল আমার। এর আগেও আমি বহুবার মানুষের মুখে শুনেছি, যারা ওষুধ খায় না, তাদের গুলি করে মেরে দেওয়া উচিত। বহু তর্কেও বুঝিয়ে উঠতে পারিনি যে, এইভাবে একটা সিস্টেম চলতে পারে না। মানুষ যদি ওষুধ না খায়, তবে তার দায়ভাগও সিস্টেমের ওপরে বর্তায়। স্রেফ হেল্থ সিস্টেম নয়। সমস্ত রকমের সিস্টেম। জেনারেল এবং পুলিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও। কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম। এবং সেই প্রথম আমার উপলব্ধি যে, রোগ এবং রোগ সম্পর্কিত লড়াইটা কতখানি ব্যাপ্ত। কতখানি সুগভীর।
শেষমেশ, বহু প্রচেষ্টার পর, ওই অঞ্চলের লোকেরা টিবি রোগের বিষয়ে বুঝে উঠতে সক্ষম হলো। এবং দাফনও করা হলো সেই রাতেই চা বাগানের একদা ‘নয়নের মণি’ রাইফেল টোপ্পোর দেহটিকে সসম্মানে।
পরবর্তী গল্পটা লাদেনের। লাদেনের পিতৃদত্ত নাম যে লাদেন ছিল না, একথা বলাই বাহুল্য। লাদনের আসল নাম ছিল গোপাল রায়। বেঁটেখাটো রোগাভোগা একটা লোক। ঝোল্লা শার্ট। ঢলঢলে প্যান্ট। আর একমুখ দাড়ি। যদিও, দাড়ির জন্য ব্যাটাকে লাদেন বলে ডাকা হতো না মোটেও। ডাকা হতো, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কারণে।
সময়টা 2011র গোড়ার দিকে। এ জগতের মানুষজন তখনও আবোতাবাদ, সারভাইলেন্স ড্রোণ বা অপারেশন নেপচুন স্পিয়ারের নাম শোনেননি। নাইন ইলেভেন খ্যাত ওসামা বিন লাদেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এখান থেকে সেখানে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর প্রায় দশ বছর কেটে গেলেও, তার টিকিটিরও হদিশ পাওয়া যায়নি কিছুতেই। এটা সেই সময়েরই গল্প।
তো, গোপাল নামক রায়ও ছিল ঠিক তাই। সদ্য রাইফেল পর্বের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছি আমি, একদিন আউটডোরে এসে হাজির হলো কফ পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে নিয়ে। টিবি ধরা পড়েছে গোপালের জব্বর রকম। ফটাফট ওয়ার্ডে ভর্তি করতেই সিস্টাররা হইহই করে উঠলেন–“আরে ধুর ধুর… এ আবার হাজির হয়েছে? একে চিনে রাখুন ডক্টর সেনগুপ্ত। এ হলো লাদেন। দু দিন ওষুধ খাবে। একটু ঠিক হবে। তারপর পালাবে। হাজার চেষ্টা করলেও ধরতে পারবেন না তারপর আর। এই নিয়ে সাতবার তো হলো…। শরীর একটু ঠিক হলেই বাবু ওষুধ বন্ধ করে দেন। তারপর যেই খারাপ হয়, চলে আসে সুড়সুড় করে…। আপদ একটা…।”
শুনে চমকে গেলাম! একটা লোক সাতবার টিবির ওষুধ খেয়েছে! তাও আবার আধা খ্যাঁচড়া! অথচ, নিজে নিজেই হাজির হয়েছে প্রত্যেকবার নতুন করে। অর্থাৎ, ওষুধ খেতে যে একেবারেই চায় না এমনটাও নয়! নিজের ভাল পাগলেও বোঝে।
রাইফেলের ঝটকাটা তখনও বাসি হয়ে যায়নি। ভুলে যাইনি এই কথাটা যে, রাইফেলের ওষুধ খেতে না চাওয়ার কারণটা আর জানা হল না কোনোদিনও। ঝটফট তাই বসে পড়লাম লাদেনের মুখোমুখি।
— কি হে? গোপাল? … তোমার নাম গোপালই, তাই তো?
— আপনে লাদেনই বলেন। অই নামেই চিনে আমাকে এখানে।
— ও। তা বেশ তো। বেশ! তা ভাই লাদেন, কোর্স কমপ্লিট করো না কেন বল তো? সাত বার ওষুধ খাওয়ার থেকে একবার খেলে আর ওক্কে হয়ে গেলে, এটাই ভালো না?
— ওষুধ খাবো না তো বলি নাই। কিন্তু খাবো কুঁঠে?
— আরে বাহঃ বাহঃ বাহঃ… দেখছেন? সিস্টার? দেখলেন তো? ওষুধ খাবে। তা ভাই সেন্টার থেকে ওষুধ খাবে। পোলিও সেন্টার।
— সেন্টার তো নয়টার সমৎ খুলে। আর আমি সাতটায় বাস নিয়া বাহির হোই যাই।
— ও! ড্রাইভার? তা ভালো। গুড। কোনো ব্যাপারই না। কোথায় বাস নিয়ে যাও বলো। কোন্ লাইনে? লাস্ট স্টপ যেখানে, সেই সেন্টারেই ব্যবস্থা করে দেব।
— হেঁহ! ডেরাইভার না তো। খালাসি। খালাসি
— হ্যাঁ তো কোন্ লাইনের খালাসি?
— ওরম তো কিছু নাই। পার্মানেন কাজ নাই। সকালে ইস্ট্যান্ডে চলে যাই। যে বাসে খালাসি শর্ট, সেই বাসে ডিউটি মারি।
এবার আমারই থমকানোর পালা। বিষয়টা সহজ নয় মোটেই। এরকম একটা লোককে এবার ওষুধ খাওয়াই কী করে! এদিকে, ওষুধ যে অ্যাডভান্স হাতে দিয়ে দেব, তারও উপায় নেই। টিবি চিকিৎসার পদ্ধতিটাই হলো ডট। ডি ও টি। ডাইরেক্টলি অবজার্ভড ট্রিটমেন্ট। চোখের সামনে ঘাড় ধরে ওষুধ খাওয়াতে হয় রোগীকে। নয়তো, ওষুধ ফেলেও দিতে পারে রাস্তাতে। মহা মুশকিল!
শেষমেশ লোকাল বাস স্ট্যান্ডের কর্তাব্যক্তিদের সাথে বসা গেল। লাভ হল না। লাদেনকে পার্মানেন্ট কাজ দিতে চায় না কেউই। মারাত্মক নেশাড়ু। মাঝে মধ্যেই এখানে সেখানে কেল্টে পড়ে থাকে মদ খেয়ে। অগত্যা… মিটিং ভেস্তে গেল।
অতঃপর, নতুন প্রচেষ্টা। লাদেনকে আমি ওষুধ খাইয়েই ছাড়ব শালা। যে করেই হোক। একটা লোক টিবিতে ভুগছে, সে বেচারি ওষুধও খেতে চায়, স্রেফ পেটের দায়ে খেতে পারছে না… এরকমটা বরদাস্ত করবো! ইয়ার্কি নাকি?
ঘোরতর আলোচনায় বসলাম সহকর্মীদের সাথেই। চা এলো। এলো বিস্কুটও। চাঁদা তুলে। সেইসব খতম করে, উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে তপনদা গালে খৈনি ঠুঁসে বললো–” ওকে খৈনির ব্যবসা শুরু করতে বলেন স্যার। কাটা খৈনি। তামাক পাতা কিনবে, আর কেটে কেটে খৈনি বানায়ে বিক্রি করবে। পয়সা লাগে না বেশি। সেরকম হলে হাম্রাই একটু একটু করে দিব। সেই-ই লাভ ব্যবসাতে। দিনবাজার মোড়ে দ্যাখেন নাই? কী? …বিমান? বলো ডাক্তারবাবুকে… খৈনি বেচে দু তল্লা বিল্ডিং পজ্জোন্ত বানাইছে…তাই না?”
ব্যাস। সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। আমরা ক’জন চাঁদা তুলে খৈনির ইনিশিয়াল পুঁজি জোগাড় করে দেব। তারপর লাদেন খৈনি কাটবে আর সেন্টারে এসে ওষুধ খাবে। ব্যাস। প্রবলেম সল্ভড।
হলো না যদিও। যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই লাদেন ব্যাটাই বেঁকে বসল একগুঁয়ে হয়ে।
— আমি দারু খাইতে পারি স্যার,…বিড়ি সিগ্রেটও…কিন্তু বেচতে পারব না। ক্যানসার হয় স্যার। লিভার খারাপ। আমি তো জানি…। না স্যার। পারবো না।
লাও! আবার সবটা বিশ বাঁও জলে। হাল ছাড়লাম না যদিও। মিশন-লাদেন-এর কথা ছড়িয়ে দিলাম জলপাইগুড়ির স্বাস্থ্যমহলের সবখানে। এবং তাইতেই সমাধান মিললো শেষমেশ। ডিস্ট্রিক্ট টিবি অফিসার এবং সি এম ও এইচ সাহেব, ডি এম এর সাথে বসে, লাদেনের জন্য রেশন থেকে চাল ডাল ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিলেন যথেষ্ট। সঙ্গে, পঞ্চায়েত অফিস থেকে স্পেশাল স্কিম। ওষুধ খেলেই মাসে মাসে মাসোহারা নগদ। এবং সেই সমস্ত খেয়ে আর নিয়ে থুয়ে লাদেন লক্ষ্মী ছেলে হয়ে গেল তারপর থেকে। সুস্থও হল পুরোপুরি।
ততদিনে, ওসামা বিনও খতম হয়েছেন নেভি সীলের অপারেশনে। দুই লাদেনই ক্যাচ কটকট আগুপিছু।
কাহিনীর মধুরেনঃ সমাপয়েৎ।
এই দুটো ঘটনা, আমার চোখ খুলে দিয়েছিল এক ঝটকাতে। একটা বিষয় অন্তত বুঝতে পেরেছিলাম সুস্পষ্ট ভাবে যে, স্বাস্থ্য ব্যাপারটা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। স্বাস্থ্যের সাথে খাদ্য, খাদ্যের সাথে বাসস্থান, বাসস্থানের সাথে শিক্ষা এবং শিক্ষার সাথে স্বাস্থ্য সচেতনতা জড়িয়ে আছে শিকড়ে শিকড়ে। এর মধ্যে যে কোনো একটায় ঢিলে পড়লেই তামাম গাছটাই মাটিতে উল্টে পড়ে যাবে হুড়ুম করে। কোনো বিশেষ ব্যক্তি হয়ত বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গোটা পাঁচেক মানুষের পরিবর্তন ঘটাতে পারেন মেরেকেটে। কিন্তু সেটা ওই ব্যক্তিগত উদ্যোগই। সমষ্টিগত কোনো পরিবর্তন কখনো ঘটবে না তাতে।
এবং গলদটা সেইখানেই। হঠাৎ কোনো মহামারীর আগমনে হাজার হইহই, চরম চিৎকার করলেও কিচ্ছুটি হবে না। মানুষ আদতে একটা জামা প্যান্ট পরা জন্তু বিশেষ। নিজের এবং নিজ সন্তানের সুবিধার বাইরে কিচ্ছুটি বোঝে না। সেখানে সামান্যতম বিপদের আশঙ্কা দেখলেই তৎক্ষনাৎ নখ দাঁত বের করে ফালাফালা করে দেবে চারপাশটাকে। তাতে জগৎ গোল্লায় গেলে গোল্লায় যাক। অন্তত আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
সেই ভরসাটাই দিতে হবে মানুষকে। শেখাতে হবে কোনটিতে তার বিপদ আর কোনখানে না। জোগাতে হবে অন্ন, নিশ্চিন্ত করতে হবে নিরাপত্তা।
সেসব আমরা করিনি। আমরা এখনো করছি না। রাজকোষের অর্থ ব্যয় হচ্ছে অস্ত্র খাতে, বিনোদন খাতে। আর জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে বাড়তি করের বাধ্যতামূলক বোঝা। লোকজন অশিক্ষায়, ক্ষুধাতে, কুসংস্কারে ডুবে ডুবে মরছে। ডামাডোলের এই ভয়ঙ্কর দিনে তারা তাই ফোঁস তো করবেই। এবং সেই ফোঁসের বিষ সহ্য করতে হবে সমগ্র জাতিকে।
করোনা, আমাদের আরো একবার সমস্তটাকে গোছানোর সুযোগ করে দিয়েছে। ভ্যাকসিন হোক বা হার্ড ইমিউনিটি, একদিন না একদিন এই বিপদ আলবাৎ কেটে যাবে। কেটে যেতে বাধ্য। প্রশ্নটা থেকে যাবে যদিও তারপরও। যদি তখনো, হুল্লুড়ে বিনোদন আর প্রান্তিককে উপেক্ষা করেই দিন কাটাই আমরা, তবে আগামীতে সত্যিই একদিন প্রলয় আসতে চলেছে।
সেইদিনও কিন্তু ঝড় উঠবে পৃথিবীতে। সোঁদা গন্ধ উঠবে খুব। ভেজা বাতাস বইবে আদুরে। আশমানে রচিত হবে বারিদ ও বিধু-র কাব্য। শুধু… একটিও মানুষ থাকবে না পথেঘাটে। থাকবে না ঘরের ভিতরেও। কাঁটাতার সীমান্তে ঘাস খাবে হরিণের দল। মারণাস্ত্রের ভাঁড়ারে গজাবে ঘাস আর রাজকোষের পুঁজিতে ছত্রাক।
বসুধার জন্য হয়ত সে বড় সুদিন হবে। কিন্তু মানুষের জন্য… ভয়াবহ বিলুপ্তি।