দিনটা ছিল মধ্য সাপ্তাহিক। অর্থাৎ বৃহস্পতিবার। ঘূর্ণী ঝড়ের তাণ্ডব মিটেছে সদ্য। স্তিমিত হয়েছে দুর্যোগের নামকরণ নিয়ে তরজা আর মস্করা। কিছু ক্রন্দন ধ্বনি সুস্পষ্ট হতে শুরু করেছে তুফান শেষে। কিছু কণ্ঠ, স্তব্ধবাক হয়ে গেছে চিরায়ত।
আমার শহরে সেভাবে জল ঝড় হয়নি যদিও। তবে বাতাসে বাতাসে বিপর্যয়ের আভাস ভেসে এসেছে গুঁড়ো গুঁড়ো। খুব বড়ো সামুদ্রিক প্রাণীর চলাচলে যেমন হয়। অনেক দূরে থাকা জলরাশিতেও ধরা পড়ে আঁশটে আলোড়ন। ছলাৎ করে জানান দিয়ে যায় মৃদু তরঙ্গ। উত্তরবঙ্গীয় এ শহরেও ছাপ পড়েছে ঠিক তেমনই। বৃষ্টি পড়ে চলেছে ঝুরো ঝুরো হয়ে নাগাড়ে। পথে ঘাটে বিছিয়ে আছে স্যাঁতস্যাঁতে অকাল শ্রাবণ। মিহিন ধারাপাতে, সদ্য সমাপ্ত জলরঙে আঁকা ছবির মতো আবছায়া হয়ে গলে আছে চারিপাশ।
এইসব নিয়েই ডিউটিতে গিছলাম। এইসব মেখেই ফিরেছিলাম নিরাপদ বাসস্থানে। রেইনকোট, মাস্ক, চাবি, হেলমেট। গুছিয়ে নিচ্ছিলাম ভেজা ভেজা হাতে স্কুটি থেকে নেমে। পায়ের নিচে কিরকিরে শহুরে কাদার স্পর্শ।
দেরি হয়ে গিয়েছিল বেশ। খিদেও পেয়েছিল একটু আধটু। খোকাদা বসেছিল তক্তপোষে পা ঝুলিয়ে। গ্রাহ্য করিনি। রোজই থাকে। থেকেও অনেকটা নেপথ্যের মতো। অভ্যস্ত মামুলি উপস্থিতি সিকিউরিটি গার্ডের।
— চাইরটে ত বাইজেই গেলো প্রায়।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম। থেমে গেলাম। মাঝে মাঝে কথাবার্তা বলে খোকাদা। বেশিরভাগ দিনই ঝিমায় অবশ্য। পোড়া বিড়ির কুবাস ভারী হয়ে ঝুলে থাকে বাতাসে। আর পা ঝুলিয়ে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে, ঢুলতে থাকে ষাটোর্দ্ধ । তবু কোনো কোনোদিন কথা বলে। এমনিই। খেজুরে। আজ যেমন বললো–“চাইরটে ত বাইজেই গেল প্রায়।”
আমি হাসলাম। তাকালাম দেওয়ালের দিকে। একটা ঘড়ি ঝুলছে ওখানে। কোণা ভাঙা ঘিয়ে রঙের ‘অরপ্যাট’। সময় বলছে তিনটে বেজে পঞ্চান্ন। ওটাতেই সময় দেখে খোকাদা। ওইদিকের ওই একচিলতে দেওয়ালে। এই দেওয়ালখানিই হলো এ আবাসনের সিকিউরিটি গার্ডদের সংসার। ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, হনুমানজী, বিড়ির প্যাকেট। টাঙানো আছে, ঝোলানো আছে এদিক সেদিকে। ধুপকাঠির ল্যাজ গোঁজা আছে গত সন্ধ্যার একগোছা।
– হ্যাঁহ! ওই আর কি…। যাই। খাই গে।
— ডিউটির কোনো মা বাপ নাই, বলেন? হ্যাঁহ? তাই-ই তো দেখতেছি আমি। —জুলজুল চোখে জবাব দিল খোকাদা।
বুঝলাম, আজ খানিক গল্প করার মুডে আছে। কিংবা বক্তব্য আছে অন্য। সময় তো মোটে কাটে না বুড়োর। বুড়োই তো মানুষ। আগে তবু খেলা টেলা করতো ফ্ল্যাটের বাচ্চাগুলোর সাথে। গল্প টল্প বলতো। ঠাট্টা তামাশা। ছোটো ভীম, ইয়ায়া ঢিসুম। লক ডাউন হয়ে ইস্তক সেটাও গেছে। তাই, সময় কাটছে না সম্ভবত। থা-ক। তিনটে যখন পঞ্চান্নই হয়ে গেল, পাঁচটা মিনিট আরো দাঁড়িয়েই যাই এখন। সঙ্গ দিই দু দণ্ড। আনসান, আটভাট বকি।
রেইনকোটের পেটের কাছে জল জমেছিল বড় বড় ফোঁটাতে। হাত দিয়ে সাঁৎ সাঁৎ করে ঝাড়তে ঝাড়তে কথা চালালাম
— হ্যাঁ। টাইম টুইম নাই কিছুই । বুঝলেন? দেখতেসেনই তো অবস্থা।
— সে-এ-ই। ডাক্তারের জীবন। হ্যাঁ? মানুষের মরা বাঁচা…। কম কথা? আপনি… আপনি… ওয়ক্ত পিকচার দেখসেন ডাক্তারবাবু? বলরাজ সাহানি, সুনীল দত্,…। দেখসেন?
এটা দেখা ছবি আমার। ” আগে ভি জানে না তু”, ” অ্যায় মেরি জহরাঁজবি”। হাতে সিল্কের রুমাল বলরাজ সাহাব। ঝলমলে নেকলেসে অচ্লা সচদেব। গানও শুনেছি রঙ্গোলিতে। অন্তাক্সরিতে গেয়েছি অনেকবার।
বললাম না যদিও। উৎসাহটা তাহলে নষ্ট হয়ে যাবে লোকটার। গল্পটা… থেমে যাবে।
“নাঃ।” ঘাড় নাড়লাম–” ভালো?”
— আরে বাপ রে বাপ! সেই বই। আপনার জন্মেরও আগে। সে-ই বই বানায়েছিল একটা। ছেলেমানুষ আপনি। আজকের কথা নাকি? হ্যাঁ!
শেষের দিকটায় খোকাদার গলায় সামান্য রগড়। হাসছে চোখদুটো একটু একটু। মজা লাগছিল আমারও। ‘ ছেলেমানুষ’ বলবার লোক ক্রমেই কমে আসছে। খোকাদা নিজেও একসময় ছেলেমানুষ ছিল নিশ্চয়ই। আদরের ছোটছেলে ছিল নির্ঘাৎ। নাম দিয়েছিল তাই বাপে মায়ে — খোকা। আজ সেই খোকাই বুড়ো হয়ে গেছে। সাড়ে চারফুটের একটা মামুলি মানুষ। ‘ছেলেমানুষ’ বলে রগুড়ে স্বরে ডাকছে আমাকে।
— দেইখেন একদিন ভিডিওতে। সবই দেখায়ে দিছে। স-ব। সেই বড় বাড়ি…। বুঝলেন কিনা! চাকর বাকর, গাড়ি, মকান… সব। সব খতম হয়ে গেল ভূমিকম্পে। সব শেষ। ওয়ক্তের আগে ডাক্তারবাবু … সব শেষ মানুষের। সব খতম। আজকের কথা? হ্যাঁ? কবে দেখায় দিছে পিকচারে। হ্যা হ্যা।
বুঝলাম উপকূলের ঘুর্ণীঝড় নিয়ে কথা হচ্ছে। লন্ডভন্ড দক্ষিণের জেলাগুলো। বড়লোক, গরীবলোক সব একাকার। চূর্ণীকৃত দর্পরাশি। হাসলাম। পা বাড়ালাম আবার। চারটে এক। এবার উঠবো। উঠতে হবে। খিদে পাচ্ছে। পেটটাকে রেহাই দেওয়া দরকার জলদি। হঠাৎ, খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো খোকাদা। একটু এগোলো। আমি থমকে গেলাম আবারও। বুঝলাম, আসল কথা শুরু হবে এইবারে।
— আচ্ছা ডাক্তারবাবু…। সিমটম কী রকম? এই রোগের?
— কোন রোগ? করোনা?
— হ্যাঁ। খতরনাক বিমারি। বলেন!
— তা… ওই আর কি ! সিমটমের তো ঠিকঠিকানা নাই। কিছু নাও থাকতে পারে। আবার ধরুণ এই সর্দি কাশি জ্বরটর…।
খোকাদা শব্দ করে হাসলো। হেহঃ। বললো– “আমার তো জানেনই, কাশি অ্যাকটুকু থাকেই। সিজোনাল। এই বৃষ্টি মিস্টি গরম গুরম পড়লে। কিন্তু, বিশ্বাস করেন…” হাত জোড় করলো খোকাদা আচমকা। গলাটা করুণ হয়ে গেল হঠাৎ করে। ভিখারির মতো। অনুনয়ের।
— কিন্তু, বিশ্বাস করেন… ঠাকুরের দয়ায় এ সিজোনে ঠান্ডা লাগে নাই আমার। কাশি নাই একটুকুও। সত্যি বলতেসি।
এ কথার অর্থ আমি বুঝি। না বোঝার কিছু নেই। বস্তুত সকালের দিকে মেজাজটা আরো একবার বিগড়ে গিছল এ জাতীয় আরো একখান কথার কারণেই। আজ আউটডোরে পৌঁছাতে দেরি হয়েছিল সামান্য। এমনিই। কারণ নেই তেমন কিছু বিশেষ। দু পাঁচটা রুগী ছিল দাঁড়িয়ে। করোনা-কালে যেমন হয়। ছাড়লাম ওদের। তারপর একটু হাত পা ছড়িয়ে বসতে না বসতেই দীননাথ এসে ঢুকলো ঘরে। ছেলেটি স্বাস্থ্যকর্মী। আমারই হাসপাতালের। চোখে মুখে দেখলাম ঝরে পড়ছে তীব্র উত্তেজনা। হাতের মোবাইলটা বাড়িয়ে দিল টেবিলের পাশ দিয়ে–” দেখছেন? অবস্থাটা একবার ? দ্যাখেন …
দ্যাখেন নিজের চোখে ।”
দেখলাম। একটি মেয়ের ছবি মোবাইল স্ক্রিনে। কিশোরী বলা যেতে পারে। ক্লোজ আপ শট। স্পষ্ট। এক ঝলক দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম অন্যদিকে। ছবিটা চেনা। গত রাত থেকে হোক না হোক তিনখানা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ঘুরতে দেখেছি হাত ফেরতা হয়ে। সঙ্গে একটি এক পাতার তালিকা। তালিকায় গোটা দশেক নাম। এবং তালিকাটি দেখতে শুনতে পুরো দস্তুর সরকারি। “অমুক অমুক নামের মানুষেরা একজন করোনা রোগাক্রান্তের সাথে একই বাসে চেপেছেন।” এবং এই যে এই মেয়েটি, যার ছবি জ্বলজ্বল করছে হাজারো হোয়াটসঅ্যাপে, এ-ও তেমনই এক সহযাত্রী।
কারা এসব বানায় আমি জানি না। কারা পাঠায়, কী উদ্দেশ্যে পাঠায়, তাও বোঝার স্পৃহা কাজ করে না আমার। বিষয়টা বহুরূপে, বিভিন্ন ভাবে দেখে আসছি আজ বারো বছর ধরে। এই আজকেও, এই মুহূর্তে বাইরের বেঞ্চে যে মানুষটি বসে আছে এবং ব্যস্ত-সমস্ত ভাবে ফোন করে যাচ্ছে একের পর এক, সে-ও এই একই মানসিকতার ফসল। লোকটা আউটডোরে গতকালও এসেছিল। মুখ চেনা। চায়ের দোকান আছে ছোট্ট। সঙ্গে, একটি মহিলা। এইই… বছর পঁয়তিরিশ চল্লিশ। কাশছিল খুক খুক করে।
লোকটি বলেছিল আবেগ ঝরঝর কণ্ঠে– আমার বোন হয় স্যার। বিয়া দিছি ময়নাগুড়িতে। বরটা একনম্বরের শয়তান। খ্যাল রাখে না বোনটার আমার এতটুকু। দ্যাখেন তো… কী অবস্থা হইছে শরীরের।
মহিলার শারীরিক অবস্থা সত্যিই খুব ভালো নয়। রোগা, হাড়গিলে। চোখেমুখে ভ্যাবাচাকার মতো দৃষ্টি। দেখেটেখে প্রেসক্রিপশন লিখছিলাম খসখস। কফ পরীক্ষার ফর্ম ফিল-আপ। সময় লাগে এসব কিছু লিখে শেষ করতে। লোকটা, সে সময়টায় নাগাড়ে বকবক করে গিছলো– আপনি দ্যাখেন স্যার। ভালো করে দ্যাখেন। একে শ্বশুরবাড়ী দিব না এখন আমি। রাইখ্যে দিব। খাওয়াই। যত্ন নিই। শ্বশুরবাড়ির লোকগুলা জানোয়ার সব স্যার…। আপনি দ্যাখেন। ভালো করে দ্যাখেন। যতদিন লাগে লাগুক সুস্থ হইতে। এখানেই রাইখে দিব নিজের কাছে।
সেসব কথা আচমকা ফুরিয়ে গেছে আজকে। উধাও হয়ে গেছে ভোজবাজির মতো। ওই যে বাইরে এখনও শুনতে পাচ্ছি ইষৎ চাপা গলায় বকে যাচ্ছেন গতকালকের সেই ভদ্রলোকটিই –” হ্যাঁ। তা…। হ্যাঁ। কিন্তু বউ তো তোমারই। ঠিক কিনা? …হ্যাঁ জানি। জানি। কিন্তু বউ কার? বিয়া দিছি তো? নাকি? এখন… হ্যাঁ কিন্তু বউ কার? কও তুমি দেখি…।
এমত সহসা পরিবর্তনের কারণটি খুব সাধারণ। এবং আমার বারো বছর চাকরী জীবনের বহু পরিচিত। কফ পরীক্ষায় টিবি ধরা পড়েছে বোনটির। সমস্ত দরদ এক নিমেষে উধাও। এ দেশে প্রতি বছর হাজারো লক্ষ ডিভোর্স হয় স্রেফ টিবির কারণে। স্কুল থেকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেওয়ার সবচাইতে বড় কারণ টিবি। সবথেকে বড় কারণ সংক্রামক রোগে মৃত্যুর….।
ভয় খুব ভাল জিনিস। ভয় পাওয়া উচিত প্রয়োজনে। কিন্তু, ভয় আর আতঙ্ক এক নয়। আতঙ্কের সাথে জড়িয়ে থাকে অশিক্ষা। পেঁচিয়ে থাকে – ঠুকে মারো।
— “দেখসেন? অবস্থাটা?” দীননাথ আরো একবার বললো – ” এমন ভাবে চললে এরা তো করোনা ছড়ায়ে যাবে চারধারে। ভাবছেন?”
ভাবলাম বলি – পেলে গুলি করে দিতে, তাই না? বললাম না। দীননাথকে কিছু বুঝিয়ে বলার ইচ্ছেটুকুও ছিল না আমার সে মুহুর্তে। ” হ্যাঁ ঠিকাছে। যাও” বলে ভাগিয়ে দিলাম শুধু চোখের সামনে থেকে। তারপর নতুন রোগীকে ডেকে নিলাম গলা তুলে। আর দীননাথ, ওই দীননাথ … চলে গেল পাশের ঘরে। সে ঘরে চনমনানো আড্ডা জমলো এবার বাকি কর্মীদের।
খোকাদার অনুনয়ে সেই তেতো ভাবটাই ফিরে এলো আবারও। হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে একটা ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ লোক। মাথায় কয়েকগাছি চুল। চোখে, খানিকটা আশা। আর বেগুনী মাস্কটার নীচে, ঠিক জানি, ঈষৎ হাঁ করা ঠোঁটের ফাঁকে কালচে রঙের মাড়ি।
চোখের পাতা বন্ধ করেই খুললাম। হাসলাম মৃদু। ভরসার ইঙ্গিত। হেলমটটা বদল করলাম অন্য হাতে। তারপর ধীরে ধীরে এক দু পা এগিয়ে বললাম–” ভয় নেই। হোক না কাশি সর্দি! হোক। হবে না? মানুষ তো। হতেই পারে। সিজ্যনাল বললেন তো নিজেই একটু আগে। তোঃ? কিচ্ছু হবে না খোকাদা। হাত পরিস্কার রাখুন। মাস্ক পরুন। আর সর্দি হলে দেখিয়ে নেবেন একবার আমাকে। ঠিক আছে?”
খোকাদার জোড়হস্ত এবার দৃঢ় হলো। বিগলিত অনুনয়। আঙুলের ফাঁকে চেপে বসা শীর্ণ আঙুল। হড়হড়ে গলাতে বললো–” ব্যাস ব্যা-স। আমার আর চিন্তা নাই ডাক্তারবাবু। আমার আর … টেনশন নাই। যান। খান গিয়া। চাইরটা বাজে তো।”
টেনশন যদিও আমার ছিল। কাশি সর্দি হলে বাকি আবাসিকদের সাথে লড়াই করতে হবে কিনা আমি জানি না। করতে হলে, জিততে পারবো কিনা, সে বিষয়েও সন্দেহ ছিল ঘোরতর। সিঁড়িতে তাই আমার পা পড়ছিল ধীরে ধীরে। হেলমেট ধরে থাকা হাতটা বড্ডো ক্লান্ত। ভালো লাগে না। ভালো লাগে না সত্যিই আর এই চারপাশটাকে।
আর ঠিক তখনই ফোনটা এলো। নেটওয়ার্ক ছিল না সকাল থেকেই। দক্ষিণবঙ্গের তান্ডবের পরোক্ষ ফলাফল সম্ভবত । এই এতক্ষণে তাহলে বোধহয় সিগন্যাল এসেছে। পকেট থেকে বের করে দেখি, মা। আর ফোন তুলতেই এক ঝলক আশ্চর্য হাসি– হ্যাপি বার্থ ডে বেটা।
তেতো ঠোঁট, একটু খানি উর্দ্ধমুখী বঙ্কিম হয়ে গেল অজান্তেই। একচিলতে বোকা বোকা হাসি। গতকাল রাত অব্দিও মনে ছিল দিব্যি। ডিউটিতে গিয়ে ভুলে গিছলাম। এখন.. আবারও মনে পড়ে গেল। কেতা মেরে ” থ্যাঙ্ক ইউ” বললাম লজ্জা ঢাকতে। আসলে, সহসা লজ্জা লাগছিল খুব। ছেলেমানুষী ধরা পড়ে যাওয়ার মতো অস্বস্তি। ছেলেমানুষ হতে পারার অকাল-আহ্লাদ। মা যদিও সেসব শুনছিলো না মোটেই। বলে যাচ্ছিল একটানা হুড়মুড় করে—
তোকে সকাল থেকে কত চেষ্টা করলাম বেটা…। লাইনই পেলাম না। খালি কেটে কেটে যাচ্ছে। খাল্লি নট রিচেবল বলছে…। বারোটার সময় করলাম তারপর আবার। তোকে তখনও দেখিনি আমি জানিস? বারোটাতেও? আধ ঘন্টা হয়ে গেছে প্রায় তুই হয়েছিস…। আমারও জ্ঞানও এসে গেছে। কিন্তু তক্ষনো কোলে পাইনি তোকে। কেমন দেখতে, কী রকম তুই… কিচ্ছু জানি না। ভাবলাম বলি ফোন করে বারোটার সময় তাই, — তোকে এখনো কোলে পাইনি আমি। … লাইনই পেলাম না ছাই। ভালো থাকিস বেটা। খুব খুব ভালো থাকিস। বছর বছর আসুক…।
মা বলেই যাচ্ছিল এক নাগাড়ে। আর একটু একটু করে ভেবলে যাচ্ছিলাম আমি। একটু একটু করে চোখের জল অহৈতুকী…।
— তুই অনেক মিষ্টি খাবি বলেছিলি, জানিস? অনেক মিষ্টি খাবো… অনেকগুলো মিষ্টি খাবো। ঝোঁক ধরেছিলি দুপুর থেকে। বুল্টিকে দিয়ে রসগোল্লা আনালাম দশটা। তা তোর কি চিৎকার। না-আ… অনেকগুলো মিষ্টি খাবো। ঠেলে দিলি প্লেটটাকে কাঁদতে কাঁদতে। আমি এবার কী করি! একা মেয়েছেলে। তারপর তোর বাবা ফিরলো। তখনো কাঁদছিস তুই। অ্যাতো জেদ! কম জেদ নাকি তোর? হ্যাঁ! এখনো যা চেল্লাস কথায় কথাতে…।
না না না। আমার গল্প শোনা হচ্ছে না। আমার শোনা হচ্ছে না আমারই আখ্যান। বেলাইন হয়ে যাচ্ছে রেলগাড়ি। আমি গল্প শুনতে চাই। জেদি একটা খোকার গল্প। প্লেট ঠেলে দেওয়া ঘুনসি কোমর ছেলের গল্প। কপালের পাশে আর পায়ের পাতায় টিইইইক্কা দিয়ে রাখা ধনের গল্প। ঠোঁট ফোলালেই যার জন্য হাজারো আয়োজন। না ঘুমোলেই যার জন্য হুলুস্থুলু। … পার্থ সোনা চাঁদের কণা। সবাই বলে দে না, দে না। দিলে যে আমার ঘর চলে না, সেই কথাটা কেউ বোঝে না…। আমি ঘ্রাণ নিতে চাই সেসব দাস্তানের। বড় জরুরি। বড় দরকার আমার। এখুনি।
— আহঃ মা। ধুর। তুমি অনেকগুলো মিষ্টির গল্প বলো তো। জেদ মেদ … ধুর
— দেখছিস? দেখতে পাচ্ছিস? এখনো কেমন তোর মেজাজ? দেখতে পেলি?… তারপর তো দু’জনে গেলাম তোকে কোলে নিয়ে। মিষ্টির দোকান। শোনো… ওকে যতগুলো খুশি মিষ্টি খেতে দাও। ঝোঁক করছে সকাল থেকে…। তা তোর বাবাও তো তেম্নি। তিন চার প্লেট মিষ্টি টেবিলে…। অ্যাতো খেতে পারিস নাকি তুই? একটাও খেলি না। আর সমানে চিৎকার… অনেক গুলো মিষ্টি খাবো। অনেকগুলো।
লাস্টে তোকে কোলে নিয়ে শোকেসের সামনে দাঁড়ালো তোর বাবা। বললো – বলো গরুবাবু … কোন্ কোনটা খাবে তুমি? …. ত-খ-ন, তখ্খোন দেখলাম তোর কাণ্ড। আঙুল দেখাচ্ছিস…। বোঁদে খাবি তুই। অনেকগুলো মিষ্টি মানে হলো তোর বোঁদে…।
খিলখিলিয়ে হাসছিল আমার জননী ফোনের ওইপ্রান্ত থেকে। ততক্ষণে সিঁড়ি শেষ করে বাড়ি ঢুকে গেছি আমি। পা ধুয়ে, লেংচে লেংচে ছেড়ে ফেলেছি জামা প্যান্টও। কিন্তু ফোন ছাড়িনি। অন্য দিনের মতো বলিনি– পরে করছি। এখন রাখো। ঠিকাছে?
আমার আটতিরিশে পা দেওয়া পরিপক্ক মন, যে মন ক্লান্ত, যে মন তিক্ত, যে মন বিধ্বস্ত বিষম রকম … সে-ই অসহায় মন আমার রেহাই চাইছিল এ সুতীক্ষ্ণ সুতীব্র বাস্তবতার থেকে।
আমার লজ্জা করছিল ভারী। আমার সঙ্কোচ হচ্ছিল খোলস ভাঙতে। নতুবা … আমি শুনতে চাইতাম আরো একবার আমারই হরেক আখ্যান। যেগুলো বহুশ্রুত। যেগুলো… আপাত মামুলি। যেগুলো বিগত জনম বিস্মৃতি। আমার সাধ হচ্ছিল ফোন চেপে ধরে বলি– সেইটা বলো না গো! সেই যে সেইবার… মাঝরাত্তিরে খাট থেকে পড়ে গিছলাম আমি। আর তোমরা ঘুমোচ্ছিলে। আর আমি কাঁদছিলাম। খুব কাঁদছিলাম। তারপর বাবা শুনতে পেলো। কে যেন কাঁদছে। কে যেন বলছে– পয়ে গেছি। পয়ে গেছি। আর ছুট্টে এসে খাটের নীচ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে। … সেই গল্পটা? আরেকবার…।
ফোনটা রেখে দিলাম সে সব না বলেই। আচমকা আমার মননে ভর করেছে শৈশব। দায়িত্ব, দায়, ঔচিত্য, ন্যায়… এসবের থেকে অনেক অ-নে-ক দূরে পৌঁছে গেছি তখন আমি। যখন, বুক ছিল ” আমার আর ভাল্লাগছে না” বলবার। যখন, গন্ধ ছিল অভিভাবকের।
সেই সবেই ফেরত যেতে চাই বোধকরি এইবারে। ক্লান্তি শেষের সুষুপ্তি। ঘাস জমিন হাঁফ ছাড়ার। সেইখানে, সে-ইখানে মুখ গুঁজে বলতে চাই আমি আমার প্রিয় মানুষকে –
হ্যাপি বার্থ ডে ডিয়ার মি … হ্যাপি বার্থ ডে।
অনেক তো হলো। অনেক, অনেক হলো। আর ভালো লাগে না এইসব। এবার ঘুমানো দরকার খুব। এবার প্রয়োজন জঠরের।
চোখে মুখে জলের থাবড়া মেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি এইবার। খোকাদা, সাইক্লোন, যক্ষ্মা, করোনা, নিরীহাসুর পার হয়ে অকাল শৈশব আমার চারিপাশে।
আর ঠোঁটে গুনগুন হিন্দি গানের –
যো ভি হ্যায়… বস্ এঁহি এক পল্ হ্যায়।
শুভ জন্মদিন হে প্রিয়।
শুভ জন্মদিন সব্যসাচী।