তুকতাক ফুঁক-ফাঁকে থাকে যদি বিশ্বাস
ধনে-প্রাণে মরবে যে, মিথ্যে সে আশ্বাস।।
এটা একটি সতর্কতামূলক ছড়া মাত্র নয়। এই ভুয়ো আশ্বাসে ভরসা রেখে প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে সর্বনাশ ঘটে চলেছে। এই ফুঁক-ফাঁকে বিশ্বাস করেই মান্নাপাড়ার মনসার ভরে গিয়ে প্রতিভানগরের বাসিন্দা ঊর্মিলাদেবী চল্লিশ হাজার টাকা ও তাঁর ক্যান্সার আক্রান্ত মেয়েকে হারিয়েছেন। দত্তপুকুরের ব্যাঙ্ককর্মী তরুণী জ্যোতিষীর নিদানে আত্মঘাতী হয়েছেন। স্বামীর সঙ্গে বিবাদ মেটাতে তান্ত্রিকের পাল্লায় পড়ে তাঁর লালসার শিকার হয়েছেন ঠাকুরপুকুরের তরুণী। পুত্র সন্তান লাভের আশায় তান্ত্রিকের পরামর্শে নিজের চার বছরের ভাইপোকে খুন করেছে মথুরাপুরের যুবক দেবেন্দ্র। বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে মায়ের রোগমুক্তির আশায় ফকিরবাবার শরণ নিয়ে গয়না ও নগদ টাকাপয়সা খুইয়েছেন গড়িয়াহাটের দম্পতি আদিত্য-তৃষা। এইভাবে প্রতিদিন জ্যোতিষী-তান্ত্রিক-ফকির-মোল্লা-পুরুতের হাতে আরও কত মানুষ যে প্রতারিত হচ্ছেন তার ইয়ত্তা নেই।
২০১৫ সালে উস্তি থানার অযোধ্যানগরের মান্নাপাড়ায় পবন পোড়েলের সদ্য গজিয়ে ওঠা দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে গ্রামবাসীদের অভিজ্ঞতা দেখে শুনে তার ঠকবাজি সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল হয়েছিলাম। পবন পোড়েলের সাথে মা মনসার নাকি সরাসরি কথা হত। কানে ঠেকানো জবাফুল তখন মোবাইলের মতো কাজ করত। এই সব বুজরুকির সাথে মিক্সিতে গুঁড়ো করা স্ট্রেরয়েড ও অন্যান্য ট্যাবলেট পুরিয়া করে খাওয়া ও লাগানোর বিধান দিত। মূলত বাইরের লোকের আনাগোনায় জায়গাটা সরগরম থাকত। আড়াই বছর পর আগত মানুষেরা গ্রামের লোকের কাছে অভিযোগ জানাতে থাকে। গঞ্জনা এবং ঐশ্বরিক ভয়ভীতি দূরে রেখে গ্রামের হিন্দু মুসলিম জনতা মিলিতভাবে তদন্তে নেমে ঠকবাজির স্বরূপ জানতে পারে। শেষমেশ গ্রামবাসীদের চাপে প্রশাসনের সহযোগিতায় তখনকার মতো “ভর-এর নাটক” বন্ধ হয়।
আপনারা নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল আছেন যে, ‘দ্য ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস (অবজেকশনাবল এডভার্টাইজমেন্টস) অ্যাক্ট ১৯৫৪’ অনুযায়ী মন্ত্র-তন্ত্র, দোয়া-তাবিজ দিয়ে কিংবা ঝাড়ফুঁক করে রোগ সারানো অথবা রোগ সারানোর দাবি করা আইনের চোখে অপরাধ। এর জন্য জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। পবন পোড়েলের মতো বুজরুকের উপর আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াতে সে জেলখানার বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসনের এই নিষ্ক্রিয়তায় জলপড়া-তেলপড়া, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি নানান ধরনের বুজরুকি চিকিৎসা ব্যবসা ও ধর্মীয় ভণ্ডামি বেড়ে চলেছে। কিন্তু আজকের যুগে এইসব অবৈজ্ঞানিক মিথ্যাচার চলতে দেওয়া যায় না। এতে যে শুধু আপনার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তাই-ই নয়; রোগ-ব্যাধি জটিল আকার নিচ্ছে, দুরারোগ্য হয়ে উঠছে।
তাই আমাদেরকেই সতর্ক থাকতে হবে। মানুষের জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত আসবেই। আমাদের দুর্দশাকে ‘ভাগ্য’ বলে না ধরে তার কারণ খুঁজতে হবে। অসুস্থতা বা জীবনের অন্য খারাপ পরিস্থিতিকে ‘গ্রহের ফের’ মনে করলে জ্যোতিষী-তান্ত্রিকদের কাছে আংটি-পাথর পরে ঠকতে হবে। কোনও সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ‘দৈব অনুগ্রহ’ নয়, যুক্তি দিয়ে সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে হবে। নইলে পবন পোড়েলের মতো জালিয়াতের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াতে হবে। এই সব বদমায়েশরা নিজেকে উপরওয়ালার ঠিকাদার বলে জাহির করে। এরা মোটেই ধার্মিক নয়। বরং অপকর্ম করেও টিকে থাকার জন্য এরা ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে। এরা লুটের টাকায় মন্দির বা অন্য ধর্মস্থান বানায়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই উন্নতির সময়কালে দাঁড়িয়ে কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা ছেড়ে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। জন্ডিসে তেলপড়া-জলপড়া আজ অচল। সাপে কাটলে থালাপড়া নয়, সোজা হাসপাতাল। পক্স হলে আর নিরামিষ নয়, মাছ-মাংস-ডিম খেলে শরীরে বল আসে। ডিসকো রোগের মিথ্যে আতঙ্ক আর নয়। বাঁশ গাছের জল পান করে রোগ সারানোর গুজবে কান দিলে বিপদ বাড়বে। আজকের দিনে পকেটে মোবাইল আর মগজে কুসংস্কারের গোবর একসাথে থাকতে পারে না। বিশাল পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখুন। একসময়ে যা অসম্ভব বলে মনে হত, মানুষ সেই সব কাজ অবলীলায় করছে। এখানে নারীপুরুষ, জাতপাত, ধর্ম বা ছুত-অছুতের ভেদাভেদ নেই।
আজ আমাদের নতুন করে বিচার করতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই? ওখানকার ডিগ্রির সাথে কুসংস্কারাচ্ছন্ন আচরণ আমাদের মানায় কি? বাবাজি-মাতাজি, জ্যোতিষী-তান্ত্রিকদের ঠকবাজি আর কত সহ্য করা যায়? একজোট হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। অন্যায়ের সাথে আপস নয়। বুজরুকদের বুজরুকি বন্ধে প্রশাসনকে সদর্থক ভুমিকা নিতে হবে।
এই দাবিতে সোচ্চার হওয়ার জন্য আপনাকেও আমাদের পাশে চাই।
লেখক ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি-র কর্মী।
সময়োপযোগী খুব ভালো লেখা ভাই।অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।