সদ্য শীতের রাত। কল্যাণীর বাতাস ঝুপঝুপে কুয়াশায় ঢাকা। একটা ভাঙাচোরা বাতিল হওয়া সরকারি ছোট্ট কোয়ার্টারে একটা ক্লাবপার্টি চলে। বকফুলের গাছ তার দুয়ারে। ম–স্ত লম্বাটে কম্পাউন্ড। ইতস্ততঃ ভুঁইফোড় কিছু খর্জুর বীথিকা – ইতস্ততঃ সঞ্চারমান ল্যান্টেনা ক্যামেরা ঝোপ – বাকি সব হাঁটু সমান চোরকাঁটায় ঢাকা। বাইরের রাস্তার পাশে একটা মস্ত পিপুল গাছ তার মনুমেন্ট সদৃশ গুঁড়ি নিয়ে অতন্দ্র চারপাশে দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্টে হলুদ আলো ঝুলে আছে। দোকানপাটের বালাই নেই। চুপচাপ নিঃঝুম।
ভেতরের টেবিলে একটা ক্যারম বোর্ড – ওপরে তার দিয়ে ঝোলানো একশো পাওয়ারের ডুমলাইট। একটা শতরঞ্চিতে গায়ে তুষের চাদর জড়িয়ে পদ্মাসনে বসে আছে আমাদের বিখ্যাত হাতুড়ে – তাঁর সুবিখ্যাত টাকখানি নিয়ে।
“তারপর আমি, পাঁচুগোপাল আর মিঠুবাবু শিমুলতলা স্টেশনে গিয়ে দেখি একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে – সেটা যাবে দেওঘর। একটা ছাদবিহীন মালকামরায় আমরা তিনমূর্তি উঠে পড়লাম…. খানিক পরে ক্যাঁচকোঁচ করে….”
এমন সময় ডলিদিদি এসে ক্লাবপার্টিতে শুধু জয়েন করলো তাই না পুরো চমকে দিলো। “এই সব আজকালকার ডাক্তারগুনো সব পয়সার পিচাশ …..চামার … আমার মেয়েটার বাচ্চা হবে …. বলে দিলো সিজার করবে …. বুঝি বুঝি – সব বুঝি- সব পয়সা খেঁচার ধান্দা…. তুই কি বলিস হাতুড়েভাই? সত্যি করে বলবি …”
“সত্যি সত্যি সত্যি” হাতুড়ে চটপট তিন সত্যি করে ফ্যালে।
“ফক্কুড়ি না করে বলতো দেখি নর্মাল ডেলিভারিতে অসুবিধেটা কি?”
হাতুড়ে টাকে বসে থাকা একটা হোঁৎকা মশাকে এ্যাক থাপ্পড়ে ধ্বংস করে বলে “অবশ্যই নর্মাল ডেলিভারিতে বেশ কিছু সুবিধে আছে -য্যামন…”
“তো তো না করে চটপট বল” ডলিদিদি হুকুম জারি করে।
“প্রথমে নর্মাল ডেলিভারির ক্রমঃপর্যায়গুলো বলি?” সবার অনুমতি টনুমতির তোয়াক্কা না করেই বলতে থাকে “প্রথমে হলো প্রথম স্টেজ। এর আবার তিনটে ছোটো ছোটো ভাগ আছে…”
চূণিলাল ফুট কাটে “এবার শুরু হোলো মহাভারত … তাও যদি প্র্যাকটিসটা ঠিকমতো জমাতে পারতিস….”
ডলিদিদির বেমক্কা চাঁটিতে চূণিলাল চুপ “তুই বলে যা হাতুড়ে – থামবি না”
সোৎসাহে হাতুড়ে বলতে থাকে “আসলে মেয়েদের জরায়ুর মুখে মানে বাইরের দিকে একটা মাংসপেশি দিয়ে তৈরি বেশ শক্ত একটা সিলিন্ডারের মতো অংশ থাকে …সেটাকে সার্ভিক্স বলে। ডেলিভারির প্রথম ভাগে অথবা আর্লি লেবারে সেটা নরম হয়ে ওঠে আর টাইট মুখটা একটু খানি ফাঁক হয় যাতে গর্ভস্থ শিশু ভবিষ্যতে বেরিয়ে আসতে পারে। আর্লি লেবারে এই ফাঁকটা এই ধরো না কেন- চার সেন্টিমিটার মতো ফাঁক হয় -এটাকে ইফেসমেন্ট বলে। সেই সময় থেকেই ইউটেরাস বা জরায়ুতে একটা কন্ট্র্যাকশন শুরু হয় অনেকটা পেটে মোচড় দেওয়ার মতো তবে তার থেকে অনেক তীব্র। এটা তিন চার মিনিট পর পর হয়। এই সময় পর্যন্ত হবু মাকে ঘরে রাখা যায়। এরপর অ্যাক্টিভ লেবার – এই সময়ে আরও ঘন ঘন লেবার পেইন ওঠে। অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বেরোতে শুরু করে মানে জল ভাঙা শুরু হয়। এই ফ্লুইডের ভেতরেই হবু বাচ্চা ভেসে থাকে। এই সময়েই মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। এবং লেবার ঠিক মতো এগোচ্ছে কিনা এবং বাচ্চা কোনও ডিস্ট্রেসে আছে কিনা বারবার পরীক্ষা করতে হয়”
তোৎলা গোপু বলে “খাইসে এটা কহতো ক্ষণ চলে?”
“মোট লেবার প্রথমবার বারো ঘন্টা মতো চলে তবে পরের বারগুলোতে সময় একটু কম লাগতে পারে”
ডলিদিদি ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
হাতুড়ে মহাভারত চালিয়ে যায় “এরপর আসে ট্রানজিশন স্টেজ। এই সময়ে লেবারে খুব ব্যথা হয় এবং খুব ঘন ঘন জরায়ুতে সঙ্কোচন হয়।
এরপর আসে দ্বিতীয় পর্ব বা সেকেন্ড স্টেজ। এবার সার্ভিক্স পুরোপুরি খুলে যায় মানে বার্থ ক্যানাল সম্পূর্ণ খোলা। প্রায় দশ সেন্টিমিটার। এবং ভীষণ জোরে ও পেইনফুল সঙ্কোচন হতে শুরু করে”
স্বভাব গম্ভীর গৌতম প্রশ্ন করে “কতোটা ব্যথা?”
হাতুড়ে মিষ্টি হাসে “ব্যথা তো মাপা যায় না তবে ধরে নে দু চারটে হাড়ভাঙার মতো ব্যথা বা হার্ট অ্যাটাকের থেকেও বেশী ব্যথা”
“তারপর তারপর?” অবিবাহিতা জিনিয়া সবিষ্ময়ে প্রশ্ন করে অ্যাজ ইফ এটা একটা রহস্য গল্প!
“এরপর দ্বিতীয় দশা বা সেকেন্ড স্টেজ। এখন ভয়ানক কন্ট্র্যাকশন হবে মানে সঙ্কোচন। সঙ্কোচনের সময় মাকে পায়খানা করার মতো করে জোরে জোরে চাপ দিতে হবে। ডাক্তারমশাইকে এসে মায়ের পেচ্ছাপের জায়গায় একটা ক্যাথেটার পরাতে হবে না হলে বাচ্চার মাথার চাপে অনেক সময় পেচ্ছাপের জায়গা মানে ইউরেথ্রা ফুটো হয়ে যেতে পারে। এবং ডাক্তারমশাই যদি মনে করেন যে বাচ্চার মাথার চাপে ভ্যাজাইনা ছিঁড়ে খুঁড়ে যেতে পারে তাহলে যোনির বা ভ্যাজাইনার পেছনের দিক দিয়ে পায়খানার দ্বারের থেকে একটু দূর পর্যন্ত কেটে দিতে পারেন। এটাকে এপিসিওটমি বলা হয়। এটা করার সময় জায়গাটা অবশ করা হয় তবে না করলেও মা টের নাও পেতে পারে। কেন না কন্ট্র্যাকশনের সময় ভয়ানক একটা ব্যথা হয়। এই কাজটা করার সময় প্রায়ই মায়ের চাপ দেওয়ার কারণে পায়খানা ছিটকে এসে ডাক্তারের মুখে মাথায় গায়ে মাখামাখি হয়ে যায়”
চূণিলাল ওয়াক তুলে বাইরে চলে গেলো।
হাতুড়ে হাসে “প্রত্যেকটা কন্ট্র্যাকশনের পর মা ক্রমশই ফ্যাটিগড হয়ে পড়তে থাকে। চাপ দেওয়ার ক্ষমতা কমে আসে। হয়তো সিস্টার না হলে ডাক্তার তখন পেটে চাপ দিয়ে সহায়তা করে”
ডলিদিদি আনমনে কি যেন ভাবতে থাকে।
“এরপরে আসে তৃতীয় দশা বা থার্ড স্টেজ। এই সময় ফুল বা প্ল্যাসেন্টা বেরোয় এটা না বেরোলে বা বেরোনোর ঠিক পরে পরে একটা ভয়াবহ ব্লিডিং শুরু হতে পারে। এটাকে বলে পিপিএইচ বা পোস্ট পার্টাম হেমারেজ এতে অনেক মা মারাও যায় ….যদি প্লাসেন্টা অ্যাক্রিটা থাকে বা প্লাসেন্টা প্রিভিয়া …. তাহলে তো বটেই …. না না এটা বন্ধ করা খুব কঠিন যদি সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন করে সামলানো না যায় এবং প্রচুর রক্ত দিতে হয়…. এটা আবার সিজারের সময় হওয়ার চান্স কম”
শঙ্কর বসে বসে মূলো খাচ্ছিলো বললো “ঠিকই কথা”
গোপু লাফিয়ে উঠলো “ওরে কে রে হহরিগোপাল এলি রে! তুই কি করে জানলি?”
শঙ্কর নিঃশব্দে মূলোঘটিত একটা পরমাণু বোমা ফাটিয়ে বললো “আমার পিসি বিল্ডিং হতে হতে মরে গেছিলো তাই জানি”
এরপর বোমাঘটিত কারণে জানালা টানালা খুলে ঘরের দূষিত বাতাস বার করা হলো।
ম্রীয়মান ডলিদিদি বললো “নর্মাল ডেলিভারির কি কোনোই সুবিধে নেই?”
হাতুড়ে একটা মজারু হাসি দিয়ে বললো “অবশ্যই … অবশ্যই আছে। এতে হাসপাতালে থাকার সময় কমে যায়। সব স্বাভাবিক থাকলে শিশুর ফুসফুস শক্তিশালী হয়। বার্থ ক্যানালের ফ্লোরা বা স্বাভাবিক ব্যাক্টেরিয়ারা শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং মায়ের দুধের ফ্লো বাড়ে।”
ডলিদিদি বেজায় উৎফুল্ল হয়ে বলে “দেখলি তো? দেখলি? আমি বলেছিলাম এরমধ্যে পয়সা খেঁচার কল আছে।” তারপর একটু মাথা টাথা চুলকে একটা পাকা চুল পটাং করে তুলে বললো “আচ্ছা হাতুড়িভাই নর্মালে অসুবিধে কিছু আছে?”
হাতুড়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে বোধহয় খানিক আকাশকুসুম দেখলো, তারপর বললো “বিদেশে নর্মাল ডেলিভারিতে মৃত্যুহার কম …কিন্তু মৃত্যু সব দেশেই আছে”
বিকাশদা ওর কেয়ারি করা চুল ঠিক করে বললো “আমাদের দেশে? মানে ইন্ডিয়াতে?”
হাতুড়ে বিকাশদার দিকে তাকিয়ে বললো “আমাদের দেশে অনেক অনেক বেশী। কেন না নর্মাল ডেলিভারির সময় বাচ্চার শ্বাসকষ্ট বা অন্য কোনও অসুবিধে হলে ওদেশে সব জায়গায় এমার্জেন্সি সিজারের ব্যবস্থা থাকে, সব জায়গায় এনআইসিইউ থাকে, মায়ের জন্য রক্তের ব্যবস্থা থাকে তৎক্ষণাৎ সব পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকে। বিশেষতঃ কেফালোপেলভিক ডিসপ্রোপোর্শন হলে মানে বাচ্চার মাথার তুলনায় মায়ের কোমরের হাড়ের ফাঁকটা ছোটো হলে তৎক্ষণাৎ অপারেশন করার সুযোগ থাকে। এখানে এ্যাতো কম ডাক্তার যে হয়তো তক্ষুণি তক্ষুণি অজ্ঞান করার ডাক্তার পাওয়াই গেলো না অথচ এনগেজমেন্ট অফ হেড হচ্ছে না, ডেট পেরিয়ে যাচ্ছে বা লেবার উঠছে না তখন অ্যামনিওটিক ফ্লুইডে বাচ্চা পায়খানা করে ফ্যালে, ফলে ফিটাল ডিস্ট্রেস হয় অথবা মায়ের কন্ট্র্যাকশনে যথেষ্ট জোর নেই। বাচ্চা নামছে না। এইসব ক্ষেত্রে এমার্জেন্সি সিজার করার ব্যবস্থা না থাকলে বেবি আর মা দুজনেই – ফট ফটাস। সেইজন্যই গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার ডেলিভারি করতে চায় না…. একটা মারও তো বাইরে পড়বে না, আর ডাক্তার তো শাওলিনের ছত্তিরিশ নম্বর খুপরিতে গিয়ে কুংফু শেখেনি….. অগত্যা …
আর সিজারের কি কি অসুবিধে জানতে চাও? এতে কোনও আর্টারি কেটে গেলে ভয়ানক ব্লিডিং হবে অথবা অপারেশনের পরে যখন মায়ের প্রেসার বেড়ে স্বাভাবিক হবে তখন সেলাইয়ের ফাঁক দিয়ে ব্লিডিং হতে পারে … তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আবার পেট খুলতে হবে। কখনও কখনও অ্যানাস্থেশিয়ার ওষুধে কারও কারও বেশী রিয়্যাকশন হয়…এটা আগে জানার কোনো উপায় নেই অথবা আগেই হার্টের কোনও অসুখ ছিলো তাহলে বিপদ হবে…. সেটা অবশ্য নর্মাল ডেলিভারিতেও হতে পারে”
ডলিদিদি সবিষ্ময়ে প্রশ্ন করে “ভালো সার্জেনের হাতেও শিরা ধমনী কেটে যাবে? এ্যাতো বড় ভুল….?” ডলিদিদি খাবি খায়।
হাতুড়ে ঘটঘট করে মাথা নাড়ায় “প্রত্যেক মানুষের মুখ চোখ য্যামন আলাদা আলাদা হয় তেমনই শরীরের ভেতরটাও আলাদা আলাদা হয় … প্রতিটা রোগীই একটা নতুন বই …না পড়া বই সুতরাং…”
আমাদের দলপার্টিতে আছে অজিতদা। আর ক্রিকেটে অজিতদার আছে ফর্মুলা ফট্টি ফোর লাগলে ছক্কা নৈলে ফক্কা -কাকু মানে অজিতদার বাবা বলেন “আমার অzit তো সাইকেল চালায় না ও হ্যালিকপ্টার চালায়!”
অজিতদা কথা বলার আগে ঠোঁট ফাঁক করে দাঁতে জিভ ঠেকিয়ে সাপের শিসের মতো একটা শব্দ করে হাওয়া টানে। অজিতদা বলে “শসসসস গ্রামে এই সব নেই ক্যানো?”
হাতুড়ে ঘাড় কাৎ করে ঘোঁৎঘোঁৎ করে খানিক হাসলো “সরকার অলাভজনক কাজে টাকা খরচ করবে না বলে….. তার থেকে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে একলাখী বিল হলে সরকারের পকেটে জিএসটি ঢুকবে তাই দিয়ে লাদাখে যুদ্ধু হবে, মন্দির হবে বোঝোই তো!”
হাতুড়ে চাদরটা গুছিয়ে উঠে যাচ্ছিলো অজিতদা ডাক দিলো “শসস তপু আয় এক হাত ক্যারাম পেটানো যাক। শসসসসস রাত তো বেশী হয় নি”
হাতুড়ে ক্যারাম বোর্ডের পাশে গিয়ে গুটি সাজাতে থাকে আর ডলিদিদি এই মুহূর্তে মোস্ট কনফিউজড পারসন অব পৃথিবী। গালে হাত দিয়ে বসে থাকে।
অথ হাতুড়ে কাহিনী সমাপিত চ।
দারুণ
ধন্যবাদ ভাইপো