প্রসঙ্গ অভয়া আন্দোলন। এটা নিয়ে লিখতে একটু দেরি হয়ে গেল বলে দুঃখিত। আমার রাজনৈতিক গুরুদেব বলেছিলেন যে চলমান আন্দোলনের বিশ্লেষণ চট করে করতে নেই। একটু থিতিয়ে এলে যখন দুধ কে দুধ আর পানি কে পানি হয়ে আসার পরে লিখতে হয়। আপাতত সেই পরিস্থিতি কিছুটা হয়েছে। নানান জায়গায় এখন অবধি হয়ে যাওয়া আলোচনা কমবেশি অনুসরণ করেছি। এবারে লেখা যেতেই পারে।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হওয়ার পরিমাণ যার যত কম তার বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ ততটাই আনুপাতিক হারে সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম এই যুক্তিটা মেনে নিয়েই আলোচনার সূত্রপাত হওয়া উচিত। ওই মেয়েটির মৃত্যু কোন শূন্যতার মধ্যে হয় নি। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে বিদ্যমান থ্রেট কালচারের পটভূমিকায় হয়েছে ঐ মৃত্যু ও ধর্ষণ (?)-এর ঘটনা। যাঁরা মেডিক্যাল কলেজগুলির হুমকি সংস্কৃতির সাথে পরিচিত নন, ওয়াকিবহাল নন তাঁদের কাছে ঐ সংক্রান্ত অভিযোগগুলি অবিশ্বাস্য লাগতে পারে। কিন্তু তাঁরা যদি একটু পরিশ্রম করে জানা বোঝার চেষ্টা করেন তাহলেই প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ অজস্র প্রমাণ পেতে পারেন ঐ হুমকি সংস্কৃতির উপস্থিতির।
দ্বিতীয় কথা এই যে, এই হুমকি প্রথার শিকার হয়ে অনেক চিকিৎসক ছাত্র ছাত্রী এবং কিছু শিক্ষক চিকিৎসকের মনে যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দিনের পর দিন ধূমায়িত হচ্ছিল সেগুলি আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের মতো বেরিয়ে আসার একটা সুযোগ পেয়েছে এই ভয়াবহ ঘটনার পটভূমিকায়। তাই অভয়ার সুবিচারের দাবির সাথে হুমকি প্রথার অবসানের দাবি এমন ভাবে জড়িয়ে গেছে যে দুটোকে কিছুতেই কেউ, কোনো রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সংস্থা আলাদা করতে পারবেন না। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কার্য কলাপও সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তৃতীয় কথা এই যে, বহুদিন বাদে এই আন্দোলনের প্রকার প্রকরণ (সবাই সবটা জানেন কেমন করে ধাপে ধাপে এই আন্দোলন চলেছে), ব্যাপ্তি ও তীব্রতার সামনে আন্দোলনের বিরোধী পক্ষ এমন অস্বস্তি ও অসুবিধের মধ্যে পড়েছে যে স্মরণাতীত কালের মধ্যে আমরা দেখতে পাইনি। খুব সচেতন ভাবেই শাসক কথাটা এড়িয়ে গেলাম কারণ একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দেখেছি যে শাসকপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী বহু মানুষজন এই আন্দোলনের মূল স্পিরিটের সাথে একমত হয়েছেন, আন্দোলনকারীদের নৈতিক (এমনকি আর্থিক) সমর্থন দিয়েছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে খুব বেশি মূল্য না দিতে চাইলে সামগ্রিক অভিজ্ঞতাও তাই বলছে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী শাসক গোষ্ঠীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কিছু সদস্যের মধ্যেও এই মনোভাব প্রকাশ্যে দেখতে পেয়েছি আমরা। তাই এই আন্দোলনে দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে, এইভাবেই আলোচনা করাটা যুক্তিযুক্ত।
চতুর্থ কথা এই যে, এই আন্দোলনের গতিপথ স্তব্ধ করতে বিরোধী পক্ষের পক্ষ থেকে কি কি সুনির্দিষ্ট অবয়বধারী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলি আমরা সবাই দেখছি। তার পাশাপাশি অবয়বহীন কিছু পদক্ষেপ ও আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে এসেছে যেমন মাস ও সোস্যাল মিডিয়াতে আন্দোলন এর প্রধান মুখ দের নামে বদনাম করা, কুৎসা রটানো, ছোট বড় হুমকি দেওয়া ইত্যাদি লাগাতার চলছে। বিরোধী পক্ষ তার সর্ব শক্তি দিয়ে বিরোধিতা করার জন্য ময়দানে নেমেছে। এটা প্রত্যাশিত। যেটা অপ্রত্যাশিত সেটা হল জনগণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের সাড়া দেয়া। এই সাড়া দেয়ার বিষয়টিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখানোর কোন চেষ্টা ছাড়াই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এই অংশগ্রহণ অভূতপূর্ব। আমাদের প্রতিবেশী দেশের ঘটে যাওয়া চলমান আন্দোলনের কথা মনে পড়ে যেতে বাধ্য।
পঞ্চম কথা এই যে, জনগণের এই অভূতপূর্ব যোগদানের গুণগত ও পরিমাণগত দিক দুটি আলোচনায় বাদ রেখে এই আন্দোলনকে কেবল মাত্র গুটিকয় ডাক্তারি পড়ুয়ার আন্দোলন ভাবলে বিরাট ভুল হবে। কেন এত ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিরোধী পক্ষ যে তত্ত্ব সামনে আনছে অর্থাৎ বাম-অতি বাম জোট দ্বারা সংগঠিত প্রচেষ্টা সেটা অস্বীকার না করেও একথা বলা যায় যে এই আন্দোলন কেবল মাত্র সংগঠিত প্রচেষ্টার ফসল নয়, এতে স্বতস্ফূর্ততার একটা বড় উপাদান আছে। গোটা ঘটনাটির ভয়াবহতা, পাশাপাশি কিছু কর্তৃপক্ষের চরমতম সংবেদনশীলতার অভাব, শিষ্টাচারের অভাব এবং সর্বপরি ভ্রষ্টাচার ও উদাসীনতার অভিঘাতে বিপর্যস্ত জনগণ কিন্তু প্রাথমিক আকস্মিকতার অভিঘাত কাটিয়ে প্রবল ক্ষোভে ফেটে পড়েছে এবং আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা দুটোই বেড়েছে উত্তরোত্তর।
ষষ্ঠত আমরা আজ কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা বুঝে নিতে গেলে এটা মেনে নিতেই হবে যে জনগণের একটা অংশ হতাশ। বিশেষ করে সেই অংশটি যারা “হোপ এগেনস্ট হোপ” ভেবেছিলেন যে খুব তাড়াতাড়ি একটা কিছু ফল পাওয়া যাবে। আমাদের প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার সুপরিচিত দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়টি তাঁরা ক্ষণিকের জন্য বিস্মৃত হয়েছিলেন এবং সেই দোষে আজ আশাভঙ্গের বেদনায় ভুগছেন।
শেষ যা বলার তা হল এই যে, আন্দোলন এই পর্যায়ে এসে স্তিমিত হলেও শেষ হয়ে যায় নি। তাই শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। দিনের শেষে “হাতে রইল পেন্সিল” ঠিক নয়, জুনিয়র ডাক্তারদের কিছু কিছু দাবি দাওয়া আদায় হয়েছে এবং হচ্ছে। এই মূর্ত দাবি আদায়ের পাশাপাশি প্রধান বিমূর্ত দাবি সেই হুমকি সংস্কৃতির অবসান এর খুব আশাব্যঞ্জক ইঙ্গিত কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। ঐ সংস্কৃতিতে যুক্ত অনেকেই আজ ফোঁটা কেটে বিড়াল তপস্বী হয়েছেন, ভক্ষক থেকে রক্ষক সাজার চেষ্টা করছেন।
যারা ভাবছেন, ভাবতেই পারেন কারণ উইশফুল থিংকিং এর ওপর অন্যের হাত থাকে না, যে আন্দোলন শেষ, এর যে অভিঘাত নেই সেটা আগামী উপ নির্বাচনের ফলাফলে প্রমাণ হয়ে যাবে তাদের একটাই কথা বলার আছে। অমনটা ভেবে মূর্খের স্বর্গে বাস করবেন না। গোটা ঘটনায় বেশ কিছু মানুষজনের মনে এমন গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে যেটা সারা জীবনেও যাবে না। তাদের কাছে এই “সুবিচার চাই” দাবি টা নিছক কোর্টের রায় বেরোনোর জন্য অপেক্ষমান একটি মানসিক অবস্থা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। তারা একটা গোটা সিস্টেম এর পরিবর্তন চান। সেটা যতদিন না হচ্ছে তারা ঐ দাবিটা ভুলবেন না। মনের গহন গভীরে শেকড় গজিয়ে গেছে এই দাবির, আজ কোনো বিরোধী পক্ষের ক্ষমতা নেই তাকে উপড়ে ফেলার। আপাতত এই পর্যন্তই। শুভ বনাম অশুভ এর লড়াই জারি থাকছে।