দেড়শ’ বছর আগে ডেঙ্গি মহামারী এড়াতে বালক রবীন্দ্রনাথের পরিবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী ছেড়ে পেনেটি-র বাগানবাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। চলতি কথায় ডেঙ্গু বলা হলেও রোগটার আসল নাম ডেঙ্গি।
অন্য ভাইরাল রোগের সঙ্গে সাধারণ ডেঙ্গির উপসর্গ-লক্ষণে খুব একটা ফারাক নেই—হঠাৎ করে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, মাথাব্যথা, গাঁটে ব্যথা। কয়েকদিন পর জ্বর সেরে যায়। অধিকাংশ সময় আমরা বুঝতেই পারি না যে ডেঙ্গি হয়েছিল। তাতে অবশ্য ক্ষতি নেই তেমন—কেন না ডেঙ্গি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আপনা-আপনিই সারে, ডেঙ্গি ভাইরাসকে মারতে পারে এমন কোন ওষুধও অবশ্য নেই। সমস্যা হল বিশেষ ধরনের ডেঙ্গি নিয়ে, যে ডেঙ্গিতে মানুষ মারা যান। খবরের কাগজ ও টিভিতে প্রচার ও রোগ-প্রতিরোধ ও রোগ-চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপান-উতোরে আতঙ্ক বাড়ে।
ডেঙ্গি আমাদের দেশে নতুন নয়—হাড়-ভাঙ্গা জ্বর বা হাড় মুড়মুড়ি ব্যারাম বোধহয় এই ডেঙ্গিই। কিন্তু গত ৩৫ বছর ধরে সারা পৃথিবীতেই ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ছে।
- ১৯৯৮-এ ৫৬টা দেশের ১২ লক্ষ মানুষ ডেঙ্গির এক মহামারীতে আক্রান্ত হন।
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ লক্ষ মানুষ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে ৫ লক্ষের হয় মারাত্মক রক্তক্ষরী ডেঙ্গি, এঁদের মধ্যে অন্তত ১২ হাজার মারা যান, যাঁদের অধিকাংশই শিশু।
- গত ১৫-২০ বছরে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে—দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় শিশুদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও মারা যাওয়ার কারণ হিসেবে এখন ডেঙ্গির স্থান পেটের অসুখ ও শ্বাসনালী-ফুসফুসের হঠাৎ করে হওয়া তীব্র সংক্রমণের ঠিক পরেই।
ডেঙ্গির রোগজীবাণু
এ রোগের জীবাণুর নাম ডেঙ্গি ভাইরাস। এই ভাইরাসের অন্তত চারটে ধরন রোগ ঘটায়।
ডেঙ্গি জীবাণুর বাহক
যেমন এনোফিলিস মশা ম্যালেরিয়ার পরজীবী বয়ে আনে, যেমন ফাইলেরিয়ার পরজীবীকে বহন করে কিউলেক্স মশা, তেমনি ডেঙ্গির ভাইরাসকে বয়ে বেড়ায় ইডিস মশা। ইডিস মশা ছোট্ট, গায়ে ডোরা কাটা দাগ, এই ডোরা কাটা দাগের জন্য এদের টাইগার মসকুইটোও বলা হয়।
মানুষের বসতি ও তার আশেপাশে জমে থাকা পরিষ্কার জলে ইডিস ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার আগে কেবল স্ত্রী মশাই রক্ত খাবার জন্য মানুষকে কামড়ায়। এরা কামড়ায় দিনের বেলায়। এরা খুব বেশী উড়তে পারে না, তাই থাকে বাড়ীর আশেপাশেই।
ডেঙ্গি রোগীকে মশা কামড়ালে জীবাণু মশার পেটে চলে যায়। ৮-১০ দিন মশার পেটে বংশবৃদ্ধি করার পর সেই মশা কোন সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তার শরীরে ডেঙ্গির জীবাণু ঢোকে।য় জীবাণু ঢোকার ৩ থেকে ১০ দিন (সাধারণত ৫-৬ দিন) পর ডেঙ্গি রোগের উপসর্গ-লক্ষণ ফুটে ওঠে।
ডেঙ্গির উপসর্গ-লক্ষণ
সাধারণ ডেঙ্গি
হঠাৎ করে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, খুব মাথাব্যথা হয়, পেশী ও গাঁটেগাঁটে এমন ব্যথা হয় যে নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়। ২৪ ঘন্টার মধ্যে চোখের পেছনে ব্যথা দেখা দেয়, চোখ নাড়ালে ব্যথা হয়, চোখে চাপ দিলে ব্যথা বাড়ে, আলোর দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। খুব দুর্বল লাগে, খিদে কমে যায়, পায়খানা কষে যায়, পেট কামড়ানো, কুঁচকিতে ব্যথা, গলা ব্যথা, অবসাদ, ইত্যাদি হতে পারে। তাপমাত্রা সাধারণত ৩৯ থেকে ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থাকে। কয়েকদিন পর সাধারণত জ্বর ছেড়ে যায়, জ্বর থাকে না কয়েক ঘন্টা থেকে ২ দিন অবধি। দ্বিতীয় বার জ্বর এসে থাকে ১-২ দিন। জ্বর না থাকার সময় বা দ্বিতীয় বার জ্বর হওয়ার সময় প্রায় ৮০% রোগীর চামড়ায় ফুস্কুড়ি বেরোয়। মোটামুটি ৫ দিনে ডেঙ্গি জ্বর ভালো হয়ে যায়, যদিও দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগতে পারে। এ ধরনের ডেঙ্গিতে মৃত্যুর হার খুব কম।
রক্তক্ষরী ডেঙ্গি
হঠাৎ করে খুব বেশী জ্বর হয় (৪০ থেকে ৪১ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড), মুখ লালচে দেখায়, মাথাব্যথা থাকে। খিদে কমে যায়, বমি হয়, ডান দিকের পাঁজরের নীচে টিপলে ব্যথা লাগে বা পুরো পেটে ব্যথা হয়। এই ধরনের ডেঙ্গির গুরুতর অবস্থায় ছোটো বাচ্চাদের খিঁচুনী হতে পারে। শরীরে অণুচক্রিকার সংখ্যা খুব কমে গিয়ে নানা জায়গা থেকে রক্তপাত হতে পারে—চামড়ার ওপর লাল লাল ফুটকি, আপনা থেকে কালশিটে পড়ে যাওয়া, নাক দিয়ে ও মাড়ি দিয়ে রক্তপাত, কালো পায়খানা, রক্তবমি, ইত্যাদি হতে পারে। যদি একসাথে একাধিক ধরনের ভাইরাস দিয়ে সংক্রমণ হয় তাহলেই রক্তক্ষরী ডেঙ্গি (Dengue Hemorrhagic Fever) হয়।
ডেঙ্গি থেকে শক
শরীরের রক্তজালিকা বা ক্যাপিলারীর দেওয়াল থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় পদার্থ বেরিয়ে আসে। ফলে রক্ত চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে রোগী অচেতন হয়ে পড়েন। নাড়ী দুর্বল ও দ্রুত হয়, রক্তচাপ কমে যায়, চামড়া ঠান্ডা হয়ে যায়। ডেঙ্গি থেকে শক (Dengue Shock Syndrome)-এ খুব দ্রুত চিকিৎসা না করলে মৃত্যু প্রায় অবধারিত। তবে রক্তক্ষরী ডেঙ্গি বা ডেঙ্গি থেকে শক খুবই অল্পসংখ্যক রোগীর হয়, এই যা বাঁচোয়া।
ডেঙ্গির জন্য ল্যাবরেটরী পরীক্ষা
ডেঙ্গি হয়েছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কয়েক ধরনের পরীক্ষা করা যায়—
১। রক্তে ডেঙ্গি ভাইরাস আছে কিনা দেখা—এতে রোগের উপস্থিতি সবচেয়ে নিশ্চিত করে বলা গেলেও এই পরীক্ষায় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ কর্মী লাগে বেশী।
২। রক্তরসে ডেঙ্গি ভাইরাস-বিরোধী এন্টিবডির মাত্রা বাড়ছে কিনা দেখা—এই পরীক্ষাগুলো সহজ, সময়ও কম লাগে। কিন্তু ডেঙ্গি ও অন্য এই জাতীয় ভাইরাসের মধ্যে সাদৃশ্যের জন্যে ফলস পজিটিভ ফলাফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে (অর্থাৎ পরীক্ষার ফল বলছে ডেঙ্গি হয়েছে, কিন্তু আসলে ডেঙ্গি হয় নি)। কিন্তু এন্টিবডি তৈরী হতে ৪-৬ দিন সময় লাগে, তাই রোগের প্রথমাবস্থায় ফলস নেগেটিভ ফলাফলও আসতে পারে।
৩। রক্তে ডেঙ্গি এন্টিজেন নির্ণয়ের পরীক্ষা NS-1 এন্টিজেন—সংক্রমণের ১ থেকে ৯ দিন অবধি এই পরীক্ষায় ফল পাওয়া যায়। তবে অন্য ভাইরাল জ্বরেও ফলস পজিটিভ ফল পাওয়া যেতে পারে।
৪। এছাড়া রোগীর মৃত্যুর পর তার কলা (টিস্যু)-র ইমিউনো-হিস্টোকেমিস্ট্রি পরীক্ষা, রোগীর রক্তরস বা কলার পলিমারেজ চেন রিএকশন পরীক্ষা করে ভাইরাসের আর এন এ দেখা—এসব রোগ-নির্ণয়ের নতুন পরীক্ষা।
৫। রোগটাকে নিশ্চিতভাবে সনাক্ত করা ছাড়া এই পরীক্ষাগুলোর কোন গুরুত্ব কিন্তু রোগ-চিকিৎসায় নেই। গুরুত্বপূর্ণ হল রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা মাপা। অণুচক্রিকা কমে যাওয়া ডেঙ্গির এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। সাধারণত প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা ১ লাখের নীচে নেমে আসে। ২০ হাজারের নীচে নামলে আপনা থেকেই রক্তপাত হতে পারে।
ডেঙ্গির চিকিৎসা
- এই রোগের কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, সাধারণ ডেঙ্গিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ারও কোন দরকার নেই।
- জ্বর কমানোর জন্য শরীরে জলপট্টি বা বরফ দেওয়া যায়। এছাড়া ব্যথা ও জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল খাওয়া যায়।
- এস্পিরিন, আইবুপ্রোফেন, ডিক্লোফেনাক, আদি অন্যান্য জ্বর-বেদনানাশক দেওয়া যাবে না, কেন না এগুলোতে রক্ত-ক্ষরণের প্রবণতা বাড়ে। তাছাড়া ভাইরাসজনিত জ্বরে বাচ্চাদের এস্পিরিন খেতে দিলে রে’জ সিনড্রোম নামক জটিলতার জন্য মৃত্যুও হতে পারে।
- শরীরে জলের পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য জলসহ অন্যান্য তরল প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে। খুব বেশী ঘাম, পাতলা পায়খানা বা বমি হতে থাকলে নুন-চিনির শরবৎ বেশী করে দিতে হবে।
- রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা খুব কমে গেলে বা নিজে থেকে রক্ত-ক্ষরণ হতে থাকলে পুরো রক্ত বা অণুচক্রিকা দিতে হবে অবস্থার গুরুত্ব বুঝে।
- ডেঙ্গি থেকে শক হলে হাসপাতালে ভর্তি করে শিরায় বিভিন্ন তরল দিতে হয়।
- ডেঙ্গিতে এন্টিবায়োটিকের কোন ভূমিকা নেই।
ডেঙ্গি একটা সামাজিক রোগ
অন্যান্য সংক্রামক রোগের মত ডেঙ্গি সংক্রমণ ও ডেঙ্গির মহামারী হয়ে ওঠার পিছনে আছে সামাজিক কারণ। জনসংখ্যাবৃদ্ধি, কাজের খোঁজে মানুষের গ্রাম থেকে শহরে চলে আসা ও তাদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে বাধ্য হওয়া, বিভিন্ন কাজে মানুষের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আসা-যাওয়া বেড়ে যাওয়া, ইত্যাদি হল ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ। আরেকটা বড় কারণ হল রোগ-জীবাণুবাহী কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারী কর্মসূচীতে ঢিলে পড়া।
ডেঙ্গি প্রতিরোধ
- ডেঙ্গির কোন কার্যকরী টীকা এখনও বেরোয় নি।
- কিছু কিছু ভাইরাসজনিত রোগ একবার হলে আর হয় না, কেন না শরীর ঐ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ডেঙ্গির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম হয় না, কেন না চার রকম ডেঙ্গি ভাইরাস দিয়ে ডেঙ্গি হতে পারে। তাই কোন নির্দিষ্ট ধরনের ভাইরাস দিয়ে একবার ডেঙ্গি হলে সেই ভাইরাস দিয়ে আর ডেঙ্গি হবে না কিন্তু অন্য রকম ভাইরাস দিয়ে ডেঙ্গি হতেই পারে।
- মশারি ব্যবহার করে ম্যালেরিয়ার হাত থেকে বাঁচা যায়, কিন্তু ডেঙ্গির হাত থেকে বাঁচা যায় না। কেন না ইডিস মশা কামড়ায় দিনের বেলায়। লম্বা হাতা জামা-ফুলপ্যান্ট পরে মশার কামড় থেকে কিছুটা বাঁচা যায় বটে, কিন্তু গরমের দেশে সব সময় লম্বা হাতা জামা, ফুলপ্যান্ট পরা কতটা সম্ভব?
- ডেঙ্গি প্রতিরোধের আসল উপায় হল ইডিস মশার বংশ-বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা। পরিষ্কার জল জমতে না দিলে ইডিস মশা ডিম পাড়তে পারে না। পূর্ণবয়স্ক মশাদের মারার জন্য বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার করা যায়, তবে এই কীটনাশকগুলোর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর ওপর বিষক্রিয়া আছে। কিছু ছোটো মাছও মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে মশার বংশবৃদ্ধি আটকায়।
ভিয়েতনাম ডেঙ্গি নির্মূল করতে পেরেছিল
ভিয়েতনাম তার ১২ টা রাজ্যের ৩ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষকে ডেঙ্গি থেকে বাঁচাতে এক অভিনব রণনীতি তৈরী করে। বড় জলাশয়গুলোতে এক ধরনের শামুক ছাড়া হয় যারা ইডিস মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে। ডেঙ্গি সম্পর্কে জনশিক্ষা দেওয়া হয় ও পরিত্যক্ত পাত্র (যাতে জল জমতে পারে) নষ্ট করে ফেলার মত কাজও এই কর্মসূচীর অন্তর্গত ছিল। ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ অবধি সাফল্যের সঙ্গে এই রণনীতি কার্যকর করা হয়। ২০০২ থেকে এই বিস্তীর্ণ এলাকায় ডেঙ্গি জ্বরে একজন রোগীও ধরা পড়েন নি।
ভিয়েতনাম পারলে আমরা পারবো না কেন? সরকার, পুরসভা, পঞ্চায়েতের পাশাপাশি জনসাধারণের উদ্যোগ, তাঁদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অবশ্যই ডেঙ্গিকে প্রতিরোধ করা যায়।